১২.


ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশামোড়া কোন এক কুহক শীতের রাতে
ছয় বেহারার পালকী এসে ভীড়ে ঘাটে, নদীতে মিটি মিটি আলো
তারপর বৈঠার ছপ্ ছ্প্ শব্দ নিয়ে যায় দূরে,
রাতের অন্ধকারে, একা; কোথায় যায় সে নাও,
পথ আছে নাকি উধাও, শেষ শীতের শির শিরে হিম
ঘিরে ধরে রাখে; তারপর দেখি নাও ভিড়ে আছে পরিচিত ঘাটে।


তখনো ফোটেনি আলো ভালো করে, বড়াল নাকি মধুমতি
নাকি সে জলাঙ্গীর ধারে, আরো কত নাও, জলেতে পাই
জাল নাড়ানোর শব্দ, চিরচেনা পরিচিত পাশ, প্রাণ ভ’রে নিঃশ্বাস,
রাত জাগা ভেজা ঘাসে গুটি গুটি পা, রাখি, যেন আলপনা আঁকি
পথ টানে কুয়াশার গাঁয়ে, ভিজে ওঠে নীলম্বরী শাড়ী,
ভেজা ভেজা দীর্ঘ সরু চুল কথা কয়ে ওঠে যেন কার সাথে,
কবে যে হয়েছিল শেষ কথা, রাতের কথকতা, সেই কবে
কতদিন আগে, বিস্মরণের ওপারে, নক্ষত্র আড়াল করা ম্লান ঠোঁটে।
অপূর্ণতা ঘিরে ধরে চারপাশ, দেখি জঙ্গল-ঝোপঝাড়, কাত হয়ে
পড়ে আছে কত বাঁশ, পথের উপরে, পথের ধারে, ছায়ান্ধকার করে;
পথ যেন ফুরোয় না কোন মতে, কতগুলো সময় একসাথে মাথার ভিতরে
ভীড় করে, কার সাথে কথা বলি, কার গায়ে বুলাই স্পর্শ
নগ্ন নিরাবরণ হিম হয়ে আসা দু’হাত, অভিমান তাদের ঠোঁটে
কথারা এসে জড়ো হয়, চারপাশে ঘিরে ধরে, আপন করে,
আমি আনমনে সাঁতার কাটি মাছেদের মতো অশ্রুত সেই
কথাদের গভীরতায়, অদৃশ্য নিঃস্বাদ সেই সময়ের স্রোতে।


পায়ে পায়ে পথ এসে থামি জামরুল আর কামরাঙ্গার নিচে,
অস্পষ্ট আলোয় দেখা যায় তার ঘর, ইচ্ছে করে চুরি করি
সব ধন চোরের ঘর থেকে, সিঁদ কেটে, ঘরের ছাউনী কেটে
ইঁদুরের মত গর্ত করে, চুরি করি নবীন জীবন- কোরক ফোটা দিন,
ইচ্ছে করে ফুঁড়ে যাই হৃদপিন্ডে তার, খাবলে তুলে আনি
বুকের ভিতরে একপাশে কাত হয়ে অবিরাম শুয়ে থাকা
কৃষ্ণাতিথির শেষ চাঁদ; জিজ্ঞাসা করি, কী ধন খোঁজ তুমি
ঘোর অমাবস্যার কিবা ঠাসবুনন কুয়াশার ভিতরে,
কোন ঘাই হরিণীর সন্ধান কর দূরে ঘুরে ঘুরে ঘুরে
শহর নগর বন্দর, নদী বা নারী-দেশ বা চরাচর-
বাহির-অন্দর, সভ্যতা কী অসভ্যতা- বিদর্ভ বা বিশাখা
রাধাচূড়া, সোনালু না কৃষ্ণচূড়া, শালুক না জমিদারের তালুক
কী তোমার তত্ত্ব-তালাশ, কিসের আশা? চিরায়ত, বেলফুল,
কাশফুল, পদ্ম-স্রোতে ভাসা-নাকি অতৃপ্তের অশুভ আত্মা?-
তাড়া করে ফেরে সারাক্ষণ, অস্থির এমন তোমার মন,
প্রাণহীন পত্রহীন বৃক্ষ, কিম্ভূত কাকও বসে না তার শাখে।


তবু সে আসে, ঘুমঘোরে, রাতের আঁধারে, বেড়ালের পায়ে
লাফ দিয়ে জানালা গ’লে ঢোকে ঘরে, বাহির করে নেয়
তারপর খড়ের গাদা, কাশের বন, নৌকার ছই
চাঁদ গলে যায়, ঝরে ঝরে পড়ে শীত শীত রাতের
ঝিরি ঝিরি কম্পমান জলে, জোছনার মতো অবিরত,
কুয়াশার অবগুন্ঠন ঘোরাটোপ, চারধারে, তবুও ভোর হয়,
বুক চিরে বেরিয়ে যায় শঙ্খচিল, উঠে যায় উত্তর আকাশের
দিগঙ্গনা সাজকে ফেলে, ইচ্ছায়? সমাজের কালসাপ এড়িয়ে,
নাকি অবহেলে, নক্ষত্রমাখা রাত্রিকে ফেলে, ম্লানমুখ করে, দূরে।


এস, এম, আরশাদ ইমাম//২৩ জুলাই ২০১৫; বৃহস্পতিবার; ০৮ শ্রাবণ//ঢাকার জীবন