১৩.


এখানে এই বৃক্ষতলে, কে যেন কথা বলে, মা নাকি অন্যকেউ
অস্পষ্ট শ্লেষ্মাজড়িত কন্ঠস্বর আসে, তারপর শুনি তার আওয়াজ
ফসফরাসের মতো রাতের সমুদ্র যেন দিনের আলোর মতো
ফেনায়িত উজ্বল হয়ে ওঠে, নিমেষে, চঞ্চল হরিণ নেচে ওঠে
মনের গহীন বনে, আনমনে, শামুক গুগলী এসে শয্যা পাতে পদতলে
মনের সিগন্যাল ঘড়ি ভুল শব্দ তোলে, থেমে যায় অসময়ের ট্রেন
হুটহাট খুলে যাওয়া খিড়কীসকল দামাদম বন্ধ হয়ে যায়;
তার কন্ঠস্বর যেভাবে অকস্মাৎ সুরতরঙ্গ তুলেছিল, সময়কে ভুলে,
দেহমনে, সহসা চোখের সামনে তার অবস্থান, যদিও কুয়াশার
শুভ্রবসন ঘিরে আছে দেহের নীলাম্বর, উঠোনের একপাশে ঘর,
চোখের আলো যেভাবে যেভাবে উঠেছিল জ্বলে, আবার নিভে যায়
মৃত শরীর যেন আত্মা ফিরে পায়, চোখের সামনে দেখে
কোন প্রেতাত্মাকে, সারাদেহ, পুরোমন, স্থবির ব্যাঙ হয়ে ওঠে।


মুখোমুখী হবার ইচ্ছেটুকু গলে যায়, সহসাই, উঠোনের ওপাশে
বারান্দার চালায় বসে থাকা সে চোর, অভিমান বুক ঠেলে
উথলে বেরিয়ে আসতে চায়, ফিরে চলি পুরাতন পথে,
সেই পথ, জাম বা জামরুল গাছ, পুকুরের পাড় ধরে,
পায়ের তলে শামুক গুগলি, পাতা মুদে থাকা লজ্জাবতীর বেগুনী ফুল,
বেমানান ভুল, তেঁতুল তলায় এসে ফিরে চাই একবার, তারপর
অভিমানহীন, প্রেমহীন, স্মৃতি ও বিস্মৃতিহীন-আলোর সকাল।
নদী তীরে বাধা আছে তরী, জেলেদের হল্লা বড় ভারী, ঠেকে কানে
বিশ্রান্ত শরীর মন, গলুই এ পা রাখি, মাঘের শেষ বা ফাল্গুনের
কোন বাঁকে, তার স্মৃতি সব কিছু ম্লান করে রাখে।
সে কেন ডাকে না একবার, কিছুই কী ঘটেনি তার, মনে বা
কর্ম সৃজনে! বিস্ময়াভিমানে শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে, পড়েছে
ভোরের আলো, নতুন এ জীবনের অবগাহে, ধীরে ধীরে প্রবেশ করি
অভিমানের দুরজ্ঞেয় কাচমহলার ভিতরে, সে থাকে বাইরে।


পৃথিবীর পথে, আমার এ যাত্রা আজ উল্টোরথে,
আমার পথ চলা শুরু--ধূসর বছর থেকে ধূসর বছরে—
নড়ে ওঠে নাও, নড়ে ওঠে মাছরাঙ্গা ঠোঁটে নিয়ে শতনদী অশ্রু
আমাকে ঠেলেছে যে রৌদ্রের ভিতরে, আমাকে যে উড়িয়েছে
ধানের চিটার মতো ফসলের শেষে, সে কীভাবে সবুজ হয়,
কীভাবে তার বুকে রাজহাঁস, মরাল, পানকৌড়ী বা জলকুক্কুট
খেলা করে! ভাবি রোদ বড় হওয়া শীতের ভোরে।
সাঁতরে চলে সময়ের প্রাণহীন ভেলা, এ বেলা, রসহীন মৌনলতা
ডাকে না কেউ তাকে, অসম্মান ঘিরে ধরে থাকে,
ঝরে গেছে বনফুল, শুষ্ক কী আঙুলের সজীবতা, বন্ধন,
হারিয়ে ফেলেছি কী বাংলার জলভেজা মাটি, সেন বাড়ির
তুলসী তলা কী গেছে এই কালে, আমি কী সত্যিই আজ
রাঢ় বাংলার রুখু মাটিতে বেড়ে ওঠা অচেনা অপরিপুষ্ট বুনোলতা?
জলরেখা ইতিহাস হয়ে সেঁটে থাকে অনিমেষ, জীবনের হিসেব।
ফিরে আসি আরেক সাঁঝ বেলায় সন্ধ্যা প্রদীপ হাতে
যখন সন্ধ্যাতারা নতুন আলো নিয়ে ফিরে এসেছে
পৃথিবীর কপালে, আমি ফিরে আসি আমার নতুন চেনা,
নতুন আখরে বোনা দুঃস্বপ্ন ঘেরা স্বপ্নের পাটিতে।


এস, এম, আরশাদ ইমাম//২৪ জুলাই ২০১৫; শুক্রবার; ০৯ শ্রাবণ//ঢাকার জীবন