১৪.


তবু মনে পড়ে কোন কোন মেঘ বিকেল, অথবা ধোঁয়াশা সন্ধ্যা
মনে পড়ে, কেন জানি না, এমনই এক সন্ধ্যার ট্রেনে
অকস্মাৎ বৈশাখী ঝড়ের মত, জানি না, কিভাবে এক
পথিক এসে জোটে আমার উঠোনে, একমুঠো শ্রান্তি চায়
দৃষ্টির গভীরতা ঢেলে তাকিয়েছিল, একদার কেউ; বুকে পুরাতন ঢেউ
কাঠখড় পুড়িয়ে আরেকবার, বাজাতে জীবনের সাইরেন।
নিস্তরঙ্গ দেহ, ঢুলু ঢুলু ক্লান্ত দু’চোখ, এলোমেলো পদক্ষেপের সাথে
জীবনের হাহাকার মিশে ছিল বিলের ঘোলা জলে, পৃথিবীর পাঁকে
সাহসীই সে, ভীরু নয়-পলাতক, কোন ভালবাসা বাঁধেনি যাকে,
বলেছিল মেলেনি হিসাব তার জীবনের লেনদেনে, পৃথিবীর উদ্যানে
অথচ তার চোখে কেন যেন মিনতি ভেসে ওঠে, আশ্রয় চায়
নির্লজ্জ বেড়াল, বার বার ঘোরে আশে পাশে, পালাবে আবার!
কিছুই নেয়নি সে, হারিয়েছে তার জীবনের সোনা, ছোঁয়না কিছুই
তাকে, তবু তার চোখ স্থির হযে থাকে আধেক আলোয় আর
আধেক আঁধারে, সন্ধ্যার আলো নিভে গেলে, হারায় সে
দৃষ্টির বাইরে, অন্য আলোয় অথবা সোঁদামাটির গন্ধ ভরা
অন্য কোন পথে বা নগর-বন্দর-আরো বহুদূরে, সূপর্ণর মতো উড়ে।


আসেনি সে বার বার, কদাচ সাক্ষাৎ তার, অল্প কিছু সময় ধরে
সে আসে আমার ঘরে, একবার কি দুইবার, কোন এক ভর দুপুরে,
কার্তিকের শেষে, কায়ক্লেশে; চোখে তার দূর সমুদ্রের হাহাকার, আর আসে
বহুদিন পর পৌষের শেষ বিকেলে ধূসর চিলের মতো, ক্লান্ত ডানা মেলে,
ঠোঁট দিয়ে স্খালন করে দূর পাড়ির কায়ক্লেশ, তার চোখ স্থির অর্ধমিলিত,
জিজ্ঞাসা করি, ‘‘কেন ফিরে আসেন?’’ মুখোমুখী বসে, যেন ট্রেনে,
এপাশের আসনে আমি-ওপাশে সে- যেন ধ্যানমগ্ন কোন সন্যাসী তপোবন ফেরা,
জবাবহীন দিশেহারা পাখি, মুখে নেই কথা, কোনো; তবু আবার
প্রশ্ন করি অন্ধকারের দিকে ফিরে,‘‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’’
আধো আলোছায়া ঘেরা ঘরে, অস্পষ্ট আলোয় ভর করে তাকায় সে,
সহস্র বছরের পরিশ্রান্তি প্রতিচ্ছায়া হয়ে ঘিরে আছে তাকে, উত্তরহীন
বয়ে যায় সময়ের হাওয়া শহরের পথে, মৃদু হাসি বিব্রত হওয়া,
নিভে যায় আশার প্রদীপ, বাতাসের শিস যেন বলে,‘‘ কত পথ ঘুরে,
কাছে-দূরে, তৃষ্না মেটাবার জল খুঁজেছি, পেয়েছি? না, জলপিপি এই আমি
পেয়েছি এখানে জলের ঠিকানা, উষ্ন কোমল জলে গভীর সাঁতার
দিয়েছি যতবার, শান্তির হিমেল স্পর্শ পেয়েছি এখানে এসেই,
ভুলে যাই সংসার, মুছে যায় জাগতিক আনা-কড়ি-পাই,
হিসেবের যত কথকতা,’’ মনে হয় তার চোখ বলে ‘‘তুমি তো সেই বনলতা।’’

ঘরে ফিরি, সারাদিন কত শত প্রেমের মহড়া, সুন্দরের ঝকমারি
আমি কি পারি? ধুয়ে মুছে অপারগতার যত কাদা, পারতেই হয়,
ধীরে ধীরে পটু হই শিল্পীর অপলক চোখে, স্থানুর মতে বসে থাকা।
গড়ে ওঠে উর্ব্বশীর দেহ, শ্বেত পাথরের বুক চিরে, মৃত্তিকার শরীর
নতুন ভাষা পায়, নতুন বাঙ্ময়তা, চেয়ে দেখি আর নিমজ্জিত হই
কোথাকার জল কোথায় গড়ায়, কোন সে নদী- মহানন্দা, আত্রাই,
তুলসী গঙ্গা, নারদ, গড়াই বা হোজা, নাকি বিল চলনের নারী
পাথর প্রতিমা হয়ে বসে থাকি, রূপ নারায়নের তীরে, অপ্সরী।
পড়ে থাকি স্থির সময়ের আস্তিন ধরে, বুকে চলনের ঢেউ সফেন
আমাকে নতুন নামে ফিরে ফিরে ডাকে ‘‘নাটোরের বনলতা সেন’’।


এস, এম, আরশাদ ইমাম//২৫ জুলাই ২০১৫; শনিবার; ১০ শ্রাবণ ১৪২২//ঢাকার জীবন