চায়ের কাপেতে ঝড়, চলে তুমুল দীর্ঘকাল, কাপ পেরিয়ে উপচে পড়ে ট্রেতে
ধোঁয়া ওঠা কাপের দেহে, বিন্দু বিন্দু শিশির জমে, নিথর পড়ে থাকে অপানেতে
ও পাশের চেয়ারের মুখে ক্রমে ক্রমে ধৈর্য্যচ্যুতি, স্থিরতার কাছে মাথা নোয়,
আরও আলাপ নয়, সংলাপ প্রলাপও নয়, সাধারণ কথা-বার্তাও নয়।
কথা ছিল আলাপ হবে, দু’জনের দ্বি-মূুখিতা গরম কাপে কফির মেজাজ
কার সে কথায় যেন, আজকাল মাঝে মাঝে, মেজাজটায় চৌরঙ্গী সাজ,
আর কোন কথা হয় না, জুড়িয়ে যায় সব উত্তাপ-কথা নেই, চা কিংবা কফি,
তুমি আমি মুখোমুখি, মুছে যাবে এই ছবিও, এক সময় ছিলাম পাশাপাশি।


তখন ছিল অস্থির দিন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, চারদিকে ভয়ানক ক্রোধ
আমি নব-পরিণীতা, তোমার কোলে মায়া মাখা, ভরে ছিল দু’শিশু অবোধ
চিঠি এলো তোমার কাছে, ‘যুদ্ধে নেমেছি আমি, চলে এসো-বাহকের সাথে’;
সিদ্ধান্ত নিতে তুমি দ্বিধায় পড়োনি মোটে, ফিরিয়ে দিয়েছ বার্তাটাকে।
এদিকে আমার দশা, ঘরেতে আবদ্ধ থাকা, হাত-পাও যেন আটকে রাখে
সৈনিক রাইফেল হাতে প্রাচীরের বাইরে, ছাদে, সারাক্ষণ প্রহরায় থাকে।
তুমি গেলে নিরাপত্তার- জলপাই চাদর তলে, গভীর প্রকোষ্ঠে সজ্ঞানে
আমি থাকি খাঁচাবন্দী, এ শহরে এক ঘরে, পরিবারের সঙ্গে অভিজ্ঞানে।


যুদ্ধের দামামা থামে, মেঘ কেটেছে একেবারে, জেগে ওঠে স্বাধীন সকাল
দলবেঁধে পাকি সেনা, মাথায় নিরস্ত্র হাত, রেসকোর্সে বিহারী বামাল
আত্ম সমর্পণ করে, পাকি সেনা ধরা পড়ে, আমরা পাই মুক্ত স্বদেশ
তোমার নতুন দশা, পাকি সেনাগৃহ ফাঁকা, তখন তুমি হারাও গৃহ-বেশ;
তোমার পুত্রের পিতা, পড়েছে ভগবৎ গীতা, নেবেনা সে এমন এক দয়িতা
বিপন্ন তোমাকে দেখি একদিন আমাদের ঘরে, পুত্র সাথে; মাননি সংহিতা।
যোদ্ধা সেনানী মন, সহজে কি পোষ মানে, পিতা তাকে কতনা বুঝান
তোমাকে তৃতীয় মেয়ে, সম্মান দিয়েছেন তিনি, ফিরিয়ে দেন হারানো অঙ্গন।
তোমার ছেলের পিতা, রেখেছে কথার মান, এক পাও নড়েনি তা থেকে
সংসার সচল হলো, সুন্দর মুখর হলো, সে কথাকি তোমার মনে থাকে?


পাকিস্তানী সৈনিক-মন, গুপ্ত ক্রোধাগ্নি মনে, বাঙ্গালী মনন তা বোঝে না
আগুন দাবানল হয় মাঠ-ঘাট-বন জ্বলে, কেউ আগুনে রেহাই পাবে না।
কালো রাতে অন্ধকারে রাইফেল গর্জন করে, বত্রিশ নম্বরে মহামারী,
বিদেশ-বিভূঁই-এ প্রাণ বেঁচেছি আমরা দু’বোন, তুমি পাশ আমি ফেল করি,
আশ্রয় নাই, খাদ্য নাই, পরিচয়ে সাহায্য নাই, সম্মুখে জগত অচেনা,
শুনেছি তোমার পাতে, সম্রাজ্ঞী যেমন থাকে, রাজ-খানাও মুখে রোচে না।
কোনদিন মেট্রো-ট্রেনে, বুকেতে পাথর চেপে, ছুটে গেছি এখান-ওখান
বিদ্যা চাই, চাকরী চাই, বেঁচে থাকার উপায় চাই, লন্ডন অথবা নৈনিতাল।
স্বদেশে বিরুদ্ধ স্রোত, চেতনায়, যাতনায়, সব কিছু চলে উল্টোরথে
রক্ত গড়াতে থাকে, সিঁড়ি বেয়ে সিক্ত মেঝে, শুকিয়ে রেখেছে কতকাল,
পোকার উৎসব চলে, খাট-পালঙ্ক, বই-পোষাকে, সেভেন-আপ স্তব্ধ নাকাল।


একাত্তর না সতের আর পঁচাত্তর না সাতান্ন, সেসব নিয়ে গবেষণা রোজকার
আমার আস্তিন খুঁড়ে, পঙ্কজ উঠেছে ফুঁড়ে, দেখি খুনী পায় পুরস্কার।
তবুও ফিরেছি দেশে, অক্লান্ত সে কায়-ক্লেশে, জিয়ারতও হয়নি আব্বার
ফুটপাতে বিস্রস্ত বসে, বিধ্বস্ত বত্রিশ দেখে, বুঝি আমি ভাগ্যবান সেবার।
জনগণ ঝিমাতে থাকে, একাত্তর মর্চুয়ারিতে, দল নেই আসে হাঁ-না ভোট
সব ভোট এক ঘরে, উর্দিরাজ শাসন করে, নারায়ে তাকবীররা একজোট
খাল কাটার মহান ডাক, গ্রাম সরকার জিন্দাবাদ, ঘরে টিভি, লাখোপতির গান
মানি ইজ নো প্রব্লেম, আ’উইল মেক পলিটিকস্‌ ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ান।
অর্থকড়ি সহজ হয়, ঘাড়ের উপরে বাড়ী, রাজনীতিটা শুধুই খাবি খায়
কঠিন মাটির বুকে, পা রেখেছি ধীরে ধীরে, যেদিকে যাই পাথর সময়।


এমন সময়ে এসে সাহস জোগাবে কে সে, তুমি তখন রাজ-রাজশ্রীময়;
তোমার ছেলের পিতা ত্রাসের শাসনে দেশ, চারিদিক শুধু তুমিময়।
উড়াল পঙ্খী তুমি, বিদেশের সফর সঙ্গী, উড়ে যাচ্ছ বাড়িয়ে যাচ্ছ শোভা,
তখন আমার বুকে রক্তের দাগ শুকিয়ে জেগে উঠছে ক্ষীণ মরুপ্রভা।
মরুপ্রভা আলো ছড়ায়, হোক তা অচেনা খুব, আলো তবু আঁধার দূর করে
রাতের রাইফেল ফের গর্জে ওঠে আরেক রাতে, ঢাকার রক্ত চাটগাঁতে ঝরে।
আমি ফেল তুমি ফেল, নতুন এক মাদারীর খেল, সমতলে জীবনটা এগোয়
আষাঢ় শ্রাবণ শেষ, প্রাণ ফিরে পায় মৃত্তিকা, অগণন সে শতদল ফোটায়।


এস, এম, আরশাদ ইমাম//অবিনাশী সময়
২১ আগষ্ট ২০১৫; শুক্রবার; ০৬ ভাদ্র ১৪২২; ঢাকা।