*******************************************


ইদানিং চোখটা বড় টাটাচ্ছে, চোখের এক পাশের মাংশপেশী
ফুলে ওঠে বার বার, পানি ঝরে, তিনি চেপে চেপে
সরান মাংসের তাল, জরাজীর্ণ রূমালে মোছেন পূঁজ মাখা পানি
এখন ভোর, এসকেলেরেটরের বাহু ধরে ধীরে ধীরে
নামতে থাকেন মেগাপলিস শহরে, আদালতটা আর কত দূরে!
পথ ক্লান্তি পিছু ছাড়ে না, তার, ঝাপসা চোখের সীমানা
অন্ধকার, কেশহীন চকচকে খুলি ঢেকে রাখেন
বারান্দা-অলা চৈনিক টুপীর আড়ালে
দীর্ঘ পথের শেষে ক্লান্তিতে খুক খুক কাশেন, একা চলমান সিঁড়িতে।


চোখের সামনে এ শহর কতটা বদলে গেল!
সেই যে করে গ্রেনেড ছুঁড়েছিলেন চারতলার উপর থেকে
কী কাব্যিকতায়, একেবারে হাসিনার উপরে,
হতভাগীর হতটা হত হলো, ভাগ্যটা উৎরে গেলো দীর্ঘজীবিতায়।
ষাটের সেই জিন্নাহ্‌ এভিনউ একাত্তরের পর বদলে গেল;
জিন্নাহ্! আহ্‌ কী পরম মখমল মোলায়েম নাম,
কী দরকার বদলানো, থাক, কে শোনে কার কথা,
পাকিস্তান যে কুপোকাত, বঙ্গবন্ধু এভিনউ হলো তার নাম; ছ্যা!
আশপাশের ক্ষুদে ক্ষুদে প্রাদেশিক দালান হয়ে উঠল
চব্বিশ তলার হাইরাইজ, সুনিপূণ নিরাপত্তায় জোড়া নাম
গুলিস্তান সিনেমা হয়ে উঠল সিনে মাল্টিপ্লেক্স
ঘোড়া গাড়ীর টক টক টক টক ছুটে চলা এখন
মিহি মসৃণ শব্দে রূপ বদল, গ্যাসোলিনের শক্তিতে
পিছলে চলা অত্যাধুনিক শকট, তিনি রয়ে গেলেন আস্ত মর্কট।


দু’হাজার একচল্লিশের উজ্জ্বল সকাল, নতুন মহাকাল
তিনি এখনো বযে চলেছেন দিনের পর দিন হজিরার ধকল
গায়ে দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা কোট, পরণে নিকৃষ্ট কৌপিন, কোটরাগত চোখ,
যদিও ছেলেটা বিভূঁইয়ে পাঠিয়েছেন, আছে বেশ, মাঝে মাঝে ডাকে,
‘‘চলে আসো বাবা, ছেড়ে ফেল পুরনো মামলাটাকে’’
‘‘না, আমি লড়ে যাবো, গড়ে যাবো বাংলাদেশ আমার আদলে’’
অথচ তাকে বার বার টান দেয় এ নগরের মাল্টিপ্লেক্স।
গ্রেনেড চত্ত্বর এখন কী দারুণ ঝকঝকে, পাশ দিয়ে এলিভেটেড একপ্রেসওয়ে
বেয়ে ছুটে চলে গাড়ী, ইলেকট্রিক মনোরেলের শীতাতপ কারের
কাচের ভিতর দিয়ে গর্বিত দৃষ্টিতে বাইরে তাকায় পরিচ্ছন্ন শিশুদল,
ভুল স্বপ্নে ডুবে যান তিনি ভবিষ্যতের উচ্ছিষ্ট সৃষ্টির মোহে।


সাথীরা উৎরে গেছে, ভুলে গেছে, ভুল স্বপ্নের পুনশ্চ বাগান,
তিনি পড়ে আছেন দু’হাজার চার সালের জরাজীর্ণ ঘেরাটোপে,
কেননা, তিনি ভুল স্বপ্নের কবি, সব খুইয়ে আঁকড়ে থাকবেন
বিকল চিন্তার, জড়তার, কুয়াশার বিকেল, রাশি রাশি লাশ
আর বিধ্বস্ত চত্ত্বর, ছেঁড়া চটি-পাটি, বিচ্ছিন্ন হাত-পা পোষাক
সৃজিত জঞ্জাল; ভুল শ্লোগান কন্ঠে ধরে স্খলিত স্বরের একদা বাচাল।


হাসিনা মরে গেছে, কবে, বড় হয়েছে কবরের গাছ
পদ্মার উপর দিয়ে ছুটছে রেলগাড়ী, তার কাছে ঠেকে বৈদ্যুতিক সরীসৃপ
মনে হয় ছোবল দিতে ছুটে আসছে তার দিকে
শির শির করে হাত-পা-মগজ; তিনি এড়িয়ে চলেন তাকে,
খুঁজে খুঁজে চাপেন ত্রিশ বছরের পুরোনো বাহনে, রাজধানীর পথে,
যদিও পথে পথে তাকে নতুন এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন অক্ষরেখা তাড়া করে।


শহরের বাইরে এক কালে যেখানে ছিল বিল-ঝিল, বেনোজল হ্রদ
সেখানে এখন নয়নাভিরাম লেক শোর সিটি, জীবনের সুনিপূণ গতি
নাগরিক জীবন সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখে, লেকের পাড়ে সান্ধ্য চলাচল।
সব কিছুকে ভুল মনে করে, উপেক্ষা করে, তিনি ফিরে যান গ্রামে
যেখানে রবি ঠাকুরের পদধূলি আর ছেউড়িয়ার লালনের দোতারা
এখনো কিংবদন্তী হয়ে আছে, তবু প্রাণে শান্তি আসে না যে!
এখনো তিনি কাঁধের রং জ্বলা, ক্ষয়ে যাওয়া চামড়ার এটাচি খুলে
চোখ কচলে দ্যাখেন তেরো লাইনের ধূসর পান্ডুলিপি,
‘‘এদেশের কিছুই হবেনা, এ হলো যজ্ঞরতি’’-বিচ্যুত স্বপ্ন-দর্শন বিকট ব্যঙ্গ করে।


ভুলে ভরা ভাবনা আর সিদ্ধান্তের অভিশাপে, নিজেকে হারিয়েছেন ভাগাড়ে
দু’হাজার একচল্লিশের এই সকালে মেট্রোরেলের এস্কেলেরেটরের বাহু ধরে
জীর্ণ শীর্ণ দেহে নামতে নামতে স্থবির মগজ কত কথাই মনে করে।।


এস, এম, আরশাদ ইমাম//অবিনাশী সময়
১৯ অক্টোবর ২০১৫; সোমবার; ০৪ কার্তিক ১৪২২//ঢাকা।


*************************************************


বিঃ দ্রঃ এক ভুল কবির ভ্রষ্ট ভাবনার প্রকৃত তরজমা।