কবি তাঁর কবিতায় নানা নারীর নমোল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে সুদর্শনা, সুরঞ্জনা, শ্যামলী, শঙ্খমালা, সবিতা প্রমূখের নাম, এরা সবাই যেন কবির একেকটি মুহূর্ত বা কয়েকটি মুহূর্তের প্রতিনিধি, সবার সঙ্গেই তাঁর জানাশোনা। কিন্তু আকর্ষণ? কবির অমোঘ আকর্ষণ কেবল ‘‘বনলতা সেন’’ এর প্রতি। এটার প্রকাশ পাই আমরা কবির এ কবিতার ইংরেজী অনুবাদ বা ভার্সন থেকে। এ অনুবাদ কবি নিজেই করেছিলেন। অনুবাদের বা ইংজেী ভার্সনের কবিতাটি এ রকমঃ


.............................
.............................
At moments when life was too much a sea of sounds,
I had Banalata Sen of Natore and her wisdom.
.............................
.............................
Never twice saw the earth of grass before him,
I have seen her, Banalata Sen of Natore.
.............................
.............................
...........Light is your wit now,
Fanning fireflies that pitch the wide things aroun
For Banalata Sen of Natore.


বনলতা সেন কবিতাগুলির রচনাকাল ১৩৩২-৪৬ বাংলা সাল, ১৯২৫-১৯৩৯ খ্রীষ্টাব্দ।


কে এই বনলতা সেন?


কৈশোরে বরিশালে জীবনে হয়তো কবি কোন এক পল্লী নারীর প্রথম প্রেমের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। সেটা ছিল তার ১ম অথবা একমাত্র ভালবাসা বা প্রেম। এই বনলতা সেনকে কবি একদিনে তৈরি করেন নি। এই এক ছবি বা বনলতার সারাটি জীবন বা তার সঙ্গে তার যাপিত জীবনকেই তিনি যেন তার কবিতায় তুলে ধরেছেন, ভিন্ন ভিন্ন নামে, বর্ণনায়, উপমায়, তুলনায় এবং ঐতিহাসিকতায়। আর সুদর্শনা (৬/পৃঃ১৬২/সুদর্শনা), সুরঞ্জনা, শ্যামলী, অরুণিমা স্যান্যাল (৬/পৃঃ১৫৭/বুনো হাঁস) শঙ্খমালা (৬/পৃঃ১৫৮/শঙ্খমালা), শেফালিকা বোস (৬/পৃঃ১৬১/হরিণেরা), সবিতা এরা সবাই যেন বনলতা সেন-এর একেকটি মুহূর্ত বা কয়েকটি মুহূর্তের প্রতিনিধি। কেননা, সবার সঙ্গেই কথক হিসেবে কবির জানাশোনা; অথবা এগুলো কবির অমোঘ আকর্ষণ-‘‘বনলতা সেন’’ -এর সঙ্গে অতিবাহিত বিশেষ বিশেষ মুহূর্তের পৃথক পৃথক চিত্র বা খন্ড চিত্র; যেন একেকটি দিন বা একেকটি সাক্ষাতের বা মুখোমুখী হবার প্রতিচিত্র। সবই যেন এক সেলুলয়েডের এক একটি মুহূর্ত, একত্রেও চালনা করলে পাওয়া যায় একটিই ছবি-আর কেউ নয়- শুধু ‘‘বনলতা সেন’’। পূর্ণ কিন্তু পরিণতিহীন সে প্রেম, কখনো সমাজ, কখনো নিজের ঘোর, কখনো দুরত্ত্ব কবির থেকে বনলতাকে দূরের করে দিয়েছে। বনলতা যেন আর কবির হয়ে ওঠেননি। সময়ের যুপকাষ্ঠে বলী হয়ে বনলতা যেন দূর নক্ষত্র হয়ে যায়, দেখা যায়, কিন্তু ছোঁয়া যায় না, জানা যায় কিন্তু ধরা যায় না, অবিরাম ধারার ভালবাসা কিন্তু কোথায় যেন একটি বাধা। অথবা পীড়ন-ব্যবধান সৃষ্টির (বিচ্ছেদের) পর হতে বাকীজীবন যেন চলেছে রোমন্থনের খেলা। বনলতাকে কবি নির্মাণ করেছেন তাঁর লেখার একেবারে প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত।


কবির প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘‘ঝরাপালক’’ এ আমরা এই বনলতাকেই পাই, নানা রূপে, নানা ভাবে, ছড়ানো-ছিটানো, সাজানো, আঁকানো। পাই, কিন্তু বেনামে, ভিন্ন নামে, অথবা নামহীনভাবে। মূলতঃ এ কাব্যগ্রন্থেই কবিকে দেখি কবিতার মাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরছেন, আত্ম-পরিচয় এবং বনলতার ইতিহাস বিধৃত করে গল্প-কাহিনী বা ইতিহাস পাঠে পাঠককে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। কবি শুরু থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত নিজেকে সর্বাঙ্গে প্রকাশ করেছেন এবং বনলতাকে গ্রন্থ প্রকাশকাল পর্যন্ত উপস্থাপন করেছেন। কবিকে এর পরের কাব্যগ্রন্থগুলোতে বনলতা সেন এর অবিশিষ্ট জীবন তুলে ধরেছেন। প্রেমের অধিকাংশ কবিতায় কবি এই বনলতাকেই দেখিয়েছেন পাঠককে। এ গ্রন্থের (ঝরা পালক/পৃঃ৩) প্রথম কবিতার নাম ‘‘আমি কবি,-সেই কবি’’-নামের মাধ্যমে সাধারণ কিছু বর্ণনা নয়, বিশেষ কিছুকেই যেন নির্দেশ করছেন। বলছেনঃ


                আমি কবি সেই কবি
আকাশে কাতর আঁখি তুলি হেরি ঝরা পালকের ছবি!
আনমনা আমি চেয়ে থাকি দূর হিঙ্গুল মেঘের পানে!
মৌন নীলের ইশারায় কোন্ কামনা জাগিছে প্রাণে!
বুকের বাদল উঠিছে উথলি কোন্ কাজরীর গানে!
দাদুরী কাঁদানো শাঙন দরিয়া হৃদয়ে উঠিছে দ্রবি!


                স্বপন সুরার ঘোরে
আখের ভুলিয়া আপনারে আমি রেখেছি দিওয়ানা করে!
জনম ভরিয়া সে কোন হেঁয়ালী হলনা আমার সাধা
পায় পায় নাচে জিঞ্জির হায় পথে পথে ধায় ধাঁধা!
-নিমেষে পাশরি এই বসুধার নিয়তি মানার বাধা
সারাটি জীবন খেয়ালের খোশে পেয়ালা রেখেছি ভরে!


এই কবিতার শেষ অনুচ্ছেদে কবি বনলতার পরিণতিকেই যেন এঁকেছেনঃ


                বিজন তারার সাঁঝে
আমার প্রিয়ের গজল-গানের রেওয়াজ বুঝি বা বাজে!
পড়ে আছে হেথা ছিন্ন নীবার, পাখীর নষ্ট নীড়!
হেথায় বেদনা মা-হারা শিশুর, শুধু বিধবার ভীড়!
কোন যেন এক সুধূর আকাশে গোধূলিলোকের তীর
কাজের বেলায় ডাকিছে আমারে, ডাকে কাজের মাঝে।


এ কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা ‘‘সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়’’ (পৃঃ৫১/৫২) এ কবি বলছেনঃ


                কেটেছে যে নিশি ঢের,—
এত দিন তবু অন্ধকারের পাই নি তো কোনো টের!
দিনের বেলায় যাদের দেখি নি—এসেছে তাহারা সাঁঝে;
যাদের পাইনি পথের ধুলায়—ধোঁয়ায়—ভিড়ের মাঝে,—
শুনেছি স্বপনে তাদের কলসী ছলকে, কাঁকন বাজে!
আকাশের নীচে— তারার আলোয় পেয়েছি যে তাহাদের!


                চোখদুটো ছিল জেগে
কত দিন যেন সন্ধ্যা-ভোরের নট্‌কান–রাঙা মেঘে!
কত দিন আমি ফিরেছি একেলা মেঘলা গাঁয়ের ক্ষেতে!
ছায়াধূপে চুপে ফিরিয়াছি প্রজাপতিটির মতো মেতে
কত দিন হায়!— কবে অবেলায় এলোমেলো পথে যেতে
ঘোর ভেঙে গেল,— খেয়ালের খেলাঘরটি গেল যে ভেঙে।


                দুটো চোখ ঘুম ভরে
ঝরা ফসলের গান বুকে নিয়ে আজ ফিরে যাই ঘরে!
ফুরায়ে গিয়েছে যা ছিল গোপন,—স্বপন কদির রয়!
এসেছে গোধূলি গোলাপীবরণ,—এ তবু গোধুলি নয়!
সারাটি রাত্রি তারাটির সাথে তারাটিরই কথা হয়,—
আমাদের মুখ সারাটি রাত্রি মাটির বুকের 'পরে!


এ যেন বনলতা ও তার সাথে কবির সারা জীবনের পদাবলী। এখানে একটি তারা যেন বনলতা , আর আরেক তারা যেন কবি স্বয়ং। এভাবে এ গ্রন্থে কবি যেন বনলতা ও কোন এক কিশোরের কৈশোর থেকে ক্রমে যুবা হয়ে ওঠা এবং যুবা অতিক্রম করে জীবনের ক্লাইমেক্স এ দিকে প্রবল দিক নির্দেশ করেছেন। আর যে নারী কি না বয়সে কবির চেয়ে কিঞ্চিত বড়। কবির ‘‘ঝরা পালক’’ কাব্য গ্রন্থেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ গ্রন্থের দু’টি কবিতায় এ বিষয়টি মূর্তমান। কবিতা ‘‘কিশোরের প্রতি’’-তে কবি বলছেন-


            বক্ষে তব নাচেনিকো যৌবনের দুরন্ত জলধি;
            শূল-তোলা শম্ভুর মতন
            আস্ফালিয়া উঠে নাই মন
মিথ্যা বাধা-বিধানের ধ্বংসের উল্লাসে!
            তোমার আকাশে
দ্বাদশ সূর্যের বহ্নি ওঠেনিকো জ্বলি
কক্ষচ্যুত উল্কা-সম পড়েনিকো স্খলি,
কুজঝটিকা –আবর্তের মাঝে
অনির্বাণ স্ফুলিঙ্গের সাজে!


এ হলো কিশোরের বয়স ও শারীরিক অবস্থার কথাচিত্র-বর্ণনা। কবির এই কাব্যগ্রন্থভুক্ত অপর কবিতা ‘‘অস্তচাঁদে’’ কবিতায় (পৃঃ/২২) পাই নারীর বয়স আর পরিপক্কতার সন্ধান। এ কবিতায় কবি নারীর বয়সসহ সবি’ যেন বলে দিয়েছেন। এ যেন বনলতার জীবনের প্রথম অধ্যায়ঃ


নটীরা ঘুমায়েছিল পুরে পুরে, ঘুমের রাজবধূ-
            চুরি করে পিয়েছিনু ক্রীতদাসী বালিকার যৌবনের মধু!
সম্রাজ্ঞীর নির্দয় আঁখির দর্প বিদ্রূপ ভুলিয়া
            কৃষ্ণাতিথি-চাঁদিনীর তলে আমি ষোড়শীর উরু পরশিয়া
লভেছিনু উল্লাস-উতরোল!-আজ পড়ে মনে
            সাধ-বিষাদের খেদ কত জন্মজন্মান্তের, রাতের নির্জনে!


নীল জানালার পাশে-ভাঙা হাটে-চাঁদের বেসাতি।
চুপে চুপে মুখে কার পড়েছিনু ঝুঁকে!
ব্যাধের মতন আমি টেনেছিনু বুকে
কোন্ ভীরু কপোতীর উড়ু-উড়ু ডানা!
-কালো মেঘে কেঁদেছিল অস্তচাঁদ-আলোর মোহানা!


বাংলার মাঠে ঘাটে ফিরেছিনু বেণু হাতে একা,
গঙ্গার তীরে কবে কার সাথে হয়েছিল দেখা!
‘ফুলটি ফুটিলে চাঁদিনী উঠিলে’ এমনই রূপালি রাতে
কদমতলায় দাঁড়াতাম গিয়ে বাঁশের বাঁশিটি হাতে!
অপরাজিতার ঝাড়ে- নদীপারে কিশোরী লুকায়ে বুঝি!-
মদনমোহন নয়ন আমার পেয়েছিল তারে খুঁজি!
তারই লাগি বেঁধেছিনু বাঁকা চুলে ময়ূরপাখার চূড়া,
তাহারই লাগিয়া শুঁড়ি সেজেছিনু-ঢেলে দিয়েছিনু সুরা!
তাহারই নধর অধর নিঙাড়ি উথলিল বুকে মধু,
জোনাকির সাথে ভেসে শেষরাতে দাঁড়াতাম দোরে বঁধু!
মনে পড়ে কি তা!-চাঁদ জানে যাহা, জানে যা কৃষ্ণাতিথির শশী,
বুকের আগুনে খুন চড়ে-মুখ চুন হয়ে যায় একেলা বসি!


বনলতা ও কবির এ প্রেম প্রণয়ের দেখা পেলেও পরিণতি পায়নি। কিন্তু মনোজগতে যে ছাপ ফেলেছিল, তার সারাজীবন প্রবাহিত হয়েছে ব্যক্তিজীবনে বা কবিতায়, এমনকি গদ্যেও। এজন্য তাকে (কবির বনলতাকে) পাওয়া যায় তাঁর উপন্যাসেও। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত ‘‘কারুবাসনা’’ উপন্যাসে তিনি এভাবে বনলতাকে এঁকেছেনঃ


‘‘কিশোরবেলা যে কালো মেয়েটিকে ভালবেসেছিলাম কোনো এক বসন্তের ভোরে, বিশ বছর আগে আমাদেরই আঙিনার নিকটবর্তী ছিল, বহুদিন তাকে হারিয়েছি-আজ সেই যেন পূর্ণ যৌবনের উত্তর আকাশে দিগঙ্গনা সেজে এসেছে।.........নক্ষত্রমাখা রাত্রির কালো দিঘির জলে চিতল হরিণীর প্রতিবিম্বের মতো রূপ তার।–প্রিয় পরিত্যক্ত মৌনমুখী চমরীর মতো অপরূপ রূপ। মিষ্টি ক্লান্ত অশ্রু-মাখা চোখ, নগ্ন শীতল নিরাবরণ দু’খানা হাত, ম্লান ঠোঁট, পৃথিবীর নবীন জীবন ও নবলোকের হাতে প্রেম, বিচ্ছেদ ও বেদনার সেই পুরোনো পল্লির দিনগুলো সমর্পণ করে কোন দূর নিঃস্বাদ নিঃসূয অভিমানহীন মৃত্যুর উদ্দেশ্যে তার যাত্রা।


সেই বনলতা-আমাদের পাশের বাড়িতে থাকত সে। কুড়ি বাইশ বছর আগের সে এক পৃথিবীতে: বছর আষ্টেক আগে বনলতা একবার এসেছিল। দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চালের বাতায় হাত দিয়ে মা ও পিসিমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বললে সে। তারপর আঁচলে ঠোঁট ঢেকে আমার ঘরের দিকেই আসছিল। কিন্তু কেন যেন অন্যমনস্ক নতমুখে মাঝপথে থেমে গেল, তারপর খিড়কির পুকুরের কিনারা দিয়ে, শামুক গুগলি পায়ে মাড়িয়ে, বাঁশের জঙ্গলের ছায়ার ভিতর দিয়ে চলে গেল সে। নিবিড় জামরুল গাছটার নিচে একবার দাঁড়াল, তারপর পৌষের অন্ধকারের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল।


তারপর তাকে আর আমি দেখিনি।


অনেক দিন পরে আজ আবার সে এল; মন পবনের নৌকায় চড়ে, নীলম্বরী শাড়ী পরে, চিকন চুল ঝাড়তে ঝাড়তে আবার সে এসে দাঁড়িয়েছে; মিষ্টি অশ্রুমাখা চোখ, ঠান্ডা নির্জন দুখানা হাত, ম্লান ঠোঁট, শাড়ির ম্লানিমা। সময় থেকে সময়ান্তর, নিরবচ্ছিন্ন, হায় প্রকৃতি, অন্ধকারে তার যাত্রা.....।’’


কবির জীবন সম্বন্ধে যেটুকু জানা যায়, তিনি ইন্ট্রোভার্ট প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। কিন্তু কোন নারী সংসর্গের বর্ণনা পাওয়া যায় না। কিন্তু একেবারে অন্তরঙ্গ মহলে কবি ছিলেন রসিক, অন্তঃশীল আনন্দে উদ্বেলিত। কবির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের এই দিকটি উন্মোচন করেন কবিপত্নী লাবণ্য দাশ, তাঁর বোন সুচরিতা দাশ এবং কবির ভ্রমণ সঙ্গী সুবোধ রায়। কবির মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী লাবণ্য’র লেখা ‘‘মানুষ জীবনানন্দ’’ নামের একটি বই প্রকাশ হয় ১৯৭১ সালে। এ থেকে জানা যায় যে, সব সময় তিনি (কবি)বই পড়তেন। বই-ই ছিল তাঁর আশ্রয়। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট অক্ষরে কি যেন লিখতেন মাঝে মাঝে। বাংলায়। লাবণ্য এলে লুকোতেন। এটা কবিপত্নীর পছন্দও ছিল না। আর তাই স্বামী যা লুকোবেন তা-ই যেন কেড়ে নিয়ে দেখা ছিল আঠারো বছরের মেয়েটির জেদ। কবির স্ত্রী তার বইয়ে এ রকম ঘটনা/খন্ড দৃশ্য তুলে ধরেছেন। এ দৃশ্যের ব্যাখ্যা ও মন্তব্যসহ কবির কবিতা ও ব্যক্তি মানসের একটি বর্ণনা আমরা কবি পত্নী এর লেখায় এভাবে পাইঃ


‘‘অনেকে বলেন তিনি নিপাট ভালো মানুষ, আত্মভোলা, কোনোদিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল না ইত্যাদি। এসব যখন শুনি, বা পড়ি, তখন আমার অদ্ভূত লাগে। কারণ ঐ ছবিতে (উপরে বর্ণিত, ‘‘ঝরা পালক’’ কবিতা গ্রন্থ সম্বন্ধে) আমার অচেনা ব্যাক্তিত্বহীন একজন সাজানো সৌখিন কবির তৈরি-করা ছবি দেখতে পাই। আমি ঐ ব্যক্তিত্বহীন জীবনানন্দকে সত্যিই চিনি না।আমার স্বামীর ছবি, আমার কাছে সম্পূর্ণ অন্য। তাঁর উদার মন ও ব্যক্তিত্বের জন্য জীবনে অনেকবার আমি অনেক সমস্যা থেকে উদ্ধার পেয়েছি মনে পড়ে।......’’


না, আমরা কবিকে তেমনভাবে ভাবছি না। কিন্তু তাঁর শৈশব বা কৈশোরের কোন এক তন্বী ষোড়শী তরুণী যে তাঁর নিবিড় সান্নিধ্যে আসেন নি, তা হলফ করে বলা যায় না, সেটাকে আমরা লাবণ্য’র দৃষ্টিতে না দেখে একজন চিরপ্রেমিকের জন্য প্রয়োজনীয় ও মার্জনার দৃষ্টিতে দেখব। এটুকু দুর্বলতা মানুষের থাকতেই হয়, না হলে তিনি মহামানব হয়ে যান। আমরা আমাদের প্রাণের কবিকে মহামানব করে আমাদের থেকে আলাদা করে ফেলতে পারি না, করবোও না।


কিন্তু তাঁর সমালোচকরাও কবিকে আক্রমণ করতে ভুল করেননি। তারা বলেন, কবি কবিতায় যেভাবে বনলতা সেন বা অন্যান্য নারীর সঙ্গ এঁকেছেন, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা না থাকলে তা আঁকা দুরূহ। কবি পত্নীর ভাষ্যেও কিন্তু সে রকম গন্ধভরা বাতাস শ্বাস ফেলে। তাই আমাদের মনে প্রশ্ন কবির প্রতি কবিপত্নী লেখায় যতটা ততটা বিনম্র ছিলেন, ততটা কি ছিলেন ব্যক্তি জীবনেও? জানা যায়, ১৪ই অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় কবি ট্রামের ক্যাচারে আটকে আহত হলে, এতে তার কণ্ঠা, ঊরু এবং পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গেলে গুরুতরভাবে আহত জীবনানন্দের চিৎকার শুনে ছুটে এসে নিকটস্থ চায়ের দোকানের মালিক চূণীলাল এবং অন্যান্যরা তাঁকে উদ্ধার করেন। তাঁকে ভর্তি করা হয় কলকাতার শম্ভূনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে। এ সময় ডাঃ ভূমেন্দ্র গুহ সহ অনেক তরুণ কবি জীবনানন্দের সুচিকিৎসার জন প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। কবি-সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাশ এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর অনুরোধেই পশ্চিম বঙ্গের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ও কবিকে দেখতে গিয়েছিলেন এবং আহত কবির সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যদিও তা কোন ফলাফল বয়ে আনেনি। কিন্তু কবির এ চরমতম সময় কবির স্ত্রী লাবণ্য দাশকে কদাচিৎ তাঁর কাছে দেখা যায়। জানা যায়, তিনি টালিগঞ্জে সিনেমার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। জীবনানন্দের অবস্থা ক্রমশঃ জটিল হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন কবি। চিকিৎসক ও সেবিকাদের সকল প্রচেষ্টা বিফলে দিয়ে ২২শে অক্টোবর, ১৯৫৪ তারিখে রাত্রি ১১ টা ৩৫ মিনিটে কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। আমরা জানি না কবি পত্নী তাঁর শেষ সময়ে তাঁর কাছে ছিলেন কি না ? কবির ব্যক্তি জীবনও কি বনলতা সেন-এর মতো অবহেলাপূর্ণ ছিল না ?


(আগামী পর্বে দেখুন)


এস, এম, আরশাদ ইমাম//অপর জীবন
১৫ নভেম্বর ২০১৫; রবিবার//ঢাকা।