তবে একটি প্রশ্ন থেকে যায়, তা হলো, কবি জীবনানন্দ দাশ বনলতাকে নাটোরে স্থাপন করলেন কেন?



বনলতা সেন কে নাটোরের প্রেক্ষাপটে কেন?


সঠিক জবাব আমরা জানি না। কেউ যে জানেন এমন তথ্যও জানা যায় না। নানারকম উপকথা বা কাল্পনিক ঘটনা পাই, নানা জনের ভাষ্যে। ইন্টারনেট ভ্রমণে এরকম অনেক অভাবিত গল্পের দেখা মেলে, কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর কোন লেখা থেকেই পাওয়া যায়নি। অন্ততঃ আমার নজরে পড়েনি। কেউ জানলে তথ্যসহ জানাবেন আমি এ প্রত্যাশা করি। প্রশ্নটি হলো, কবি জীবনানন্দ দাশ কি কখনো নাটোরে এসেছিলেন? ব্যক্তিগতভাবে আমার মত যদি বলি, জবাব হচ্ছে, হ্যাঁ, তিনি নাটোর ভ্রমণ করতেই পারেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমি এর কোন তথ্যভিত্তিক প্রমাণ বা ক্লু পাইনি। এ জন্য আমাদের এ উত্তর খুঁজতে সমসাময়িককালের ইতিহাসের দিকে একটু নজরপাত করতে হবে।


ক।


বনলতা সেন কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৯৩৫ সালের দিকে। কি ছিল তখন আমাদের সমাজ বাস্তবতা? ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকে যখন কলকাতা কেন্দ্রিক এক শ্রেণির নব্য-ধনিক সৃষ্টি হচ্ছিল তখন তাদের মধ্যে একটা নতুন অভ্যাস প্রবর্তিত হলো- সুরা, নারী ও রক্ষিতার ব্যবহার, নয়তো নিদেনপক্ষে বাইজীখানায় যাতায়াত। কলকাতা শহরে তখন বারাঙ্গণাদের সুরলহরী, অশ্রু-কান্না আর ‘‘বাবু’’দের (জমিদার, শহুরে ধনীক শ্রেণী, বণিক শ্রেণী) বিলাসী জীবন, মদ্যপান, নারীসম্ভোগ, বহুগামীতা ইত্যাদির চারণক্ষেত্র। নগর গ্রাম থেকে তুলে আনা অপরূপ দর্শন নারীদের শিল্প-কলা, সঙ্গীত ও নৃত্যকলায় পারদর্শী করা তোলা হতো ‘‘বাবু’’দের মনোরঞ্জনের জন্য উপযুক্ত করে তুলতে। বৃটিশ শাসনের মূল সময়কালে সারাদেশে ব্যবসায় বাণিজ্যের পসার ভালো ছিল। বাণিজ্যের কারণে যে কাঁচা পয়সার উদ্ভব ঘটে তার প্রভাবে কলকাতার একেকটা মিনি সংস্করণ গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্যবসায়িক কেন্দ্র, নৌবন্দর বা পোতাশ্রয়গুলোতে। বিভিন্ন নবাব জমিদারদের রাজ্যপাটকে কেন্দ্র করে।


নাটোর ছিল এমনই এক কেন্দ্র, কলকাতা থেকে উজানে রওনা হয়ে মালদা হয়ে বা অন্য যেসব নদীপথ আছে তার একটা বড় পথ ছিল পদ্মার এ পাশের বন্দর। এছাড়া ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজস্থান, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট অঞ্চলের সঙ্গে নদীপথে কলকাতা, রাজশাহী, নাটোর, টাঙ্গাইল ও ঢাকার যোগাযোগ ছিল। এই যোগাযোগের ফলে এই এলাকায় বাইজি’র আসর ও অপরাপর অভ্যাসের গোড়াপত্তন হয়।


ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজস্থান, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট রাজ্যে ‘বাঈ’ শব্দ দ্বারা ধ্রুপদী নৃত্য-গীতে পারদর্শী সম্ভ্রান্ত মহিলাদের বোঝানো হত। তারা খুব ছোট থাকতেই ওস্তাদদের কাছে তালিম নিয়ে নৃত্যগীত শিখতেন। শিক্ষা শেষে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত-নৃত্যকে পেশা হিসেবে নিলে লোকে তাদের ‘বাঈ’ শব্দটির সঙ্গে সম্মানসূচক ‘জি’ শব্দটি জুড়ে দিত, তখন তাদের নামে শেষে ‘বাঈজি’ শব্দটি শোভা পেত। বাঈজিরা সম্রাট, সুলতান, বাদশা, রাজা-নবাব ও জমিদারদের রঙমহলে শাস্ত্রীয় নৃত্যগীত পরিবেশন করে বিপুল অর্থ ও খ্যাতিলাভ করতেন। অর্থ আয়ের জন্য তারা যেমন বাইরে গিয়ে ‘মুজরো’ নাচতেন, তেমনি নিজেদের ঘরেও ‘মাহফিল’ বসাতেন। বাইজিদের নাচ-গানের আসরকে মুজরো বলা হয়, আবার তাকে মেহফিল বা মাহফেল বা মাহফিলও বলা হয়ে থাকে।


আঠারো শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলায়, বিশেষ করে কলকাতায় বাইজিদের আগমন ঘটতে থাকে।  মেহফিলে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অংশগ্রহণ ছাড়াও কোনো কোনো বাইজি রাজা-মহারাজা-নবাবদের দরবার থেকে নিয়মিত মাসিক বেতন পেতেন। বাইজিদের নাচ-গানে মোহগ্রস্ত হওয়ার কারণে কোনো কোনো নবাব-রাজা-মহারাজা বা ধনাঢ্য ব্যক্তির পারিবারিক ও আর্থিক জীবনে বিপর্যয়েরও সৃষ্টি হয়েছিল।


ঢাকায় বাইজিদের নাচ-গান শুরু হয় মুঘল আমলে। সুবাদার ইসলাম খাঁর দরবারে (সতের শতাব্দীর প্রথম পর্ব) যারা নাচ-গান করতেন তাদের ‘কাঞ্চনী’ বলা হতো। উনিশ শতকে ঢাকার নবাব নুসরাত জং, নবাব শামসুদ্দৌলা, নবাব কমরুদ্দৌলা এবং নবাব আবদুল গণি ও নবাব আহসানুল্লাহর সময় বাইজিদের নাচ-গান তথা মেহফিল প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। তারা আহসান মঞ্জিলের রংমহল, শাহবাগের ইশরাত মঞ্জিল, দিলকুশার বাগানবাড়িতে নৃত্য-গীত পরিবেশন করতেন। ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যেসব বাইজি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তাদের মধ্যে লক্ষনৌর প্রখ্যাত গায়ক ও তবলাবাদক মিঠন খানের নাতি সাপান খানের স্ত্রী সুপনজান উনিশ শতকের শেষ দিকে ঢাকায় ছিলেন।


১৮৭০-এর দশকে ঢাকার শাহবাগে নবাব গণির এক অনুষ্ঠানে মুশতারী বাই সংগীত পরিবেশন করে প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবদুল গফুর খানের নজরে পড়েছিলেন। ১৮৮০-এর দশকে শাহবাগে এলাহীজান নামে আরেক বাইজির নৃত্য ও করুণ পরিণতির দৃশ্য দেখেছিলেন হাকিম হাবিবুর রহমান। নবাব গণির দরবারে নাচ-গান করতেন পিয়ারী বাই, হীরা বাই, ওয়ামু বাই, আবেদী বাই, আন্নু নান্নু ও নওয়াবীন বাই। শেষোক্ত তিন বোন ১৮৮০-এর দশকে ঢাকার নাটক মঞ্চায়নের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ঢাকার অন্য খ্যাতিমান বাইজিদের মধ্যে ছিলেন বাতানী, জামুরাদ, পান্না, হিমানী, আমিরজান, রাজলক্ষ্মী, কানী, আবছন প্রমুখ। এছাড়া কলকাতা থেকে মাঝেমধ্যে ঢাকায় মুজরো নিয়ে আসতেন মালকাজান বুলবুলি, মালকাজান আগরওয়ালী, জানকী বাই, গহরজান, জদ্দন বাই, হরিমতী প্রমুখ।


একবার রাজার সভায় উপস্থিত হন স্বয়ং বিবেকানন্দ। সভায় একজন বাঈজী গান গাইবেন,  স্ত্রীলোক এবং বাঈজী বিবেচনায় বিবেকানন্দ গান শুনতে অস্বীকৃতি জানান, কিন্তু রাজার অনুরোধে গান শুনতে বসেন। বাঈজী গাইলেনঃ


          প্রভু মোর অবগুন চিতনা ধর
          সমদরশি হ্যায় নাম তোমার
          এক লহো পুজামে রহত হ্যায়
          এক রহো ঘর ব্যাধক পরো
          পরলোক মন দ্বিধা নাহি হ্যায়
          দুই কাঞ্চন করো।


গান শুনে বিবেকানন্দের চোখে পানি চলে আসে। এরপর সেই বাঈকে বিবেকানন্দ মা বলে সম্বোধন করেন।


মোস্তারী বাঈ শুধু সুরের জাদুতে বশ করতেন শ্রোতাদের। ১৮৭০ সালে ঢাকার নবাব আব্দুল গনির আমন্ত্রনে শাহবাগের বাগান বাড়িতে এসে গান গেয়ে মুগ্ধ করেছিলেন সে কালের বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক আবদুল গাফফার নাসকানকে। কলকাতায় তার গান শুনে আত্মহারা হয়েছিলেন রাঁইচাদ বড়াল, কৃষ্ণচন্দ্র আর কবি নজরুল ইসলাম। রেডিওতে মোস্তারী বাঈয়ের গান শুনে তখন ফোন করছিলেন রেডিও অফিসে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘‘এই দেবীকে কোন গন্ধর্বলোক থেকে নিয়ে এলে?’’


যারা মানুষের আনন্দের জন্য নিজেদের বিলিয়ে দিতেন সমাজ তাদের দিত নিত্য বঞ্চনা। এই বাইজী বা মেহফিল আয়োজনের আলোকোজ্জ্বল রূপের অন্তরালে আরেকটি কদর্য দিক ছিল ‘লালসা’। একটি ছোট উদাহরণ দিই। ইন্দোররাজ শিবাজী হোলকারের সভায় বিখ্যাত বীনাকার স্বয়ং বন্দে আলী খাঁ। বীনা বাজিয়ে সুরের ইন্দ্রজালে মুগ্ধ করেন সব শ্রোতাদের, শিবাজীর খাস নর্তকী চুন্নাবাঈ কিন্তু ছিলেন সেদিন মুগ্ধ শ্রোতাদের আসরে। খুশী হয়ে রাজা ইনাম দিতে চেয়েছিলেন বীনাকারকে। সুরমুগ্ধ রাজাকে চমকে দিয়ে বন্দে আলী খাঁ ইনাম হিসাবে চেয়ে বসলেন বাঈজী চুন্নাবাইকে।


এই সঙ্গীত ও নৃত্যকলার অন্তরালে পত্তন হয় পৃথিবীর আদিম ব্যবসায় যার নাম পতিতাবৃত্তি। বাংলা ও ভারতের অনেক বিখ্যাত শিল্পী ও কালাকার এক সময় নিষিদ্ধ পল্লীর বাসিন্দা ছিলেন। ঢাকার প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক চলচিত্র ছিল ‘দ্য লাষ্ট কিস’। এর নায়িকা ছিল লোলিতা। তাকে বাদামতলীর নিষিদ্ধ পল্লী থেকে নিয়ে আসা হয়। তার আসল নাম ছিল বুড়ী। সিনেমা তৈরীর সময়টাতে বুড়ীর বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। ছবির কাজ শেষে বুড়ী আবার পুরানো পেশায় ফিরে যায়। ‘দ্যা লাষ্ট কিস’ এর সহ নায়িকা চারুবালাকে আনা হয় কুমারটুলী পতিতালয় থেকে। জিন্দাবাহার লেন থেকে আনা হয় দেববালাকে।


খ। দীঘাপাতিয়ার রাজা ও নাটোরের পত্তন


এই নব্য সংস্কৃতির আরেক পীঠস্থান হয়ে ওঠে ‘নাটোর’। দীঘাপাতিয়ার রাজা খাজনা আহরণসহ প্রশাসনিক কারণে নাটোরের অদূরে এ আবাসিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। বর্তমানে নাটোর শহর যে স্থানে অবস্থিত পূর্বে স্থানটির নাম ছিল চন্দ্রাবতীর বিল। আবার এও বলা হয় যে, ছাইভাঙ্গা বিলের মধ্যে নাটোর রাজবাড়ী স্থাপিত। নাটোরের রাজা বাংলা ১১১৩ সালে জমিদারী লাভ করলে লষ্করপুর পরগনার তরফ কানাইখালী মৌজায় বর্তমান স্থানে রাজস্ব আদায় কাচারী ও বসতবাড়ী স্থাপন করেন। ইংরেজী ১৭০৬ সালে রাজা রামজীবন রায় চন্দ্রাবতী বা বর্তমানের চলন বিলের একটা অংশ ভরাট করে তার রাজধানী হিসেবে এ শহর প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর তা রাজশাহী জেলার শাসন কেন্দ্রে উন্নীত হয়।


‘‘এখন যেখানে নাটোর শহর ৩০০ বছর পূর্বে সেখানে প্রকান্ড বিল ছিল। সপ্তদশ শতকের শেষভাগে নাটোর বংশের আদি পুরুষ রঘুনন্দন এখানে তার বিস্তৃত রাজধানী স্থাপন করেন। তার জমিদারীকে রাজ্য বলতে দোষ নাই। কারণ সে সময় বাংলাদেশের অর্ধেকভাগ নাটোর রাজাদের অধীন ছিল’’ (‘প্রমথ নাথ বিশী’ জোড়া দীঘির চৌধুরী পরিবার পৃঃ ১৫)।
‘‘ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’’ হতে জানা যায়, পদ্মা নদীর তীরস্থ লালপুর থানা ব্যাতীত নাটোর মহকুমার প্রায় সমগ্র অংশ বিলময় জলমগ্ন নিম্নভূমি ছিলো এবং তন্মধ্যে বৃহত্তম চলনবিল (With the exception of the Lalpur thana situated on the Padma most of the subdivision is swampy depression water logged and abounding in marshes the larger of which is the Chalan Beel)।


ইংরেজী ১৭৯৩ হতে ১৮২৫ সাল পর্যন্ত রাজশাহী জেলার সদর সেখানেই স্থাপিত ছিল। ১৮২১ সালে নাটোরে স্বতন্ত্র মুহকুমা প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৮৪৫ সালে নাটোর মহকুমা এবং ১৮৬৯ সালে নাটোর পৌরসভা গঠিত হয়। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও এ শহরের বড় ভূমিকা ছিল।


মুর্শিদাবাদ বাংলার রাজধানী থাকাকালে নাটোরের যাবতীয় যোগাযোগ মুর্শিদাবাদেই চলত। পরে বাংলার রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তরিত হলে নাটোরের জমিদারী সংক্রান্ত সমুদয় কাজ সম্পাদনে কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। উনবিংশ শতকের মধ্যেভাগে নাটোর রাজপরিবারের একটি বাড়ী কলকাতায় স্থাপিত হয়। তখন হতে তিথি পরবে আমোদ প্রমোদের জন্য রাজা বা তাদের কুমাররা সময়ে সময়ে নাটোর আসতেন। অন্য সময় নাটোর থাকত রাজ কর্মচারীর তত্ত্বাবধানে। তবে জমিদারী সংক্রান্ত সকল কাজ নাটোরেই সম্পাদন করা হতো।


রাজারা ভ্রমণ বা রাজকার্য শেষে নাটোর ত্যাগ করলে কর্মচারীদের চরিত্রে দ্বিগুণ অবনতি ঘটে এবং রাজাদের আমদানী করা বাইজীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে নাটোর শহর উত্তর বঙ্গের কুখ্যাতি লাভ করে। তখন পতিতাদের বিশেষ বাধা না থাকায় রাজবাড়ীর চারপাশে ও সমৃদ্ধ পল্লীগুলি পতিতাদের অবাধ আশ্রমে পরিণত হয়। এমনও শোনা যায় যে, মদ-মত্ততায় উন্মত হয়ে লম্পটেরা অনেক অন্যান্য ঘরেও হানা দিত। আরও শোনা যায় নাটোরের জনসংখ্যার অনুপাতে শতকরা ৩০ জন ছিল পতিতা। নাটোরের এরূপ অবনতি দেখে বিখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী প্রমথ নাথ বিশি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘‘নরক দেখি নাই, তবে নাটোর দেখিলাম’’। এ হতে সহজেই অনুমিত হয় যে, ঐ সময় নাটোরের অবস্থা কেমন ছিল।


তখনকার জমিদারদের মধ্যে গণিকালয় নিয়ে প্রতিযোগিতার কথাও শোনা যায়। প্রত্যেক হিন্দু জমিদারের আশ্রয়ে বারাঙ্গনা বা পতিতা থাকত। রাজবাড়ীর চারপাশে তাদের জায়গা দেয়া হত। দীঘাপতিয়ার কেলি পুকুর (দীঘি) এজন্য কুখ্যাত। ঐ সময় এর চারপাশে ফুল বাগান ও প্রাচীর বেষ্টিত ছিল। এ পুকুরে স্থানীয় বড় বড় জমিদার ষোড়শীদের এনে বিবসনা হয়ে জলকেলি করত বলে কথিত আছে। পুঠিয়া- ঝলমলিয়া - লালপুর - ঈশ্বরদী  বিভিন্ন স্থানে এসব বারাঙ্গণাদের আবাস্থল গড়ে ওঠে। নাটোরের এই ‘নটী পাড়া’ বা ‘নটীর শহর’ থেকেই ‘নাটোর শহর’ বা ‘‘নাটোর’’ নামের উৎপত্তি (রাজশাহীর ইতিহাস ২য় খন্ড পৃঃ ১০৯/কাজী মোঃ মিছের আলী)। তবে দীঘাপাতিয়ার রাণী ভবানী জনদরদী ছিলেন, ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু আদিম ব্যবসার চলন বন্ধে তার ব্যবস্থা নেয়ার কোন নজীর পাওয়া যায় না। অবশ্য নাটোর রাজ্যের দৌলতে রাজশাহীবাসী গৌরবান্বিত। গর্বিত নাটোর জেলাবাসী। এত কুখ্যাতি সত্বেও নাটোর রাজা মাহারাজাদের দান পুণ্য করেছে খ্যাত নাটোরকে।


রেল-বন্দর-কারখানা আর ব্যবসা সবখানে বণিক, ব্যবসায়ী, মজুর-কুলি, গৃহহীন ও সংসার-বর্জিত মানুষের বিনোদন আর জমিদার মহারাজাদের বিনোদন তো আর এক হতে পারে না! একটি হবে শিল্পীত, অন্যটি হবে অশিল্পীত। একটি হবে কাম-ঘাম-শ্রম জর্জরিত, অন্যটি হবে কাম-অবদমিত, পরিশীলিত। কিন্তু কামনার কামধেনু কিন্তু স্বতেজে বহমান। কেউ দ্যাখে মাংস, শরীর আর অবগাহন, আর কেউ দ্যাখে ন্যুড, জলভরা কলস আর পাখির নীড়ের মতো চোখ। সে কী স্ত্রী! সে কী ভগ্নী, সে কী মাতা? নাকি কন্যা? না, এসব কিছুই না, কেবল নারী। নদীর মতো রহমান, স্রোতস্বিনী। পুরুষ তার কাছে যাবেই, ফিরবেই, ক্লান্তি মোছার জন্য, স্বস্তি-শ্রান্তি খোঁজার জন্য, নিজেকে একটু ভুলে থাকবার জন্য, আর না হয় অতি শিল্প চোখ হলে ন্যুড স্টাডি’র জন্য-আর কিছু নয়, তবুও তো নারীর নিরাভরণ শরীর।


পশ্চিমে বরেন্দ্র অঞ্চলের তাপদাহ, দক্ষিণে পদ্মার ভাঙ্গন আর চলন বিলের বিশাল সম্ভার বিবেচনায় রেখে নাটোরে রেল কমিউনিকেশনকে বিবেচনায় রেখে একটি বর্ধিঞ্চু বন্দর নগরী গড়ে ওঠে এখানে। এছাড়া বড়াল, নারদ, হোজা, আত্রাই প্রভৃতি নদী এ বিলের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এ এলাকাটি ভৌগোলিক কারণে বেশ স্ট্রাটেজিক গুরুত্ত্ব অর্জন করে। নাটোরে একটি নগর পত্তন করা হয়। নগরে আসে নাগরিক, শ্রমিক, দালাল, বণিক ও হাজার পদের মানুষ। শহর তত বড় নয়, পরিবার নিয়ে থাকার ব্যবস্থা নাই, কাজের অবসরে চাই বিনোদন। গড়ে ওঠে কলকাতার মতোই ক্ষুদে বিনোদন ক্ষেত্র।


গ। ব্যবসায়ের কেন্দ্রস্থল


ঈশ্বরদী স্থানটি বর্তমানে লালপুর থানা ২নং ঈশ্বরদী ইউনিয়ন নামে পরিচিত। এখান হতে কলকাতাগামী যা্ত্রীরা রেলপথে সাঁড়া ঘাটে গিয়া ষ্টীমার যোগে পদ্মা নদী পার হয়ে দামুকদিয়া স্টেশন থেকে কলকাতা যাত্রা করত।


এছাড়াও মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গী থানা হতে নদীপথে মালবাহী ও যাত্রীবাহী ষ্টীমার গুলি লালপুর ঘাটে বিলমাড়িয়া কালীদাসখালী ইত্যাদি ষ্টীমার ঘাট ব্যবসা বাণিজ্যে উন্নত হয়ে ওঠে এবং পদ্মা নদী ও চলনবিল অঞ্চলে ঠগী বা গামছা মোড়া জলদস্যুদের অত্যাচারের ফলে ১৮২৭ সালে লালপুর  একটি পুলিশ ফাঁড়ি বসানো হয়। এবং ১৮৬৫ সালে বৃটিশ শাসক স্যার লর্ড লরেন্স এর শাসন আমলে লালপুর থানা প্রতিষ্ঠা হওয়ার কথা জানা যায়।( বৃটিশ সরকারের ১৬৯৫তাং ১১-০৩¬-১৮৬৯ স্মারক অনুসারে (GAZEtte Notification) লালপুর থানার জন্য স্থান Aquire বা অধিগ্রহন করা হয়।)


নাটোর ছিল ব্রিটিশ রেলপথ, একাধিক নদীপথ ও বহত্তর বিল চলনবিল দ্বারা সংযুক্ত এবং চলনবিলের মাঝামাঝি অপেক্ষকৃত উঁচু, যা বরেন্দ্র অঞ্চলের রুদ্র প্রকৃতির কাছাকাছি হলেও সে প্রকৃতি হতে বিচ্ছিন্ন অপেক্ষাকৃত উত্তম বাসোপযোগী অঞ্চল এবং নদী, সড়ক ও রেলপথ দ্বারা রাজশাহী ও পার্শ্ববর্তী ব্যবসায় সহায়ক জনঅঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এ অঞ্চলটি বরেন্দ্র অঞ্চলের মতো উষর নয় এমন জনপদ, যা ভৌগোলিক কারণে ক্রমশঃ গুরুত্ত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।


নাটোরের সংযোগ ছিল বড়াল নদী দিয়ে যমুনার সঙ্গে পদ্মার। বড়াল নদীর উৎপত্তি রাজশাহী জেলার চারঘাট থেকে পদ্মা নদীর শাখা নদী হিসেবে। রাজশাহীর চারঘাট থেকে বাঘা, নাটোরের বাগাতিপাড়া, বড়াইগ্রাম, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলার মধ্য দিয়ে বাঘাবাড়ী হয়ে এটি হুড়া সাগরে মিশে নাকালিয়া নামক স্থানে যমুনা নদীতে পড়েছে। এটি রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ চারটি জেলা ও আটটি উপজেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এটি পদ্মা-যমুনার সংযোগকারী নদী ছিল। এছাড়া এই নদী বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জলাভূমি চলনবিলের পানি প্রবাহের প্রধান সংযোগ নদী। নদীটি তুলনা মূলকভাবে ছোট হলেও নাব্যতা ছিল ভালো, ছিল খরস্রোত। এ অঞ্চলের প্রধানতম মৎস ভান্ডার ছিল চলন বিল, আবার শুকনো মৌসুমে তা শুকিয়ে গিয়ে বিস্তীর্ণ ফসলের জমিতে রূপান্তরিত হতো। এ নদী এ বিলের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত ছিল। চলন বিলের মাঝ দিয়ে ছিল ক্ষীণকায় কয়েকটি নদী, নারদ তার অন্যতম। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল ছিল অপেক্ষাকৃত উষর আর অনাবাদী। অন্যদিকে প্রায় পদ্মার তীর ঘেঁষে উত্তর পাশে বৃহত্তর জনপদ ছিল পুঠিয়া, নাটোর আর বগুড়া। পুঠিয়াতে ছিল দীঘাপাতিয়ার জমিদারবাড়ী। কিন্তু তা ছিল কেবলমাত্র বড়াল ও হোজা নদী ও সরু সড়কপথে সংযুক্ত।


নাটোর অঞ্চলে প্রচুর আখের চাষ হতো এবং এ কারণে নাটোরের অনতিদূরে নর্থবেঙ্গল সুগার মিলস্ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ অঞ্চলে আরো সুগার মিল গড়ে তোলা হয়, রাজশাহীর হরিয়ানায়, জয়পুরহাটে (চলনবিলের অপর পাশে) প্রভৃতি স্থানে। নাটোরের দক্ষিণে অগ্রসর হলেই পুঠিয়ার রাজবাড়ী, তার অল্প ব্যবধানে পদ্মা নদী। পদ্মা তখন প্রমত্তা, হার্ড্ঞ্জি ব্রীজ বা ফারাক্কা নির্মিত হয়নি। ফলে এ নদী ছিল বিশাল নৌপথ। ফলে পদ্মায় ব্যাপক ভাঙ্গনও ছিল। ১৯১৫ সালে পাকশী ব্রিজ উদ্বোধন হলে ঈশ্বরদী শহরটি আর ৫ মাইল পূর্বদিকে সরিয়ে গিয়ে নতুন রেল লাইন নির্মিত হয় এবং হার্ড্ঞ্জি ব্রিজের উপর দিয়া ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ১৯২৯ সালের আগষ্ট মাসে আব্দুলপুর ষ্টেশন থেকে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়।


ইতিহাস আরো জানায় যে, ১৯৪২ এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আর যুদ্ধোত্তর সময়ে ভারতের এতদঞ্চলে দেখা দেয় চরম খাদ্যাভাব, ফলে মানুষের ভোগান্তি চরমে ওঠে। এই দুর্ভিক্ষকে বিবেচনায় নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেখাতেই হাজার হাজার লোক মারা পড়ে। গ্রামে কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নাই। কৃষি জমি অনাবাদী পড়ে আছে। তার ফল যা হবার তাই হলো। পৃথিবীর আদিম ব্যবসায়!


কবির ‘ঝরা পালক’ কবিতা গ্রন্থের একটি কবিতা ‘‘বনের চাতক-মনের চাতক’’-এর কয়েকটি চরণ  এ রকমঃ


          বনের চাতক—মনের চাতক আসে না ফিরে,
          কপোত-ব্যথা বাজায় মেঘের শকুনপাখা ঘিরে!
          সে—কোন্ ছুঁড়ির চুড়ি আকাশ-শুঁড়িখানায় বাজে!
          চিনি মাখা ছায়ায় ঢাকা চুনীর ঠোঁটের মাঝে
          লুকিয়ে আছে সে-কোন্ মধু মৌমাছিদের ভিড়ে!


                                          ক্রমশঃ..............


এস, এম, আরশাদ ইমাম//অপর জীবন
১৬ নভেম্বর ২০১৫; সোমবার//ঢাকা।