প্রস্তাবনাঃ
আমরা যখন ফুল শব্দটা বলি- কোরকের আবিষ্টতা নিয়ে হাজির হয় ভিন্ন ভিন্ন রূপ-রঙ-স্নিগ্ধতা নিয়ে অসংখ্য ফুল। অরণ্য, বনরাজী উচ্চারণ করার সাথে সাথে সবুজের ভিন্ন ভিন্ন শেড নিয়ে জেগে ওঠে পাতারা। উড়ে আসে পাখি। কলকাকলি ভরা অরণ্যপাশ খুলে নদীর ছ্বলচ্ছ্বল। পাল-মাস্তুল-হাল নিয়ে উজানমুখি নৌকার ছবি ভেসে ওঠে। একইভাবে নদী শব্দটাও আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় গ্রামীণ হীরন্ময় দৃশ্যের কাছে। ফুটে ওঠে  ফুল- ফসলের মাঠ, শিরিষ- বাবলার সারি....


উপমাঃ
একই ধর্মবিশিষ্ট দুটি ভিন্নজাতীয় বস্তুর সাদৃশ্য বর্ণনা করতেই আমরা উপমার ব্যবহার করি, তাই না ?
দূরত্ব আর দূর্বোধ্য করে তোলা যদি উপমার উদ্দেশ্য হয়- ভাই লোগ, আমি কবিতার কথাই বলছি...
এই যে দূর্বোধ্য করে তোলা উপমা হাজির করে আপনি তাকে কবিতা বলতে চাচ্ছেন,
এবস্ট্রাকশন বলতে চাচ্ছেন, ম্যাজিক রিয়েলিজম বলতে চাচ্ছেন, নিও ক্লাসিসিজম বলতে চাচ্ছেন...
আসলে কি বানাতে কি বানিয়ে ফেলছেন শেষমেশ?
উপমার বিশেষণ রূপ ঔপমিক। উপমান(বিশেষ্য), উপমিত(বিশেষণ), উপমিতি(বিশেষণ), উপমেয়(বিশেষ্য) ইত্যাদি। ব্যাকরণসিদ্ধ।
যখন একই ধর্মবিশিষ্ট বস্তুর সাদৃশ্য বজায় থেকে নতুন কোনো রূপ, রঙ, ঘ্রাণ, শুদ্ধতা, স্নিগ্ধতার খোঁজ পাওয়া যাবে... তখন সেটিই হবে উপযুক্ত উপমা। না হলে বিলকুল বরবাদ।
আন্দাজে যা খুশি তা বলে দেওয়া যায়... কবিতায় একেবারেই নয় !


বাংলা কবিতায় উত্তরাধুনিকতাঃ
"শোনা যায় উত্তরাধুনিক মতবাদ প্রয়োগ করার ফলে বাংলা কবিতার যে হাল, তা দেখে পাঠকসমাজে কবিতাভিতি সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বাংলা কবিতায় উত্তরাধুনিক মতবাদ এর প্রতিফলন কমই ঘটেছে । শুধু শুধু এই মতবাদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে।
আদতে উত্তরাধুনিক মতবাদকে বাস্তব সম্মত মনে হয়। আর প্রশংসার যোগ্য কাজ হলো তাই,যখন আমরা আমদের যাবতীয় কর্মকান্ডের পিছনে যে গোপন মনবৃত্তি, যে বাতেনি প্রনোদনা তা উদঘাটন করে প্রকাশ করতে পারি। এই বাতেনি প্রনোদনাই উত্তরাধুনিকতাবাদ।"
প্যাটার্ন, ফর্ম, ভাব, অতি উপমার ব্যাবহার, উপমা বানানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা.... হয়ত তাৎক্ষনিক একটা আবেদন সৃষ্টি করা যাচ্ছে, কিন্তু তা কালোর্ত্তীর্ণ হবে, এইটা অলীক ভাবনা ছাড়া আর কি !
মানুষের স্মৃতিতে শেষতক থাকে সারাংশ, রেশ, ঝলক, পলকের অংশবিশেষ। আমাদের এই অতি উপমা যেমন পাঠক ধরে রাখতে পারেন না, তেমনি আমরাও চালিয়ে যেতে পারিনা। আবহমানতা থাকেনা। নিরবচ্ছিন্নতা থেকে কেবলই সরে সরে যায়, বদলে যায় ফর্ম, প্যাটার্ন, ধরন। আদ্যোপান্ত পাঠ করেও কোনো সারবস্তু যদি না পাওয়া যায়, তখন স্বভাবতই চোখ ফিরে আসে, পাঠক ছিটকে পড়েন।
শব্দের অবশ্যম্ভাবী বিন্যাস ব্যাহত হয়ে উল্টা বিভ্রাট বিভ্রম সৃষ্টি হয়। আমরা বলি পাঠক কমে যাচ্ছে। আসলে কবিতার পাঠক চিরকালই হাতে গোনা, অল্প সংখ্যক। বরং এখন পাঠক বেড়েছে এই কথা বলা যায়। সেক্ষেত্রে কবির দায়ও বেড়েছে। দায়বদ্ধতা মাথায় রেখে যদি লিখা যায়, আমার মনে হয়- এই সংকট থেকে বের হওয়া যাবে।


হাই(পার) পোয়েট্রিঃ
আপনি ফর্ম ভাঙতে চান। আপনার স্ত্রীও তাই চায় ( লাইক করে) । সমস্যা কোথায় ?
চেতনা (ভাব) আপনার, কলম আপনার ! আপনি কোন প্যাটার্নে লিখবেন, সেটা একেবারেই আপনার নিজের ব্যাপার !
"হাই(পার) পোয়েট্রি" বেশিদিন ধরে রাখা যায় না। শব্দের তুকতাক একসময় ফুরিয়ে যাবেই !  পোস্টমর্ডানিজম এর নামে উনিশের দশক থেকে দুই বাংলায় যে বালখিল্যতা কবিতায় দেখা গেছে- তার লাগাম টানা লাগেনি, আপনিই থেমে গেছে।
বস্তুনিষ্ঠতার ভান, অনিষ্ঠায় নির্বস্তুক ভাবনা, প্রলাপ-বিলাপ বেশিদিন টেকে না। কিছু ভাঙ্গতে হলে তো নির্মাণকলা জানা জরুরী।


কোনো কিছুই ভাঙ্গার পক্ষে নই আমি; বরং সেটাকে আরো উন্নত যায়গায় নিয়ে যাওয়ার যে শ্রম, তাতে ক্লান্তি বোধ নেই। একটা পার্সপেক্টিভ ছাড়া হুট করে কিছু হয় ? হুট করে হলে হুট করেই তার বিলোপ ঘটে।


কবিতাঃ
“ঈশ্বরের হাতের নাগাল থেকে জলস্রোতের মত শব্দেরা বেরিয়ে গেলেই কবিতা”
কবিতা প্রসঙ্গে নেরুদা’র বয়ান পড়ছিলাম। আমি লিখেছিলাম “শব্দস্রোত” কোনো একটা লেখায়। নেরুদা লিখেছেন- সে স্রোতে যে কোনো পদার্থ
থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে... কিংবা এমন কোনো বস্তু- যা আছে অথবা একেবারেই নাই। “নাই” বা “আছে”র দ্বন্দ কবিতায় ম্যাজিক সৃষ্টি করে চলেছে।
জীবনানন্দ বললেন- “এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে; - জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা’’


কবিতা এবং কবিকে দুটো আলাদা অস্তিত্ব মনে করলে কি দাঁড়ায় ?
কবিতা অনেকটাই সয়ম্বরা। যাকে তার মনে ধরে নিজেই তার ঘাড়ে চেপে বসে। হাস্যকর শোনাচ্ছে ? শোনাক...
আবহমানকাল থেকেই সে সয়ংসম্পন্ন। একাই একশো টাইপ এর, ফোর হর্স-পাওয়ার নিয়ে কবিতা চলে।
কবিতা আকাশে, মেঘে, ধূলিকনায়, আঁধারের উর্ণনাভে রচিত ইন্দ্রজাল।
আপনি দেখবেন ঝর্নার রূপ, কলকাকলীভরা
কলকাকলীভরা অরণ্য অটবীতে, শহুরে ভিড়ে, হুল্লোরে, আড্ডায়,
বাদামের খোসা ছাড়ানো মুহুর্তে, চোখেচোখ... অসময়ে, নির্জনতায়, সন্যাসে, সংসারে...        
কবিতা ছুটে বেড়ায়... কিশোরীর আদলে...নাকের ধাগায় পালক গুঁজে চঞ্চল মুরগীর মত এবাড়ি-ওবাড়ি হয়ে..
অনেকটা সে শিশুর মত চঞ্চল, আত্মভোলা, হেয়ালী, অভিমানিও!
কবিতার কাউকে লাগে না- যে কোনো শব্দেই সে কথা কয়ে ওঠে। ঝিঁঝিঁদের একনাগাড় ঝিনঝিন, রাতপোকাদের সুরের অনবদ্যতা-
শিশির পতনের স্বর-শব্দ কবিতার নিজস্বতা !
এখন যদি কেউ তার রঙে নিজেকে রাঙাতে পারে, লালন করতে পারে- তবে জয় বা আনন্দ তার। সে কবি বনে গেল !


কবিতা কি ?
এই প্রশ্নটার মুখোমুখি মাঝে মাঝেই আমাকে দাঁড়াতে হয়। আমি নিতান্তই ছেলেমানুষি উত্তর দিয়ে কোনোমতে প্রসংঙ্গ থেকে পালিয়ে যেতে চাই। আমার বিদ্যা বুদ্ধি বা জানার পরিধি যৎকিঞ্চিত, সামান্য।
কবিতা লেখার ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটা ঘটে- চেতনার খুব ভিতরে একধরণের শূণ্যতা টের পাই। দৃশ্যপট থেকে একটু একটু করে উধাও হয়ে যায় চেনা মুখ, চেনা রাস্তা, চেনা অরণ্য বনানী, নক্ষত্রপুঞ্জ...
অজানা অস্থিরতা, ভয়, সঙ্কট থেকে বের হতে পারি না। এই সঙ্কট থেকে বের হওয়ার জন্যে আমি রাস্তা খুঁজি। দেখা হয় নিউরোনে জমে থাকা শিশিরের সাথে ! পাতাহীন, পাখিহীন শাখার সাক্ষাৎ পাই। দেখা হয় পুনর্ভবা নদীর সাথে। অথচ নেই পাল- মাস্তুল- মাঝিমাল্লার চিহ্ন কোনো !
মেঘ নেই, ঢেউ নেই, বিষাদের কবলে পড়া নাবিকের মত ভিতরটা কেঁপে ওঠে।
তখন একটা লাইট হাউজ কল্পনা করে নিতে হয়- উপকূলবর্তী গাঙচিল শালিক, নুড়িপাথর, শৈবাল...
পাতাহীন পাখিহীন গাছে সবুজ আর মখমল ডানা ভাবতে গিয়েই জন্ম হয় "কবিতার"।


রবীন্দ্রনাথের " অপরিহার্য শব্দের অবসম্ভাবী বাণী বিন্যাস"এর চেয়ে সহজ সুন্দর সংজ্ঞা আমার চোখে পড়েনি।
একটা শিশুতোষ ব্যাখ্যা কাল রাতে দাঁড় করেছি- জানি কবিতার জন্যে এই সংজ্ঞা খুবই নাজুক
"বোধএর প্রচ্ছন্ন মদদ, চৈতন্যের সুগভীর থেকে উঠে আসা শব্দ, অনুভবে কবিতার রূপ পায়"


সমস্যা হোলো অলটাইম কবি থাকা যায়না। কখনো কখনো মানুষ হয়ে উঠতে হয়: সময়ের প্রয়োজনে। তখনি প্রেমহীনতা টের পাই। ভিষন একা হয়ে যেতে হয় ... তখন মনে থাকেনা কাকে কি বলছি। যোগ্য অযোগ্য সবাইকেই পারফেক্ট মনে হয় ! নিচুর কাছে আরো নিচু হই, হতদরিদ্রের কাছে পাতি হাত ... বেলাশেষে টের পাই... আমিও ভুল মানুষ এক।


সংখ্যালঘু কাকঃ
শব্দের অপচয় রোধ করার যে দাবি, যারা তোলেন, এরা বৃদ্ধ ( মানসিকতায়)। আর বৃদ্ধদের কামই হইলো ভুল বোঝা। কিন্তু তরুণরা ভুল করে না। এখন যে বাংলিশ লিখছে, বানানের মায়রেবাপ কইরে ছাড়তেছে, ভাষার মেটালিক রূপ বের করে ফেলেছে আমাদের ছেলেরা, আমাদের মেয়েরা । এটাই আমাদের আগামি। এইটা হবেই। এটাই বিপ্লবের নমুনা। এটা কিছুতেই রোধ করা যাবে না। বাংলাএকাডেমি অভিধান সংস্কারের আয়োজন যত দ্রুত করবে, ততই সময়ের অপচয় কম হবে। ফেসবুকে এক দুই লাইন কবিতা লেখে না এমন লোক কমই আছে। এইটাকে পজিটিভ ভাবা দরকার।
পাঠক যখন লিখতে শুরু করে, অনুরাগ হোক আর অতৃপ্তি থেকেই হোক; ধরে নেওয়া যায় পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। কাকের চেয়ে সংখ্যাগুরু কবি , এটা বিপ্লবের লক্ষন। পৃথিবীতে একটা দেশ আছে, সেই দেশে কয়েকটা কাকের বিপরীতে সতেরো কোটি কবি দাঁড়িয়ে গেছে- এইটা আশার কথা। হোক কাঁচা হাত। বিরহ বিচ্ছেদ প্রেম দ্রোহ, নদী পাখি ফুল লতাপাতার বন্দনা লেখে, গদ্যরীতিতে পদ্য লেখে।
অসুস্থ রাজার জন্যে সুখি মানুষের জামার জরুরত নিয়ে লেখার অনুমতি নাই এদেশে। তাই উপমায় লেখে।
আর আমি কবি নাগর, নগরের প্রধান ভাড়, কিছুই পারিনা দিতে কাকের বিপরীতে দাঁড়ানোর মত শক্তিশালী, বিধ্বংসী পারমাণবিক কবিতা কোনো। আমার কলম, আমার শব্দ বন্দক রেখে "পাকা হোক তবু ভাই পরের বাসা" কিনি। অবাকভ্রমনে যাই। নদী বিহারে যাই। গদিয়ান মহাজন আমি আসলে কে ? আমিই তো আসল কাক ? শব্দ খুটে খাওয়া টোকাই কবি !


সুইট ডিসপোজিশনঃ
শব্দের কম্পোজিশনই কবিতা নয় ! ভেতরটা শুদ্ধ না হইলে সব বরবাদ....
কবিতা হইলো- বাহিরটাকে ভিতরে নিয়ে, ভিতরটাকে বাহির করা।
ব্যক্তি কবির অভ্যেস-মুদ্রা, স্বভাব, আনন্দ,অপারগতা, দোষ-গুন... সব বেরিয়ে আসে!
শব্দভান্ডার দিয়ে কবিতা হয় না ! সে কারনে রিস্ক বেশি।
এরকম হতে পারতো, সেরকম হতে পারতো, একটু সংহত, সংযত, সংক্ষেপিত.....
এই কমেন্টস গুলো কবিতার ক্ষেত্রে খাটেনা। যেহেতু কবিতা হয়ে যায়, আপনিই হয়ে ওঠে নাজিলকৃত দৈব বাণী রূপে। সংশোধন পরিমার্জন করা গেলেও কবি মূল যায়গা থেকে সরে আসতে অপারগ, পারেন না। এই মন্তব্যগুলোর ক্ষতিকর দিক নিয়ে আরেকদিন কথা হবে...... নিশ্চয়ই


কবিতাকে সন্তান এর মত ভাবা, আবেগের একটা স্তর। আমি এরকম করে কোনোদিন ভাবিনি। কবিতার মূল্যায়ন তো অবশ্যই আমার বোধ আর রুচির সত্যায়ন, রায়। কবিতাকে আপন লাগে। পাঠকদের আপন লাগে আরো দশগুণ।
শীল্প তো বিলাস ছড়ায়- অভাবের আর স্বভাবের। ম্যাসেজ তো থাকেই- পাখির ডাকেও, নদীর স্রোতেও, উত্তরের হাওয়াতেও। রসিকজন সে বার্তাপাঠ জানে। প্রতিউত্তর কিংবা নেওয়া, নিতে পারা এটাও রসিকজনের কাজ। লালনের একটা গান বলি- " রসিক যারা চতুর তারা- তারাই নদীর ধারা চেনে"


যাই হোক প্রসঙ্গে আসি। কেউ কেউ ম্যাটেরিয়াল ভ্যাল্যু খোঁজেন। বিখ্যাত , নন্দিত একটা ভাস্কর্যেরও যে আলাদা ভাষা আছে, বার্তা আছে, তা ওই লোকসকল মানতেই চান না। তিনি হিসাব করেন- কত কেজি সিমেন্ট লেগেছে, কত কেজি কংক্রিট , লোহা বালি, শ্রমঘন্টা ইত্যাদি। কেউ কেউ ধর্মিয় অনুশাসন এর চোখে দেখেন, পাপ থেকে বাঁচার দোয়া পাঠ করতে করতে এড়িয়ে যান।
তার মানে কি, দৃষ্টিভঙ্গির বিষয় ? অবশ্যই দৃষ্টিভঙ্গি ও রুচি- শীল্প দর্শণের খোদ ব্যাপার।
মানুষ রচিছে শীল্পের ভাষা, ভাষা রচিছে যুগ, নিয়ম, অনিয়ম। মানুষ বড়, আগে মানুষ !