ঝাউপাতার ভায়োলিন—কবিতার ভাবদরিয়া
            আশিক রাহিম


(ঝাউপাতার ভায়োলিন একটি কাব্যগ্রন্থ) আমার এই রিভ্যিউটি একটি অনলাইন প্রত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে গত ২৪/০২/২০২০ইং


*
জীবনানন্দ দাশ বলেছেন—'সবাই কবি নয়; কেউ কেউ কবি।' যারা কবিতা-চর্চা করেন বা কাব্যের মাধ্যমে মনের অন্তর্নিহিত ভাবপ্রকাশ করেন, সেই ভাব যখন কাব্য-বোদ্ধা-পাঠকের মনের দ্যোতনাকে একটুখানি হলেও নাড়িয়ে দেয় বা আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দেয় বলতে চাইছি, তখনই মূলত তারা কবি। কবি সাগর শর্মার কবিতাগ্রন্থ 'ঝাউপাতার ভায়োলিন' পাঠে আমার এমনই উপলব্ধি হয়েছে। এ যেন বাঁকখালির করুণ জল ধীরে—গড়িয়ে বঙ্গমাসাগরে মিশে সৃষ্টি করেছে কবিতার এক নান্দনিক ভাবদরিয়া। যেন সমুদ্রের বুক থেকে উঠে আসা কবিতার ঢেউ—উপচে পড়ছে ঝাউবনে, অলকার চঞ্চল চোখে, বায়োস্কোপে, পালকিতে, রাঙামা'র কপালের লাল সূর্য তিলকে। মনে হয়েছে কবি, শৈশবের স্মৃতির কাছে ফিরে গেছেন বারংবার, সেইসব শৈশবের স্মৃতিগাঁথা এঁকেছেন নিখুঁত ভঙ্গিতে, কবিতার ঠাসবুননে। রংধনু আকাশ, মেলা, নাগরদোলা, বেহুলা, সিনেমা, এইসব যেন তাকে ভাবাবিষ্ট করে তুলেছে বারবার; এপাড়-ওপাড় তোলপাড় করেছে মানুষের ভেতরে, বাঁকখালির উত্তাল বাঁকে। 'বাঁকখালির বুকও আজ দারুণ অবহেলার/ বেহুলার সময় কোথায়—নোঙর ফেলার!' (নদীপাঠ- ৩) 'মেলায় উড়ছিলো নাগর দোলা, রঙিন লাটিম, ঘুড়ি, ফানুস, বেলুন, ঘোড়া—অলকার চঞ্চল
চোখজোড়া।' (বায়োস্কোপের নর্তকি- ২) 'চৌরঙ্গীর চেয়ার—/টেবিলে ঠেস দিয়ে/ তোলপাড় টোলপড়া/ হাসি হাসে, পাশে নাচে—/…সবুজের স্বৈরাচার।' (লিটলম্যাগ) এইখানে কবি তার কবিবন্ধুদের প্রতি ব্যঙ্গাত্মক বিষাদ্গার লক্ষ করছি। তিনি হয়তো চেয়েছিলেন কবি বন্ধুদের সঙ্গে সাহিত্যের গঙ্গাজল একসাথে পাড়ি দিতে! কিন্তু জীবন সে-তো নদীর বাঁকের মতো বহমান। এই টার্নিং পয়েন্টটাই হয়তো কবি শেষ পর্যন্ত ধরতে পেরেছিলেন। তাই শেষপর্যন্ত একার সন্ন্যাসই হয়ে ওঠে কবির অন্তিম ধ্যান। তাই একই কবিতায় শেষ দিকে বলেন, 'আমি নামি জলে/ বন্দরে নোঙর তুলে/ একাই ভাসাই তরী—/…বুদ্ধদেব স্মরি/' (লিটলম্যাগ) এখানে বোঝা যায়, একসাথে প্রার্থনা হলেও সাধনা হয় না। তাই তিনি বলেন, 'ধ্যানে কাটে ত্রিকালজ্ঞ; ঋষি হতে চাই। কেওক্রাডংয়ের চুড়ায়/ বসে কাব্য ফলাই।'(কেওক্রাডং)


কবি সাগর শর্মা হয়তো শেষপর্যন্ত বুঝতে পেরেছিলেন, একসাথে সঙ্গম হলেও সাহিত্য হয় না। 'ঋষিরও মন গলে যায় সীতাকুন্ড এসে!/ কর্ণফুলির জল বয় হৃদয়পাড় ঘেঁষে—।' (বাঁক) 'আমি মাঝির ছেলে—/ নায়ের পাড়েই জন্ম, নায়ের পাড়েই ঘর/ আমার প্রচ্ছদ হয়েছিল বুদ্ধ পরম্পর।' (নদীপাঠ- ১) কিংবা 'নদী এক সর্ম্পকের সতীন—কেবলই পাড় ভাঙে!/ এভাবে সর্ম্পকের পাড় ভেঙে গেলে/ আমরা নদীর নাম দিই
ডাকাতিয়া।' (নদীপাঠ- ৫)


এই যে আপাত সহজ সরল অথচ গভীর এক নান্দনিক ভাষায় কবি তার কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে চাইছেন আবেগীয়—মহা-ঘোর! ভেতরে-ভেতরে কোথাও দাগ কেটে যায় সেসব কবিতা। এবং কবিতা এমনই হওয়া উচিত বলে মনে করি! কবি'রা হয়তো বিশ্বাস করেন, কবিতা মাত্রই কল্পনা, তারপরেও বাস্তবের সাথে কল্পনার রঙ মিশিয়ে রাঙিয়ে তুলেন কবিতার নিজস্ব রংধনু। আর সেই রঙের ছোঁয়ায় রাঙিয়ে তুলতে চান কোনো-কোনো পাঠক হৃদয়ও। এখানেই মূলত কবি বা কবিতার সার্থকতা।


সাগর শর্মার কবিতার একেকটি পঙক্তি যেন পাঠকের মনকে তোলপাড় করে দিতে চায়, যেন পাঠককে কল্পনার রাজ্যে ভাসিয়ে—ডুবিয়ে মাঝদরিয়ায় একা ছেড়ে দিতে চায়...! পাঠক যেন নিজেই খুঁজে নিতে পারে কিনারা তার একটা স্পেস রয়ে যায় কোথাও। যেমন- 'আজ মাঘী পূর্ণিমার রাত/ বসিয়েছে এ কোন্ ফাঁদ! (জোছনাকাল) 'এরচে' চারুকলার বারান্দায় বসাটা অনেক বেটার হতো।/ মোনালিসাকে মানুষ কীভাবে ভালোবাসে শেখা হতো।' (ওয়ার সিমেট্রি) 'বালকটি ঘুমায় না, ঘুমের ভেতরে ডুবে/ একলা একা সাঁতার কাটে বালিকার লগে।' (বালিকা) 'মেঘ সরোবরে চাতক স্নাত হলে, পৃথিবীতে নেমে আসে উষ্ণ বারিধারা।' (বারিধারা) 'চোখ এক মায়াবী আয়না কেবলই বিভ্রম ছড়ায়…' (চোখ এক মায়াবী বিভ্রম) 'সে রাতে বৃষ্টি হলে/ আদিবাসী পাহাড় ভেঙে পড়ে।/ পাহাড় ধসে পড়লে মাটিতে,/ রেণুর হৃদয়ের নাব্যতা বেড়ে যায়…' (পাহাড়ধস) 'পাহাড় এখন এক শান্তির নাম—/ শান্তিচুক্তির দরকার নাই আর!' (শান্তিচুক্তি) রংধনু আকাশ, তালপাতার বাঁশি, মেলা, দুই-প্রেমিকাদ্বয়, (অলকা ও শারসিনা) নাফ নদী, কর্ণফুলি ও বাঁকখালি, যেন কবিকে পুরোপুরি দখলে রাখলেও মূলত মানুষের মনের দরিয়ায় সাঁতার কাটতে চেয়েছেন বারবার। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো লিখেছেন, 'বাজারে যাই—মানুষের মুখ দেখে ফিরে আসি।/ কিনতে পারি না!/ মানুষের মুখের মতো সত্য কিছু নেই,' (মানুষ)


'ঝাউপাতার ভায়োলিন' পর্বে এসে দেখতে পাই, —কী এক না পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা সর্বদা যেন কবিকে তাড়িয়ে বেড়ায়। যা কবিকে পুরোপুরি বৈরাগী করে তুলে। যেন রাতের আঁধারে পৃথিবীর পথ ধরে একলা-একা হেঁটে চলেছেন জীবনানন্দের মালয় হয়ে বঙ্গমাসাগরের দিকে; যেন রাত্রিযাতনা শেষে সমুদ্রতীরের ঝাউবনে পড়ে আছে কবিতায় ক্ষুধাকান্ত এক শিশু। 'তবু মুখ বুজে/ বসে থাকি—মুখোমুখি একা; পান করে যায় নিজস্ব সুধা' (ঝাউপাতার ভায়োলিন- ৪) কিংবা 'এইসব বেদনাঘন দিনের ইশারা ভুলে তবু ফিরে আসি সাম্পানে—ভাসিয়ে দিই দেহ নূহের উজানে।' (ঝাউপাতার ভায়োলিন- ৫) এই বিচ্ছেদ-বৈরাগী ভাবনাই মূলত কবিকে বৈশ্বিক করে তুলেছেন। যেন মানব শিশু, পৃথিবী থেকে লাফিয়ে পড়েছেন ঝাউবনে, কবিতার ভাবসাগরে। তাই মানুষের মুখ দেখে কবি বলে ওঠেন—'মানুষের মুখ মিথ্যে বলেনা!' (মানুষ) মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, না পাওয়ার বেদনা ঝাউয়ের পাতার শনশনে তিনি শোনেছেন ভায়োলিনের করুণ আর্তনাদ—ঝাউপাতার ভায়োলিন! সমুদ্রগ্রীবা থেকে বাঁকখালির মোহনা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে সেই ভায়োলিন সুর! তাই কবি লিখেন—'সমুদ্র কী জানে, তার ঢেউ কেন তীরে এসে আছড়ে মরে?' (ঝাউপাতার ভায়োলিন- ১) কিংবা 'মানুষের চোখে লুকিয়ে থাকে গোপন আকাঙ্ক্ষা—'/(ঝাউপাতার ভায়োলিন- ৬) 'এইসব গোপন কাঙ্ক্ষিত অধ্যায় শেষ হলে, ঝাউবনে বেজে ওঠে করুণ
ভায়োলিন।' (ঝাউপাতার ভায়োলিন- ৬) 'সমুদ্রে কেন আসে মানুষ! সমুদ্র কি মানুষের সহোদর!' (ঝাউপাতার ভায়োলিন- ১৬) 'মানুষ সমুদ্রে একা গেলে বিষাদের হুহুপাখি ডানা ঝাপটায়।' (ঝাউপাতার ভায়োলিন- ১৮) অন্যের দুঃখে যে দুঃখী তার দুঃখ যেন অন্তহীন। ঝাউপাতার ভায়োলিন আমাদের এইরকম এক দুঃখীবোধ নিয়ে ছেড়ে দেন মাঝ-সমুদ্র-বরাবর! সাঁতার না জানলে এ পর্ব পাড়ি দেওয়া বড় মুশকিল! তাই পাঠককে সাবধান হতে হয়। কবি হয়তো ভালো করেই জানেন, দুঃখ বিনা যে সাধনও হয় না!


কবিতার ক্ষুধা—সাধনা, বৈরাগ্য কবিকে 'ঝাউপাতার ভায়োলিন' পর্বে উম্মাদ করে ছেড়েছে। যেন কবির ভেতর নতুন করে জন্ম নিয়েছে এক আদিমানবস্বত্বা। তবুও যেন কবিজীবনের বেদনার শেষ নেই, পূরণ হয় না সাধনার কাঙ্ক্ষিত নির্বাণপাঠ, হয়তো সেই আক্ষেপ থেকেই বলে উঠেন, 'মন ও মৌনতার দিকে হেঁটে গেলে মানুষ—/ সমুদ্রে বেজে ওঠে ঢেউয়ের করুণ এস্রাজ।' (ঝাউপাতার ভায়োলিন- ১৫) বা প্রেমিকা-কাঙ্ক্ষা থেকেই কবি লিখেন, 'বিষয়-বিচ্ছেদ ভুলে মানুষ ঢেউতে লুটায়।' (ঝাউপাতার ভায়োলিন- ৬) 'এইসব দৃশ্য থেকে লাফিয়ে পড়লে চাঁদ, জলেতে বিপুল/ আনন্দধ্বনি হতে থাকে!' (ঝাউপাতার ভায়োলিন- ১৪) তাই বলতে চাই, মনে সর্বদা প্রেম-রস-আনন্দ নিয়ে থাকতে কে না ভালোবাসে? 'ঝাউপাতার ভায়োলিন' যেন সেই আদি প্রেমরসকাব্যও।


কবির কিছু-কিছু কবিতায় দর্শনের মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। কবি হতে হলে ব্যক্তিকে অবশ্যই দর্শন সচেতন হতে হয়। আমার মতে প্রত্যেক কবিকেই এই বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। আমি বলছি না যে, কবিকে দার্শনিক হতে হবে। কবি যদি দর্শনের প্রতি সচেতন হন, তাহলে তার কবিতায় আলাদা একটি সৌন্দর্যভাব ফুটে ওঠে। এইসব ভাব, বোধ, বিচ্ছেদ যা কবিতাকে দর্শনে প্রভাবিত করে তোলে। কবি সাগর শর্মা হয়তো বিষয়টি ঠিকই ধরতে পেরেছেন। তা'নাহলে কী করে বলে ওঠেন, 'নেটং চুড়ার পাড়ে মন রত্মাকর ঋষি/ প্রেমপাঠ চুকিয়ে এবার চর্যাপদ চাষি/ ঋষিরও মন গলে সীতাকুন্ড এসে/ কর্ণফুলির জল বয় হৃদয়পাড় ঘেঁষে।' (বাঁক) এখানে স্পষ্ট বোদ্ধদর্শনের প্রভাব লক্ষ করছি। বৌদ্ধের যে ধ্যান-সাধন ছিলো সেকথা তো আমরা সবাই জানি। আবার লালনও বলেছেন, 'দিলদরিয়ার মাঝে আছে মজার কারখানা/ ডুবলে পরে রতন পাবি ভাসলে পরে পাবি না' (লালন) এইখানে মূলত কথা একটাই! বৌদ্ধ, লালন, কিংবা সাগর শর্মা তিনজন তিন রকম করে বলেছেন।


'মানুষ নিয়ে ট্রেন কোথায় চলে যায়! আবার ফিরে আসে মাুনষ নিয়ে..., এত মানুষ কোথায় যায়—কোত্থেকেই বা আসে এতো মানুষ!/ সারাদিন বসে বসে শুধু এটাই ভাবলাম:' (ট্রেন)


এখানে হয়তো কবি এইটাই বলতে চেয়েছেন, মানুষ তো মরে না! তাহলে কই যায়? মানুষ কোথাও যায় না, শুধু চক্রে ঘূর্ণীয়মান। এর পরের পঙক্তিতে বলেন, 'মানুষ আসলে কোথাও যায় না/ ট্রেনের ভেতরে বসে থাকে/ আর ট্রেন, দুইটি লাইনের উপরে খালি দৌড়ায়।' (ট্রেন) অর্থাৎ জন্ম নিলে মরতে হবে আবার মরলে জন্ম নিতে হবে! মানে কোথাও মূলত যাওয়া হয় না। জীবন—জন্মমৃত্যুহীন। আবার কবি হতে হলে ব্যক্তিকে শুধু দর্শন সচেতন হলে চলে না, লিঙ্গ সচেতনও হতে হয়! কথাটি হাস্যকর শোনালেও সত্যি। যে ব্যক্তি লিঙ্গের উঠানামা বুঝে না তার ধারা শুধু কবি নয়, মানুষ হওয়াও অসম্ভব। কবি হওয়ার আগে মানুষ হওয়াটাও তাই অতি জরুরি। লিঙ্গের উঠানামা, ভেদাভেদ, যদি কোন ব্যক্তি ধরতে না পারে, তাহলে সে কবিতাও ছোঁতে পারবে না। 'স্তন মানে মা।/ জন্ম অবধি মানুষ স্তনের নদী সাঁতরায়/ শিশুকালে মায়ের স্তন্যপান/ যৌবনে প্রেমিকার/ স্তনের অপর নাম জীবন/ মানুষ স্তনের খুব কাছাকাছি ঘুমায়।' (স্তনবিদ্যা) কবি সাগর শর্মা'র লিঙ্গ সচেতনেতা আছে বলেই তিনি এইরূপ সার্থক পঙক্তি রচনা করতে পেরেছেন বলে মনে করি। কেননা, মা'ও নারী, প্রেমিকাও নারী, অথচ দুজনই স্তনের অধিকারী, আবার দুজনেরই একইরূপ মায়ের জাত, মায়ার জাত, মা-জায়া-জননী। এইখানে লক্ষ করুন, কবির ভাবও কিন্তু ছিল ভিন্ন-ভিন্ন। 'শিশুকালে মায়ের স্তন্যপান, যৌবনে প্রেমিকার।' এ থেকেই বোঝা যায় কবি সাগর শর্মা'রও লিঙ্গ সচেতনতা আছে, তিনি লিঙ্গবান বা লিঙ্গভেদাভেদহীন কবি। 'বালিশের পাশে একান্ত পড়ে আছে নিষ্কাম অন্তর্বাস!' (অন্তর্দাহ) 'সফেদ সাপ। আহা! রাত বাড়লেই সুখ—রাত বাড়লেই রতির তাড়না।' (ঝাউপাতার ভায়োলিন- ২) কিংবা, 'পুরুষ মানুষ বড্ড খারাপ—/ সন্ধ্যায় নারীকে সময় দেয় না;/ অথচ নারী চর্চা করে!' (এই নির্জন সন্ধ্যায়) কবিতার এইসব সার্থক পঙক্তিপাঠ পরিশেষে বলা যায়, কবি সাগর শর্মা একজন দর্শন সচেতন, লিঙ্গসচেতন এবং লিঙ্গভেদহীন কবি।