প্রিয়তমা! আমি তোমার জীবনে আসিয়াছি অবেলায়,
দিনান্তে যবে অস্তাচলে ঐ দিবাকর ডুবে যায়!
চাহিতে আসিনি প্রেম, প্রিয়া শুধু এসেছি তোমার দ্বারে,
প্রেম-ফুল মোর অঞ্জলি দিতে তব পদতল ভরে।
মোর ভালবাসা-ফুল তব মুখে চাহে আঁখিজল ফেলে –
ভাবে কেঁদে কেঁদে – “নেবে না ওদেরে তোমারি বক্ষে তুলে?”
মানিলাম আমি তুচ্ছ! তবু তো ফুল সে তুচ্ছ নয়!
ফুলের মতন পবিত্র আর পৃথিবীতে কিবা হয়?
মোর ফুল? – তাই করো হেলা? – যাও সমুখে চরণ ফেলে,
তবু পাবে ফুল পদস্পর্শ – যাও, যাও তুমি দ'লে!
মোর প্রেম দ'লে চলে যাবে, - প্রেম তব তরে কিছু নয়,
পিষে চলে গেছো অতীতে কত সে ভগ্ন প্রেমিক-হৃদয়!
কত ভালবাসা-ভরা মন প্রিয়া অবহেলে গেলে দ'লে,
দেখিলে না কত ভগ্ন হৃদয় ছাই হয়ে গেছে জ্বলে!
কত আশা ভরা মন পিষে যাও প্রিয়া পিপীলিকা জ্ঞানে,
কত সে বিরহী হতবাক হয়ে চেয়ে রয় তব পানে!
অশ্রু-কাতর চোখে চেয়ে থাকে, বলিতে পারে না কিছু,
এত সে কাঁদনে দয়া জাগে না'ক, চেয়ে দেখিলে না পিছু!
বেদনা জাগে না তব মনে হায়! এত এত হাহাকারে,
নির্বাক, নিষ্ঠুরা, সুধা-লোভী, সুধা খোঁজো ফিরে ফিরে।
পাষাণের বুক ফাটিয়া তবু তো জলের উৎস বহে,
পাষাণের চেয়ে কঠিন হৃদয় – কাঁদিবার তরে নহে!
শুনি নারী নাকি প্রেমের আঁধার? – এই বুঝি প্রেম তার?
বাহিরে দেখিতে পুষ্প-কোমল, ভেতরে পাষাণ-ভার!
কবির বুকের গভীর অনুরাগ – অভিনয় সম লাগে,
দেখনি কত সে বিরহের জ্বালা ধিকিধিকি জ্বলে বুকে!
দাবানল সম জ্বলিয়া উঠিতে চাহে সে যে বারবার,
তামাম বিশ্ব চাহে সে জ্বালিয়ে করে দিতে ছারখার!
বুকের সত্য প্রেম, প্রিয়তমা আজো বুঝিলে না, হায়!
আকাশের বুকে ধ্রুবতারা জ্বলে, উহা তো মিথ্যে নয়!
প্রিয়তমা! তব শত হেলা বুকে বেদনার শূল হানে,
সেই সে বেদনা সুর হয়ে ফোটে আমার কাব্য-গানে!
চিৎকার দিয়া কাঁদে এ হৃদয়! – হৃদয়ের চিৎকার –
গান হয়ে মুখ ফুটে বাহিরায়, বুকফাটা হাহাকার!
তন্ময় হয়ে শুনেছে সে সুর, সুর-প্রেমী  কতশত,
দেখেনি ক' তারা সুরের আড়ালে যন্ত্রণা মোর কত!
শুনেছে কেবল গানের সে বাণী – মোর এ বাণীর আড়ে –
দেখেনি কত সে নিরাশা-বেদনা গুমরে কাঁদিয়া মরে!


মোর এ বুকের সব আশা-সাধ, সব ভালবাসা দিয়া –
হিমালয়-সম অটল প্রেমের সৌধ গড়েছি প্রিয়া –
তব তরে, তবু চোরাবালি-প্রেম খুঁজে মরো ঘুরে ফিরে,
যাহাদের কাছে ছোটো, ওরা থাকে ভদ্রের বেশ ধরে!
উহারা প্রেমিক-বেশী ভ্রমর, ঘোরে শুধু ফুলে ফুলে,
ছুঁড়ে ফেলে ফুল পিষে যায় যবে মধু তার শেষ হলে!
বালির বাধের মত ঐ প্রেম এত ভাল তব কাছে?
ভঙ্গুর প্রেম খুঁজে ফেরো! – জানো আলেয়ার আলো মিছে?
আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রয়েছি হেথা এতকাল বসে,
বিনিদ্র শত রজনী কেটেছে প্রিয়তমা তব আশে।
নিভু নিভু দীপে কভু দিই মোর হৃদয়-রক্ত ঢেলে,
হৃদয়-রক্তে সলতে ভিজিয়া লাল হয়ে শিখা জ্বলে!
শোকের সাগরে ভেসে কাটে রাতি – নিশব্দ, নিঃঝুম,
রাতের আকাশ ডাক দিয়ে বলে – “কবি! কেন নির্ঘুম?”
আমি বলি – “মোর প্রিয়া গেছে চলে, - সব সাধ গেছে নিভে!”
আকাশ বলেছে – “খসে পড়া তারা আকাশে ফিরেছে কবে?”
আশা বুকে বলি – “মোর প্রিয়তমা এত সে নিঠুর নয়,
বলে – “নারীমন দুর্গের মত, কেমনে বুঝিবে তায়?”


মোর এ বুকের সত্য-আকুতি আজ অসহ্য লাগে?
চেয়ে দেখিলে না আজো কত ফুল ফোটে এ হৃদয়-বাগে!
আশা লয়ে ফোঁটে, তবুও সে যায় শুকাইয়া নিরাশায়,
মরিবার আগে তবু তব পদতল ছুঁয়ে যেতে চায়!


অবেলায় আজ আসিয়াছি, তাই বলে তুমি প্রিয়তমা –
মোর অপরাধ করিবে না ক্ষমা? মুখ তুলে চাহিবে না?
কাঙালের বেশে আঙিনায় এসে তোমার দুয়ার ধরি –
এক পৃথিবীর হাহাকার বুকে আঁখিজলে কেঁদে মরি।
মোর ভাগ্যের রবি ডুবে গেছে, তবু কেন জানি আজ-
মনের অজান্তে ছুটে আসি দ্বারে ভুলে সব ভয়, লাজ!
ফুলের মতন মুখ হতে তব দু'খানি আশার বাণী –
শুনিবার তরে ছুটে আসিয়াছি, বলিবে না মোরে, রাণী?
মোর বুক পানে চেয়ে দেখ সেথা সাগর সমান আশা,
আশার সাগর মাঝে তবু জাগে ঢেউরূপে আন্দেশা!
চাহিবে না আজো মোর পানে প্রিয়া অনুরাগ-আঁখি মেলে?
নাকি ডুবে যাবে আশা-তরী মোর নিরাশা-সিন্ধু-জলে?