ওহে অশান্ত তরুণ দল!
কে পরাল তোরে সংযম মুখোশ, বিদ্যের শৃঙ্খল?
নীতি-বৃদ্ধেরা ঢাকিতে চাহে রে ভেতরের যত ভীতি,
তাইতো উহারা নীতি-কথা কহে – এত সংযম-প্রীতি!
ভাবে, ধ্বংসের গদা লয়ে যদি যৌবন নামে রণে,
গঞ্জিকা নাহি টানিতে পারিবে আরাম-সিংহাসনে!
ওরে অশান্ত, দুরন্ত তোর পাখারে বাঁধিল কেবা?
আঁধার আসিয়া বসাল তোদের প্রাণের জ্যোতিতে থাবা!
পঙ্গু, খঞ্জ, আতুর, জীর্ণ বৃদ্ধের দলে ভিড়ে –
যৌবন-তেজ হারালি কি ? বাঁধা রহিলি আঁধার-নীড়ে?
পুতুলের সম জড়বৎ যারা – ঘুণ ধরিয়াছে হাড়ে,
শক্তিবিহীন প্রাণ, তুষারের তলে রয় চাপা পড়ে,
হিমেল হাওয়ায় যাহাদের আজ রক্ত জমাট বাঁধে,
তাদের হুকুমে প্রাণের বিপুল জোয়ার দিলি কি রোধে?


সৃষ্টির কথা ভেবে যারা আগে ধ্বংসের ভয় করে,
যুগে যুগে মহাপ্রলয়-আঘাতে উহারা গিয়েছে উড়ে!
খড় না পোড়ায়ে আগুন জ্বালাবে বলে কোন নির্বোধে?
বীজ যদি নাহি প্রাণ দেয়, তবে ছায়া দেবে উদ্ভিদে?
অস্ত্র রাখিয়া অস্ত্রশালায়, ভাবে যুবা বসে বসে –
জয়ী হবে রণে ‘বই’ গিলে নাকি? – দন্ত কেলিয়ে হাসে।
যৌবন কভু মানে না ক’  ঐ নিয়মের শৃঙ্খল,
হুঙ্কারে তার জীর্ণ ধরণী কেঁপে ওঠে টলমল!
নদী ছুটে চলে মহাবেগে ঐ মহাসাগরের পানে,
সে কি দেখে তার স্রোতে কে ডুবিল? কারে মারিল সে প্রাণে?
যৌবন কভু মানে না ক’ বাধ – বহতা নদীর মত,
মহাউল্লাসে উন্মাদ-বেগে ছুটে চলে অবিরত!
পর্বত-সম সাগরের ঢেউ ছুটে চলে মহাবেগে,
কোন বণিকের জাহাজ ডুবিল? সে কি কভু তাহা দ্যাখে?
তেমনি জীবন – তরুণ যাহারা শির উদ্ধত করি’ –
জলোচ্ছ্বাসের মত ছোটে – নাহি দেখে ডুবে কার তরী!
তরুণ মানে না কোনোকালে ঐ পুরাতন বন্ধন,
জরাজীর্ণের যুক্তি শোনে না, শোনে না ক’ ক্রন্দন!
ঝড়ে উড়ে যায় জনপদ, তাই ঝড় আসিবে না নাকি?
প্রাণহানি আনে, তাই বলে আসিবে না কালবৈশাখী?
সাইক্লোন প্রাণ কাড়ে, তবু ফুঁসে ওঠে সাগরের জল,
পুড়ে লয় হয় জনপদ, তবু জ্বলে ওঠে দাবানল!
প্রাণ কাড়ে শত যাত্রীর, তবু সাগরে ঘূর্ণি ওঠে,
শত প্রাণ নাশে, তবু হুঙ্কারে টর্নেডো পড়ে ফেটে!
বন্ধন-হারা তরুণেরা ছোটে বাধার পাহাড় ভেঙে,
কপট শান্তি, জ্ঞান, সংযমে বিদ্রুপ-বাণ হেনে।
জ্ঞান-বুড়োদের মত তরুণের নাহি সংযম-প্রীতি,
জান ও মালের বিপুল ক্ষতিতে টলে না ওদের নীতি!
মানুষের তরে অকাতরে হেসে করে রে আত্মদান,
হিসাব কষে না, বেহিসাবে ওরা প্রাণ দেয়, কাড়ে প্রাণ!
মৃত্যুর সাথে করে যুবা নিতি জীবনের লেনাদেনা,
রক্তের মাঝে তরুণের বহে ঝড়ের উন্মাদনা!
বিধি-নিষেধের অটল পাহাড়ে যুবা লাথি মেরে ভাঙে,
উল্কার বেগে ছুটে চলে নীতি-বৃদ্ধের নীতি ভেঙে।
জালিমে মারিতে স্বর্গ হইতে নামে হাতিয়ার হাতে,
তরুণই আনে বিজয়োল্লাস ধরণীর আঙিনাতে!
অসুন্দরের সংহার করি’ সুন্দর রাখে ধরা,
অত্যাচারীর প্রাসাদ ধরিয়া দেয় ভীম-বেগে নাড়া!


জাগো অশান্ত দুর্বার বেগ, দুর্দম যৌবন,
জ্ঞান-বৃদ্ধের যুক্তি শুনো না, মেনো না ক’ বন্ধন।
আলোক-পিয়াসী যতই ছুটিতে চাহে আলোকের পানে,
বদ্ধ-বুদ্ধি জ্ঞানবৃদ্ধেরা ততই পিছনে টানে!
নীতি-বৃদ্ধেরা নীতি-ভারে নত, উহারা জাতির বোঝা,
প্রবল লাথিতে দূর করে দাঁড়া! শিরদাঁড়া করি’ সোজা!
নতুন দিনের আহ্বানে আজ ছোটো রে আলোক পানে,
বৃদ্ধের দল চাপা পড়ে র’বে কালের গোরস্তানে।
প্রাণের জোয়ারে দূর করে দে রে  পুরাতন জঞ্জাল,
যৌবন-স্রোতে যাক ভেসে যাক কিতাবের কঙ্কাল!
এসো দুর্বার যৌবন, এসো ঝঞ্ঝার উচ্ছ্বাসে,
সমুখে যা পাবে পিষে চলে যাবে উন্মাদ-উল্লাসে।
তারুণ্য-তেজে আদিম-প্রথার জীর্ণ আবর্জনা –
দগ্ধ, ভস্মীভূত হবে, যুবা বাধা-ভয় মানিবে না।
ভাঙো বন্ধন, বাধা-ভয় – ধরো বেহাল জাতির হাল,
শৃঙ্খল ভেঙে ছুটে এসো আজ – হাঁকিতেছে মহাকাল!
নীতি-বৃদ্ধেরা জগদল শিলা, জীবনের পথে বাধা,
জ্ঞানের অগ্নিমান্দ্যে ভুগিয়া চিৎকারে – “পেটে ব্যথা!”
আঁধার কোটরে উহারা চেঁচাক হুতোম প্যাঁচার মত,
কান দিও না ক’, আলোকের পানে উড়ে চল অবিরত।
জ্ঞানবুড়োদের বারণ শুনো না, দিক যত খুশি গালি,
আপনার গায়ে পড়িবে আসিয়া ঊর্ধ্বে ছিটালে কালি!
ওরা ভীরু, ওরা কীটের মতন পঁচে মরে ধুঁকে ধুঁকে,
যুগে যুগে প্রাণ আনে যুবা জরাগ্রস্ত জাতির বুকে।
ঘুমন্ত জাতির বুকে আঘাত হানো ঝঞ্ঝার বেগে ছুটে,
রুদ্র আঘাতে মরণ-নিদ্রা যায় যেন তার টুটে!
যুক্তি শুনো না বুড়োদের, থাক জঞ্জাল লয়ে মেতে,
আবর্জনার সম ওরা ভেসে যাবে রে কালের স্রোতে।
জ্ঞান-বৃদ্ধেরা জড়বৎ, তাই জড়তায় সুখ খোঁজে,
উহারা জরাগ্রস্ত, জরারে ঈশ্বর জ্ঞানে পূজে!
জ্ঞানের শিকলে বাঁধা পড়ে বুড়ো করে নিতি হাঁসফাঁস,
পুঁথির পাহাড়-তলে চাপা পড়ে ওঠে রে নাভিশ্বাস!
ভাগাড়ের মাঝে পড়ে রয়, যেন উহারা গলিত শব,
রক্ষণশীল চামচারা করে করজোড়ে স্তব।
আদিম যুগের ভূতপ্রেত ওরা কিম্ভূতকিমাকার,
তারুণ্য-তেজে জ্বলে ছাই হবে ভূতের সংস্কার!
মুমূর্ষু জাতির ভিত্তি ধরিয়া নাড়া দাও, নাড়া দাও,
বেহেশত হতে অমৃত আনিয়া মৃত এ জাতিরে জাগাও!
ধরণীর বুকে যত অসাম্য, অন্যায়-অবিচার,
তরুণের প্রাণ-বহ্নিশিখায় জ্বলে হবে ছারখার।
সংহার করি’ জরা এ ধরায় রাখিবে অমর করি’
দুর্বল মানুষের বল হয়ে যাবে আমরণ লড়ি’।
দাস হতে চাহে নীতি-বৃদ্ধের – নহে সে তরুণ নহে,
যৌবন শুধু বহিরাবরণ, ভেতরে সে জরা বহে।
বিপ্লব যার রক্তে নাহি ক’, নহে সে তরুণ নহে,
বিপ্লব-অগ্নি যার খুনে বহে - তাহারে তরুণ কহে!          
বিপ্লবী যারা, নির্ভীক তারা, অজর, অমর, অক্ষয়,
মৃত্যু আসিলে প্রিয়তমা ভেবে বক্ষে জড়ায়ে লয়!
উথাল সাগরে পড়ে ঝাঁপ দিয়ে, ওঠে দূর গিরি-চূড়ে,
আকাশের সীমা খুঁজিতে শূণ্যে প্রাণ হারায় ওরা উড়ে!
অনন্ত আকাশে গ্রহ-তারা খুঁজে হারায় চোখের জ্যোতি,
নবীন জগৎ সন্ধানে ছুটে নিভেছে প্রাণের বাতি।
পবন-গতিরে পশ্চাতে ফেলে চাহে গো যাইতে উড়ি’,
তুষারের তলে চাপা পড়ে, জয় করিতে তুষার-গিরি!
তরুণ তাহারা, মৃত্যুর দ্বারে নির্ভীক হাসি হাসে,
প্রাণ-ভয় ভুলে অবিচারে যারা বিদ্রোহ করি বসে।
নির্যাতিতের তরে অকাতরে হেসে করে প্রাণ দান,
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে ওঠে ওরা জীবনের জয়গান!
ওঠো, ছোটো সবে দুর্দম বেগে, দুরন্ত দুর্বার,
জং ধরে পড়ে কেন আছো সব খালিদের তরবার?
তরুণের তাণ্ডব-নৃত্যের তালে হবে পদতলে –
জালিম-প্রাসাদ চূর্ণ, - ছুটিবে তখত ও তাজ দ’লে!
এসো দুর্দম যৌবন, এসো তুফানের মত ছুটে,
তোমরা জাগিলে মৃতবৎ জাতি জাগিবে নিদ্রা টুটে!