(বি.দ্র. কবিতাটির নিচে প্রয়োজনীয় টীকা দেয়া আছে)


আকাশ পাতাল কাঁপিতেছে শুনে প্রলয়ের হুঙ্কার,
জাতির আকাশ হয়ে গেছে আজি কালো মেঘে একাকার!
তামাম মজলুমান আজ দেখি কাঁপিয়া মরিছে ত্রাসে,
অত্যাচারীর খড়্গ বুঝিবা ইহাদেরে এসে নাশে!
গগন কাঁপিয়ে আসিবে কি মহাবিশ্বের মহাত্রাস? –
আঁধার টুটায়ে অত্যাচারীর করিবে সর্বনাশ!
উৎপীড়িতের বক্ষে দ্রোহের কালানল জ্বলে ওঠে,
অগ্নিদাহনে যাবে বুঝি আজি জালিমের গদি টুটে!
গোটা কারাগার টলমল শত বন্দীর হুঙ্কারে,
সত্য সেনানী পড়ে পাটাতনে ফাঁসির রজ্জু ছিঁড়ে!
ইব্রাহীমের অগ্নিকুন্ড ছুঁয়েছে গগন-দ্বার,
পাপের বিশ্ব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে করে বুঝি ছারখার!
শত-শতাব্দী বাড়ব-বহ্নি ফুঁসিছে সাগর-তলে,
ফুঁসিয়া উঠিবে সে অগ্নি বুঝি সপ্ত-আকাশ ঠেলে!
অট্টহাসিতে শয়তানের আজি ভীতা ধরা টলমল,
দিকে দিকে ওঠে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-কোলাহল!
মুশরিক সব শ্বাপদের মত ঘিরে ধরে মুসলিমে,
বিনাশ করিতে আসিয়াছে ওরা আল্লার ইসলামে!
ইসলাম লয়ে খেলিতে এসেছে, হায়! মূর্খের সাধ!
জানে কি অগ্নি লয়ে যারা খেলে, তারা হয় বরবাদ?
ঈমান যাচাই করিতে এসেছে ভীষণ কামান লয়ে,
উহারা জানে না তোপের সমুখে পড়ে না মুমিন নুয়ে!
গোলার আঘাতে দেহ উড়ে যায়, ঈমান তো নাহি মরে,
এই সে ঈমান ঘুমন্তে জাগায় যুগযুগান্ত ধরে!
এই সে ঈমান নব জাগরণ জোয়ার আনে যুগে যুগে,
দাবানল সম জ্বলে সে ঈমান উৎপীড়িতের বুকে!
মুসলমানের ঈমান চিনেছ মূর্খের দল যত?
এদেরি ঈমান সমুখে বিশ্ব হয়ে আসে অবনত!
জাতির ভাগ্যের আকাশে জালিম ঈশ্বর সেজে বসে!
অত্যাচারের খড়্গ হানিয়া খুন খায় আর হাসে।
পদাঘাত হেনে জালিম আরশ ভেঙে কর চুরমার,
সপ্ত গগন টলায়ে হাঁক দে – “আল্লাহু আকবার!”
বিপ্লবের রক্ত-অশ্ব ছুটাইয়া কারা যায়?
শহিদ টিপুর হাতে ভাঙা নাঙা অসি আজো চমকায়!
বজ্রের সম গর্জে উঠিয়া ত্রিলোক কাঁপিয়ে আয়!
তিতুমীরের ওই পাগড়ি উড়িছে ভাঙা বাঁশ-কেল্লায়!


ঘোর এ আঁধারে আকাশের বুকে মাতাল-ঝঞ্ঝা ওঠে,
কারাগারে ঐ বন্দীর পায়ে শৃঙ্খল গেছে টুটে!
শত বছরের জঞ্জাল ওরা ক্ষিপ্র দু'পায়ে ঠেলে –
সম্মুখ পানে খুন-রাঙা পদে উল্কার বেগে চলে!
উল্কা-বজ্র-বৃষ্টি, তুফান মোদের পথের সাথী!
দুর্বার বেগে হানিয়াছি মোরা কুফরের বুকে লাথি!
প্রলয় শিঙ্গা ইস্রাফিলের বাজাই, কাড়িয়া লয়ে,
অত্যাচারীর তখত-প্রাসাদ টুটিয়া পড়ুক ভূঁয়ে!
মেটাই পিপাসা অত্যাচারীর খুন আকণ্ঠ পিয়ে,
রক্তের হোলি খেলি উল্লাসে দুশমন খুন লয়ে!
আজ পৃথিবীর বাঁকে বাঁকে ওঠে মজলুমের হাহাকার,
তকবীর হেঁকে আকাশ পাতাল ভেঙে করি একাকার!
শয়তান আজি জয়গান করে উল্লাসে কুফুরীর,
আছে কোন বীর লাথি মেরে ভাঙে ওর উদ্ধত শির?
তিমিরাচ্ছন্ন ধরণীর বুকে আল্লার নাম জ্বেলে –
বীর মুজাহিদ চলিবে আজিকে পাহাড়-বিঘ্ন ঠেলে!
এরা নির্ভীক, - নির্ভয়ে হাসে মৃত্যুর সম্মুখে
মৃত্যুরে ওরা প্রিয়তমা ভেবে জড়াইয়া ধরে বুকে!
বেহেশত হতে জালিমে মারিতে নামে হাতিয়ার হাতে,
উৎপীড়িতের বিজয়োৎসব এরা আনে ধরণীতে!
যুগে যুগে এসে ভাঙে মানুষের গোলামীর জিঞ্জীর,
মিথ্যের হিমালয় ভেঙে উঁচু করে সত্যের শির!
দুর্বার বেগে ছুটে চলে এরা, নাহি মানে বাধা ভয়,
পদে পদে শত বিপদের ফাঁদ – নাহি মানে পরাজয়!
বাতিলের আঘাতে টলে পড়ে, তবু ঈমান তো নাহি টলে,
আঘাতে আঘাতে শিরায় শিরায় বিপ্লব-অগ্নি জ্বলে!
শাহাদাত-লোভে অবিরাম লড়ে এরা আল্লার পথে,
আল্লার সনে ব্যবসা করিতে নামে জান মাল হাতে!
প্রাণ হাতে মরণের সাথে হেসে করে ছিনিমিনি খেলা,
ফাঁসির রজ্জু পরে নিজ হাতে ভেবে প্রেয়সীর মালা!
আগুন লাগায় ইহারা ভণ্ড পীরের আস্তানায়,
কুসংস্কার-জগদ্দল-শিলা ঠেলে সম্মুখে ধায়!
কলেমার আমামা বেঁধে, অসি হাতে উচ্চ করিয়া শির –
মাজার ভাঙিয়া মাজা ভাঙে ওরা ধর্মব্যবসায়ীর!
মাথা তোলে কারা? – বিপ্লবী ওরা, বারবার টলে পড়ে,
মার খেয়ে লাশ হয়, তবু ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি ঝরে!
বিপ্লবী-দেহ হতে খুন ঝরে – আবদ্ধ শৃঙখলে,
জাতির মুক্তি বার্তা লিখিছে সেই খুন ধরাতলে!
অমর হয়েছে জীবন বিলিয়ে এরা সত্যের তরে,
বিপ্লবীদের খুনে রেঙে দূরে কলেমার ধ্বজা ওড়ে!
মৃত্যুঞ্জয়ী, মৃত্যুর দ্বারে হাসে ব্যঙ্গের হাসি,
সাইয়েদ কুতুব হাসিয়া উঠেছে পরিয়া ফাঁসির রশি!
শহিদেরা কভু মরে না'ক, ওরা দুর্বার, দুর্জয়,
প্রাণ দিয়ে কোটি আত্মা জাগায় - চিরঞ্জীব, অক্ষয়!
নিষ্প্রাণ বুকে যুগে যুগে এরা প্রাণের বন্যা আনে,
প্রাণ দান করে অকাতরে হেসে মানুষের কল্যাণে!
পাষাণের বুকে প্রাণ জেগে ওঠে ইহাদেরি আহ্বানে,
তকবীর হেঁকে কাঁপন ধরায় অত্যাচারীর প্রাণে!
মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাণ, সে জাগায় জালিমের বুকে ত্রাস,
শহিদী রক্ত, লেখে ও অত্যাচারীর সর্বনাশ!


রক্তাক্ত রাজপথে –
কাহাদের শির গড়াগড়ি যায় পথের ধুলার সাথে?
ওরা বিপ্লবী, বিদ্রোহী, ওরা সত্যের মুজাহিদ,
খোদার রাহায় প্রাণ দিয়ে ওরা হয়েছে আজিকে শহিদ!
নিষ্প্রাণ, তবু নতুন দিনের স্বপ্ন খেলিছে চোখে,
মুক্তি-সূর্য ওঠে যুগে যুগে ইহাদেরি খুন মেখে!



(টীকাঃ ১) শহিদ টিপুঃ টিপু সুলতান। জন্মঃ ২০ নভেম্বর ১৭৫০। শাহাদাতঃ ৪মে ১৭৯৯।


বৃটিশ সয়লাব আর মারাঠা বর্গি যখন সমগ্র ভারত চুরমার করে ফেলেছে ঠিক তখনই পাহাড়ের মত অসীম দৃঢ়তা নিয়ে দাড়িয়ে যায় ছোট্ট একটি রাজ্য। বাংলা বিহার উড়িষ্যা যখন ইংরেজের দখলে, অবিরত বর্গি হামলায় ভারতের জনজীবন বিপর্যস্ত, ঠিক তখনই দিনের পর দিন চীনের প্রাচীরের মত পুরো দক্ষিণ ভারতকে পাহাড়া দিয়েছে মহীশুর সালতানাত। একটি দুটি নয়, পুরো ত্রিশটি বছর ইংরেজ সয়লাব ক্ষুদ্র শক্তি বলে আটকে রাখার নায়ক হচ্ছেন শেরে মহীশুর সুলতান টিপু এবং তাঁর পিতা হায়দর আলী।


এই দুই বীর যেভাবে সেই সময়ের অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন তা বিস্ময়কর। এমনকি, একই সময়ে ইংরেজ সৈন্য,অগণিত মারাঠা বর্গি এবং হায়দরাবাদের নিজামের সম্মিলিত শক্তির সাথেও সুলতান টিপুকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। সমগ্র ভারতের সকল পরাশক্তিকে দিনের পর দিন বাধা দিয়ে তাদের গতি বার বার ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। রক্ষা করেছেন মহীশুরের স্বাধীনতা।


সেই সময়ে ইংরেজদের বিষফোড়া হয়ে ওঠেন টিপু, তাদের রাজ্য জয়ের পথে বিশাল বাধা হয়ে দাড়ান। ইংরেজরা হাত করে মারাঠা সর্দারদের। সোনা আর দেশ জয়ের লোভ দেখিয়ে মারাঠাদের ক্ষেপিয়ে তুলে নিজেদের মিত্র বানায় ইংরেজরা। অপরদিকে হায়দরাবাদের নিজাম আগেই তার কিসমত জুড়ে দিয়েছে ইংরেজের সাথে। কাজেই টিপু একাই মুখোমুখি হন এই তিন পরাশক্তির। তার রণ কৌশল, বীরত্ব, বুদ্ধিমত্তার কাছে বারবার পরাজিত হয় এই তিন বাহিনী। সে সময়েই মহীশুরের জনগন তার উপাধি দেয় শের-ই-মহীশূর, মহীশুরের ব্যাঘ্র।


৩০ বছর ধরে পথ আগলে রাখার পরও সুলতান টিপু কে পরাজিত হতে হয় সম্মিলিত শক্তির কাছে তাঁর প্রধান সেনাপতি মীর সাদিকের বিশ্বাসঘাতকের কারণে।  সেদিন মহীশুর রাজ্যে রক্তের বন্যা বয়ে যায়। শহীদ হন শেরে মহীশুর। ইতিহাস বলে, এরপর ইংরেজদের আর কয়েক বছর ও লাগেনি সমগ্র ভারতের দখল নিতে।
শাহাদাতের ঠিক আগ মুহূর্তে সুলতান টিপুকে চতুর্দিক থেকে ইংরেজ সৈন্যরা ঘিরে তার বুক বরাবর গুলি করে। সুলতান পড়ে যান ঘোড়া থেকে। ঐ সময়ে তাকে মৃত মনে করে এক ইংরেজ সৈন্য তার কোমর থেকে রত্নখচিত তলোয়ার টেনে বের করতে গেলে টিপু হাত দিয়ে বাধা দেন এবং অকস্মাৎ নিজেই তার কোমর থেকে তলোয়ার বের করে পূর্ণ শক্তিতে তাকে আঘাতকারী ইংরেজ সেনাকে আঘাত করেন। আঘাত ব্যর্থ হয়ে লাগে সেনার বন্দুকের নলে। তলোয়ার অর্ধেকটা ভেঙে যায়। হাতের মুঠিতে তলোয়ারের বাটসহ বাকি অর্ধেকটা ধরে থাকা অবস্থায় শাহাদাত বরণ করেন এই ইতিহাসের এই মহান সেনানী।


২) সাইয়েদ কুতুবঃ শহীদ সাইয়েদ কুতুব ইব্রাহীম হুসাইন আশ-শাযলী, বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমিনের (মুসলিম ব্রাদারহুড) অধিনায়ক এবং অবিসংবাদিত নেতা। তাকে আরব জাহানসহ গোটা মুসলিম বিশ্বের অন্যতম চিন্তানায়ক, ইসলামি রেনেসাঁর অগ্রপথিক এবং মিসরে ইসলামি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ও তাত্ত্বিক পুরুষ মনে করা হয়।ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে জন্ম নেয়া সাইয়েদ কুতুব কুরআনের হাফেজ ছিলেন। উচ্চতর পড়াশোনা করেন কায়রো দারুল উলুম ও আমেরিকার একটি ইউনিভার্সিটিতে।
আমেরিকা থাকাকালীন তিনি পাশ্চাত্যের ভোগবাদী ও বস্তুবাদী শিক্ষার অসারতা ও নীচুতা অনুধাবন করেন। তখন তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে একমাত্র ইসলামই সত্যিকার অর্থে মানবসমাজকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারে। এই অনুপ্রেরণা থেকেই তিনি পরে কলম ধরেন এবং ইসলামি রাজনীতিতে সক্রিয় হন।
তিনি হাসান আল বান্নার প্রতিষ্ঠিত ইখওয়ানুল মুসলিমীন সংগঠনে যোগ দেয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করেন। তখন সংগঠনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রবল চাপের মুখে ছিল। তবুও তার নিযুক্তির পর ইখওয়ানে অভাবনীয় পরিবর্তন আসে। ওই সময় মিসরের মানুষ দলে দলে তাতে যোগ দিতে শুরু করে। ইখওয়ানিদের বিশ্বাস- তার কারণেই আবারও এই সংগঠন বিপ্লবী রূপ ফিরে পায়। যার ফলে একসময় তিনি ইখওয়ানের একনিষ্ঠ ও নিষ্ঠাবান নেতা হয়ে ওঠেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধ শেষে মিসরকে স্বাধীনতা দানের ওয়াদা করে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ইখওয়ান দল ব্রিটিশের মিসর ত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এর ফলে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ে এবং দু’বছরের মধ্যে দলের সক্রিয় কর্মীসংখ্যা ২৫ লাখে পৌঁছে। সাধারণ সদস্য, সমর্থক ও সহানুভূতিশীলদের সংখ্যা ছিল কর্মী সংখ্যার কয়েকগুণ বেশি। ঠিক তখনই ব্রিটিশ ও মিসর সরকার তাদের ওপর আক্রমণ চালাতে শুরু করে।
সাইয়েদ কুতুব একজন উঁচুমানের সাহিত্যিক হওয়ায় একসময় ইখওয়ান-পরিচালিত সাময়িকী - ইখওয়ানুল মুসলিমীন-এর সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পান। দায়িত্ব পাওয়ার ছয় মাস পরেই ব্রিটেনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সমালোচনা করায় মিসর সরকার জামাল আবদুন নাসের পত্রিকাটি বন্ধ করে দেন। তখন তাকেসহ হাজার হাজার ইখওয়ান সমর্থককে গ্ৰেফতার করা হয় এবং তাকে ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। দীর্ঘ ১০ বছর কারাভোগের পর তিনি ইরাকের প্রেসিডেন্টের সুপারিশে মুক্তি লাভ করেন। এরপর আট মাসের মাথায় সরকার পতনের চক্রান্তে জড়িত থাকার মিথ্যা মামলা দিয়ে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৫ সালের ২১ আগস্ট সামরিক ট্রাইবুনালের পক্ষ থেকে তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। কার্যকর করা হয় এর আট দিন পর, ২৯ আগস্ট ভোরে।
মৃত্যুদণ্ডের আগে সাইয়েদ কুতুবকে কালিমা পড়াতে একজন সরকারি মৌলভিকে জেলখানায় পাঠানো হয়। তিনি এই মৌলভিকে লক্ষ্য করে বলেন- 'তোমার কালিমা তোমার রুটি যোগায় আর আমার কালিমা আমাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলায়।')