আজ পৃথিবীতে শ্রমিকের কথা গান-কৌতুক সম,
নষ্ট সমাজে নিপীড়িত ওরা, অধিকার নাই কোনো।
জীর্ণ, শীর্ণ পড়ে রয় পথে, ভুগে দারিদ্র্য-দুখে,
শোষক-সমাজে শোষণ সহিয়া পাথর হয়েছে শোকে!
'ভদ্র সমাজে' উহাদের আজ 'অভদ্র' পরিচয়,
ভদ্রতা রয় হৃদয়ের মাঝে, পোষাক-আষাকে নয়!
জুব্বা ও কোট-প্যান্টের নিচে ঢেকেছ কদর্যতা,
হৃদয়ের মাঝে শ্রমিকের, জেনো ক্বাবার পবিত্রতা!
মোদের বস্ত্র ছিন্ন, জীর্ণ, সারা গায়ে কাদাপানি,
বাহিরে তোমরা 'ফুলবাবু', অন্তর-ভরা নোংরামি।
আকাশের মত 'বড় মন', তবু খায় 'ছোটলোক' গালি,
শত পাপ করে পড়ে না 'মশাই', তোমাদের গায়ে কালি!
গরীবের হাড় চুষিয়া হয়েছ মন্ত্রী, মিনিস্টার,
রক্ত শুষিয়া কাঙালের, হলে হৃষ্টপুষ্ট ষাঁড়!
আমরাই গড়ি রাজার প্রাসাদ, আমাদেরি নাই ঘর,
'ছাদ' হয়ে আছে 'বৃষ্টি-ঝরানো-আকাশ', মাথার 'পর।
তোমার প্রাসাদে গরমের দিনে এসি চলে, পাখা ঘোরে,
ঘরবাড়ি নাই, আগুন-তপ্ত রোদে এই দেহ পোড়ে!
নিশীথে সুখের নিদ্রা গিয়াছ নরম-তোষক-খাটে,
রাজপালঙ্কে নাক ডাকো, যেন ব্যাঙ ডেকে ডেকে ওঠে।
আমাদের নাই আবাস, রাত্রি কাটে শুয়ে পথে ঘাটে,
ঘুম আসে না'ক, - দংশায় রাতে মশা, ছারপোকা, কীটে!
তোমারে কাপড় পরাই, - মোদের জোটে না ক' ছেঁড়া কানি,
খিধেয় মরেছি, না খেয়ে, জোগায়ে তোমাদেরে দানাপানি।
ফসল ফলাই – মোরা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে,
দিবারাতি খাটি, খাদ্য জোটে না, পেট গিয়ে ঠেকে পিঠে!
ইচ্ছা-অন্ধ! দেখো আজ তব চক্ষের ঠুলি খুলে –
তব প্রাসাদের ভিত উঠিয়াছে কাহাদের কঙ্কালে!
মোদের রক্ত জমাট বাঁধিয়া প্রতি ইট গড়ে ওঠে,
সেই প্রাসাদের নিচে আশ্রয় নিলে লাথি খাই পিঠে।
'চোর' অপবাদে খেদাও – পথে ঘুরি, পাইনে ক' আশ্রয়,
প্রাসাদের প্রতি ইট কাঁদে এই অবিচারে নিশ্চয়!
রক্ত করিয়া জল, তব মাঠে ফসল ফলাল চাষি,
না খেয়ে মরিছে, খেয়েদেয়ে তুমি এদিকে খোদার খাসি।


সৃষ্টির আদি হতে –
দুর্গম-বন-ভরা ধরা হল 'স্বর্গ' এদেরি হাতে।
জরা-মৃত্যু ও শ্বাপদে ভরা এ ধরারে আনিয়া বাগে –
লাঙল, কাস্তে লয়ে 'বেহেশত' রচিল ধরণী-বুকে।
এদেরি রক্তে ফলে পৃথিবীর ফুল, ফল মনোহারী,
শাসিত হয়েছে এদেরি হস্তে প্রকৃতি স্বৈরাচারী।
ঝঞ্ঝা, তুফান, দুর্ভিক্ষ ও খরা করে চির-সাথী –
আঁধার বিশ্বে সভ্যতা এনে জ্বালালো আশার বাতি।
নজরানা দিল ফসল, ধরণী, এদেরি কঠিন হাতে,
তামাম ধরণী ঘুরিতেছে ভর দিয়া শ্রমিকের কাঁধে!
জলদানবের সাথে যুঝে আনে মানিক ডুবুরি-বীর,
সাগরের জল শুষে ওরা রচে' তোমার স্বর্গ-নীড়!
এদেরি অশ্রু সাগরে পড়িয়া মুক্তা-মানিক ফলে,
মুক্তার হার রূপে আঁসু তব বধূর গলায় ঝোলে!
বিষাক্ত খনি হয়তে প্রাণ হাতে কয়লা আনিল তুলে,
তাই দিয়ে এই ডাকু ধনিকের কলকারখানা চলে।
ঝর্ণা বহায় তপ্ত ধরার বক্ষে - পাহাড় ভেঙে,
মরুর বক্ষ সুশোভিত হয় শুষে শ্রমিকের খুনে!
রংবেরঙের যত গাড়ি তোমাদের রাজপথে চলে,
সাগরের বুকে জাহাজ ছুটিছে পর্বত-ঢেউ ঠেলে,
বিমানে চড়িয়া এক দেশ হতে আর দেশে চল উড়ি',
কাহাদের দান ছড়ায়ে রয়েছে বিশ্ব-ভুবন জুড়ি'?
বিশ্ব চলিছে এগিয়ে নিত্য – জানো কার অবদান?
যুগে যুগে যত সভ্যতা – নিপীড়িত শ্রমিকের দান।
শ্রমিকের শ্রম, তোমাদের তরে ঋণ দেয়া আল্লার,
আল্লার ঋণ শোধ কর, দাও শ্রমিকের অধিকার।
খোদার পাওনা শুধিবে না – পাটা বুকের এত বড় কার?
তাঁর হক যে বা অস্বীকারে – পিঠে পড়ে সে খোদার মার!


আমরা রহিব দারিদ্র্য-দুখে – নহে এ খোদার বিচার,
তোমরা ধনিক, শোষক – কেড়েছ আমাদের অধিকার!
ন্যায্য পাওনা দাওনি, দাওনি ন্যায্য মজুরী মোদের,
দু'পয়সা দিলে ভিক্ষা – মেটেনি ক্ষুধা-তৃষা ক্ষণিকের!
শ্রমিকের হক না দিয়া খোদার সনে কর প্রতারণা?
তাঁর সৃষ্টির হক মারো? – খোদা অবিচার সহিবে না।
মৃত্যু-ঘন্টা এই বুঝি বাজে, ধেয়ে আসে শাপ তাঁর,
শোধ নেবে খোদা, নহে এ ধরার ভণ্ডামি রাজবিচার।
মাটির মায়ায় সিক্ত হয়েছে দেহ-মন যাহাদেরি,
নিয়ন্ত্রণে র'বে তাহাদের ধরণীর রেলগাড়ি।
শিক্ষা পাই না, তাইতো ব্যঙ্গ করিছ 'মূর্খ' বলে,
আমাদেরি মাঝে মনুষ্যত্ব ধ্রুবতারা সম জ্বলে।
তোমরা মগজে জ্ঞানের বস্তা বহিয়া স্বার্থপর,
'মানুষ-ঠকানো-বিদ্যা' শিখেছ – মরে গেছে অন্তর!
অন্তর যার নাই, সে ভেতরে পশুর স্বভাব বহে,
মানুষের দুখে কাঁদে না যে জন, তারে অমানুষ কহে!
শ্রমিকের দান তোমারে বাঁচায় – মোদের অধিকার নাই,
মোদের অন্ন খাও, আর মোরা তোমাদের লাথি খাই!
আর সহিব না জুলুম, মানিয়া লইব না অবিচার,
মুখ বুঁজে আর সহিব না কভু তোমাদের অত্যাচার!
লজ্জা ঢাকিতে পারি না, জোটে না ছিন্ন খন্ড-কাপড়,
তোমার বস্ত্র কাড়িয়া ছিঁড়িয়া করিব দিগম্বর!
মোদের অন্ন কেড়েছ, কেড়েছ মোদের মুখের গ্রাস,
তোমাদেরি তরে আসিছে দানব, ভীষণ সর্বনাশ! –
খোদা সেজে আজ বসে আছো শিরে, তুমি সমাজের মাথা,
ঊর্ধ্ব-আকাশে বসে রয় জেনো, খোদার উপরে খোদা।
তিনি সহেন না বান্দার উপর বিন্দু-অত্যাচার,
অবকাশ শেষ হয়ে এলে পড়ে তাঁহার প্রবল মার!
দু’মুঠো অন্ন দাওনি – হাড্ডি বের হল দেহ ফুঁড়ে,
আদেশ দিয়াছে খোদা – তব গ্রাস কাড়িয়া লইব মেরে!
মানুষের ‘পরে যদি নেমে আসে শোষণ, অত্যাচার,
অত্যাচারীরে রুখিয়া দাঁড়াও – এ আদেশ আল্লার!
রক্ত, মাংস শুষিয়া মোদেরে করিয়াছ কঙ্কাল,
দূর করে দেব লাথিতে, - তোমরা সমাজের জঞ্জাল।
তোমার বিলাস-প্রাসাদ গড়েছি, দিয়া আমাদেরি হাড়,
গুঁড়িয়ে দেব সে প্রাসাদ, ধরেছি হাতুড়ি ও হাতিয়ার!


সুদিন আসিছে ফিরে –
শ্রমিকের ঈদ আসিবে, র'বে না বঞ্চিত অধিকারে!
মানুষের মত বাঁচার অধিকার ফিরিয়া পাইবে ওরা,
যাদের হাতের দানে টিকে আছে আজিও বসুন্ধরা!
তামাম ধরণী যাহাদের প্রাণ-সুধা শুষে বেঁচে আছে,
লাঞ্ছনা সহিবে না তারা, সেই শ্রমিকেরা জাগিয়াছে!
বিশ্বের বুকে যত নিপীড়িত শ্রমিকের হোক জয়,
ধ্বনিয়া উঠুক শ্রমিকের জয়গান এ বিশ্বময়!


(উত্সর্গঃ শোষিত, বঞ্চিত শ্রমিকদেরকে)