নিপা তখন দু’চোখে যমুনাকে ধরেছিল
ওর দিকে তাকায়ে পৃথিবীর সমস্ত ব্যথা আমার বুকে
বলল সে, ‘এভাবে আর কতদিন বাবাকে ঠেকিয়ে রাখব?
দু’মাস,চার মাস,বড় জোর এক বছর! একটা কিছু কর!!
আর কতদিন বেকার থাকবা?’
সত্যি তো, আর কতদিন বেকার থাকব আমি?


বললাম, ‘আর মাত্র কয়েকটা দিন’।
ছোট একটা বাসা নেব, বারান্দায় একটা দোলনা ঝোলাবো
গভীর রাতে ঘুম ভেঙে নিয়ন বাতির আলো জ্বেলে দেখব তোমাকে
দেখে দেখে এ চোখের তৃষ্ণা মেটাবো;
তুমি যদি জেগে যাও একসাথে সেখানে ঝুলব দু’জনে।
তারপর পিনপতন নীরবতা দু’জনের দুটি দীর্ঘশ্বাস
নীরবতা ভাঙতে বলে চললাম বড় ভাইয়ের বন্ধুদের বলেছি
চাচাকে বলেছি,মামাকে বলেছি,তাদের বন্ধুদের বলেছি
আমার যেকোনো একটা চাকরী চাই; সবাই বলেছে ‘হয়ে যাবে’।
বাবাও বলেছে, ‘যত টাকা লাগবে দেব আমি।’
শুনে ওর চোখটা তখন খুশির আলোতে ঝলমল করে উঠলো
সে এক অপরূপ সৌন্দর্য; কোনদিন দেখিনি ওর চোখে।
ওর পাশে বসে কিছু সময় কাটল স্বপ্ন এঁকে এঁকে
যাবার সময় সে বলল শুধু ’চলি!’
যখন পিছন ফিরে চাইল,দেখলাম ওর চোখে যমুনার ধারা
কেন কি গভীর দুঃখ ওর মনে বুঝিনি আমি সেদিন।
বুঝেছি একটা চাকরী ভীষণ দরকার আমার!


মাথায় আসে না কে এত ভালো পাত্র? যার জন্য ওকে হারাতে হবে!
‘ভাল মানুষ ভাল পাত্র হয় না
ভালো পাত্রের ভালো চাকরী থাকে, ভালো টাকা থাকে।’
বাবার উপর এখন আমার ভীষণ রাগ হয়
বলত ‘বুঝলি! ভাল মানুষ হওয়া বিরাট কঠিন। তোরা ভাল মানুষ হ’।
মানুষ কাকে বলে! বলে দেয়নি; আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি।


নিপার ব্যকুল করা কণ্ঠ সারাক্ষণ মনে পড়ে ‘একটা কিছু কর!’
একটা চাকরীর জন্য এখানে সেখানে ছুটে বেড়াই। লজ্জায়, যোগাযোগ কমে গেছে!
হয়তো সে বলবে, ‘চাকরী হলো’? কি উত্তর দেব তাকে?
একদিন রাতে ঘুম আসছে না
ফোন বন্ধ পেয়ে বুকের মধ্যে অজানা আশংকা জেগে উঠলো।
ওর ভীষণ অসুখ করেনি তো?
নাকি একমুঠো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে।
দুর্ভাবনায় কেটেছে আমার সারা রাত
কাক ডাকা ভোরে আমার ফোন ওর বান্ধবীর ঘুম ভাঙিয়ে দিল
তখনও আমার গলায় গভীর উৎকণ্ঠা ঝরে পড়ছে
‘কেমন আছে ও!’
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে একটু থেমে থেকেই বলল সে,
‘তুমি জান না কিছু? দিন-তিনেক হলো নিপার বিয়ে হয়ে গেছে
তোমার জন্য ও ভীষণ কান্নাকাটি করছিল।’
আর কিছুই শুনতে চাইনি আমি; লাইনটা কেটে দিলাম।
আমার পৃথিবী যেন ফাঁকা হয়ে গেল
সেই থেকে কত নির্ঘুম রাত কেটেছে দুঃস্বপ্ন নিয়ে!
একাকী মাঝরাতে রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছি কত!!
সেই কণ্ঠ আমাকে ঘুমাতে দেয়নি-‘একটু কিছু কর!’


হ্যাঁ একটা কিছু আমাকে করতেই হবে।
আমাকে ভালো মানুষ নয় ভালো পাত্র হতে হবে।
এখন আমি ভালো পাত্র হয়ে সংসার পেতেছি
তবুও নিপাকে হারানোর সেই ব্যথা
হৃদয়ের গোপন কোণ থেকে উঠে এসে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
একদিন একটা অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি আমি
গাড়ির দরজা খুলে নেমেই চমকে গেলাম
বহুদিন পর আমরা দু’জন মুখোমুখি।
বললাম তুমি এখানে? ওর ঠোঁট দু’টো তখন ভীষণ কাঁপছিল
বলল সে,‘আমার হাজবেন্ডের পোস্টিং এখানে।’
তারপর মানুষের ভিড়ে চেয়ারে সে
আমি অতিথির আসনে অন্যমনস্ক।
অনুষ্ঠান শেষে সে উঠে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল আমার দিকে চেয়ে
আমি বিদায় নিতে কাছে গিয়ে বলেছিলাম শুধু ‘চলি’
তখন ওর দু’চোখে যমুনার ধারা,বিষাদে মাখা।
একদিন ঐ চোখে দেখেছিলাম যে আলো আজ তা নিভে গেছে।