আমার শৈশবের কথা ভাবতেই টেকপাড়ার মগদের কথা মনে পড়ে;
কৈশোরের স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে আমার প্রাণের বন্ধু তুষার বড়ুয়া,
স্কুলে আমার বন্ধুদের মধ্যে ছিল প্রদীপ ও সঞ্জীব; বিসু’ই কেবল
পাকসেনাদের গুলিতে পড়লো আর অপু স্থায়ীভাবেই ভারত চলে গেল
যুদ্ধের অনেক আগেই।
হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের কথা বলতে গিয়ে আমাদের কন্ঠ ভারী হতো,
      ভিজে উঠতো চোখ।


আব্বার সহপাঠি ছিলেন তিন-কড়ি দাস, সে কি গমগমে কন্ঠস্বর!
পুজো-পার্বনে হাঁড়ি ভর্তি নাড়ু নিয়ে হাজির হতেন আমাদের বাড়ীতে
জমিয়ে গল্প করতেন খুব, তাঁদের তারুণ্যের যৌবনের গল্প;
                                  আমরা অবাক বিস্ময়ে শুনতাম।
আমার জন্মের সময় ডাক্তার সুধীর বিশ্বাসের আন্তরিকতার কথা
আব্বার মুখে বহুবার শুনেছি।
আমাদের গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার
হরেকেষ্ট দাশ একবার আব্বাকে অনুরোধ করলেন, “সবাই জেনে গেছে
আমি সবকিছু বেচে ভারতে চলে যাচ্ছি, তাই জমিটার দাম পাচ্ছিনা;
তুই কি একটু হাত বাড়াবি?”
সেই সহপাঠিকেও আব্বা সবটুকু সহায়তা করেছিলেন।


চৌধুরী বাড়ীর পুজা মন্ডপে আমরা যেতাম সন্দেশের লোভেই;
আমার বন্ধুরাও কুরবানীর রাতে এসে বেশ ভালভাবেই
খাওয়া-দাওয়া করে যেত আমাদের বাড়ীতে; কোন বিতন্ডা হলে
আম্মা বলতেন, “এনিয়ে কথা না বলাই ভাল; ছেলেরা তো
একটু আনন্দ করবেই!”
এইভাবে হাসি-কান্নায় মিলেমিশে ছিলাম আমরা, আবহমানকাল--


মগপাড়ার ঘরে ঘরে ছিল আমাদের অশেষ যত্ন-আত্তি ও আদর,
তুষারের মা আঁচলে আমার ঘাম মুছে দিয়ে এক বাটি দুধ
তুলে দিয়েছিলেন পরম যত্নে,
                         সেই উষ্ণতা আজো গালে লেগে আছে;
প্রদীপ সঞ্জীব অপুদের সাথে ঠুসোঠুসি খুনসুটি আর কাঁধে কাঁধে
হাত রেখে দীর্ঘ গল্পে হেঁটে বেড়ানোর স্মৃতি
এখনো আমার হৃদয়ে জ্বলজ্বলে ও স্থিত হয়ে আছে।


অঘটনও কম ঘটেনি।
চিতাখোলার কুকুরটা আমাদের বরাবরই তাড়া করতো আর
একবার বড়ুয়াপাড়ায় ফুটবল খেলতে গিয়ে মারামারি করেছিলাম খুব।
হিন্দুপাড়ায় রাতে নাটক দেখতে গিয়ে কি এক কান্ড ঘটালো ছেলেরা,
সেই দলে শ্যামলও ছিল মাহবুবও ছিল, বহু দেন-দরবার হলো, পরে
উমা দত্ত শহরে চলে গেলো, শুনলাম!
বাংলার শিক্ষক অমল নাথ আমাকে খেলাঘর আসরে নিয়ে গেলেন আর
অঙ্কের দুলাল পাল যেন আজো আমাকে শাসন করেন অসাধারণ মমতায়।
এক বাড়ীতেই যেন বেড়ে উঠেছি সবধর্মের মানুষগুলো আমাদের গ্রামে!


স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমরাই তো পাহারা দিয়েছি ওদের বাড়ী-ঘর,
ওদের আশ্রয় দিয়েছি আমাদের অন্দর মহলে; এরপর থেকে
আমাদের বাড়ী হয়ে গেল ওদেরই বাড়ী।
তারপরও বিগত কয়েক যুগ ধরে যেভাবে আমরা এক হয়ে বেঁচে আছি
সেখানে হঠাৎ কারা বিদ্বেষ ও ঘৃণার কালিমা লেপে দিলো আজ!
সামাজিক প্রশান্তির ভেতর কারা যেন ঢেলে দিচ্ছে রাজনীতির তেতো;
সাজাচ্ছে নাটক বুনছে গল্প আর কুৎসিত অন্তর নিয়ে মিথ্যাচারে মত্ত
কিছু পেঁচা ও শেয়াল কপট হৃদয়ে বলছে, “এত্তা জঞ্জাল!”


শুনে রাখুক পৃথিবীর মানুষ
আমার সমগ্র অন্তর ও শৈশব স্মৃতি চিৎকার করে বলছেঃ
আমাদের গ্রামে কোন সাম্প্রদায়িকতা কখনো ছিলনা, আর
আমাদের দেশে কোন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নেই;
রাজনৈতিক বিদ্বেষ দিয়ে যারা সুস্থ পরিবেশকে নষ্ট করে
তারা আমাদের কেউ নয়!
ওরাই বর্ণচোরা গণশত্রু।