আমি এখন প্রৌঢ়া,
আজ আঠাশে শ্রাবণ
আকাশে হঠাত মেঘের আবির্ভাব
পাত্র পক্ষের বিচলিত প্রশ্নে আমিও অপ্রস্তত
হতচকিত হয়ে খুঁজি পালিয়ে যাওয়ার পথ।
পাত্র পক্ষের সোজা উত্তর, আমাকে দেখতে এসে
আমার ছোট বোনকে ই তাদের পছন্দ।


এ আর নতুন কি?
কবে থেকে যে আমি বুঝতে শিখেছি,
দুঃখ-সুখের পার্থক্য করতে পেরেছি,
কালো বলে বন্ধু থেকে পরশী পর্যন্ত
কটূক্তি সহ্য করার মানসিকতাকে তৈরি করতে শিখেছি,
তা এখন আমার মনেই পড়েনা।


ধানমন্ডির সাতাশের এই উনিশ নম্বর বাড়িটার
ইট পাথরের দালানটা আবারও সাক্ষি চৌত্রিশ বছরের
আমার এই শরীর টা ২১ বার রিজেক্ট হলো।
কারণ কি জানেন? আমি কালো বলে!


আমার চোখ, ঠোঁট, চিবুক,হাতের আঙ্গুল
আঙ্গুলের নখ, বুক, পিঠ, নিম্নাংশ সবই নাহয় কালো,
আমি মেনেই নিলাম।কিন্তু আমার রক্ত,
ধমনী,শিরা,উপশিরা, বৃহদান্ত্র, ক্ষুদ্রান্ত্র
বুকের ভেতরের কষ্টের কুণ্ডলী গুলোর রঙতো
লাল,নীল, বেগুনি আর ধুসর।

আমার বোনও মতিঝিলের ব্যবসায়ী ইঞ্জিনিয়ার
ছেলের প্রস্তাবে মহা খুশি। বাহারি রঙের এলিয়ন,
প্রিমিও গাড়ি, উত্তরায় ৩ টি ফ্লাটের মালিক।
কেই বা খুশি হবেনা বলুন? এতকিছুর মাঝেও কি
লজ্জা কিংবা মানবিকতা বেঁচে থাকে?


পিতৃহীন সমাজে মায়ের আঁচলেই শেষ ভরসা
খুঁজেছিলাম অহর্নিশ, কিন্তু সেই মা’ও
আজ খুশি তার রূপসী কন্যা সম্প্রদানে,
হোক সে ছোট কিংবা অসংযত,
তাতে ঘুণে ধরা এই সমাজের কিছু আসে যায়না।
আমি কালো বলে! নাকি তাদের যোগ্য নই?
আমার শরীরের এই রঙটাই নাকি যোগ্যতার মাপকাঠি?
সাদা ধবধবে ফর্সা নাকি তারা ডিজার্ভ করে!
আমাকে নিয়ে তাদের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-সজনের
সামনে মুখ দেখাবে কি করে?


সুজন আমার বন্ধুর নাম, বেষ্ট ফ্রেন্ড ছিলো,  
পছন্দ করতো আমাকে, ভালোবাসতো আমাকে
কিন্তু বিয়ের কথা বলায় সেও ভার্সিটিতে আমায়
ইগনোর করা শুরু করলো।


এই পৃথিবীতে আমি কি সত্যিই বেমানান,
কুশ্রী ? বিদগ্ধা ? আমি কি নিজেই শরীরে
কালো রং মেখেছি? নাকি আমাকেই আমি
তৈরি করেছি? নানান প্রশ্নবানে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছি।


চিৎকার করতে করতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে
পরে মেয়েটি, মা এবং বোনের আকুতি ভুলে
নেমে পরে রাস্তায়, সমাজের কলংক মুছে দেবার প্রত্যয়ে।
বাবার দরদমাখা অবয়বখানি ভেসে ওঠে তার ধুসর মনে
ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে, নিস্তব্ধ একা সন্ধ্যায়।


ভেবেছিলো কোনো এক বিকেলের পড়ন্ত রোদের হালকা পরশে,
বাঁধিতে চেয়েছিলো মনলতায় বাহুযুগলে, প্রগাঢ় রঙিন স্নিগ্ধ আবেশে,
অনন্তকাল এভাবেই রাখতে চেয়েছিলো আপন করে তার প্রিয়তম রে,
কে জানে এমনি করে হাড়িয়ে যাবে মনেরও গহীন অরণ্যে।


এই যে শুনছেন? ভারতীয় রাষ্ট্রপতি একজন আদিবাসী
দ্রৌপদী মুর্মুকে দেখেছেন আপনারা? তার শরীরের রঙ দেখেছেন?
কিভাবে মেপেছেন তার যোগ্যতা?
যোগ্যতা শরীরের রঙ নয়, আগে মানুষকে মানুষ ভাবতে শিখুন।


এ নতুন নয়, বর্ণ বৈষম্যের চোরাবালিতে হাড়িয়ে যায়
যোগ্যতা নামক হাজারো সম্ভাবনার কালো প্রৌঢ়া’রা
ধিক্কার এই অথর্ব সমাজের নোংরা মানসিক রোগীদের।

রচনা কালঃ  সকাল ৯.৩০ মিনিট
২০শে ডিসেম্বর মঙ্গলবার ২০২২ খৃষ্টাব্দ
গাজীপুর , বাংলাদেশ থেকে
© Copyright সংরক্ষিত ®