[যুবকের বিরহকাল। হঠাৎ তার প্রিয়তমা হয়ে গেছে অন্যের ঘরণী। কাঁচের টুকরোর মতো ঝন ঝন করে ভেঙ্গে গেছে তার প্রেম। তাই অঘুমের নদী হয়ে আসে তার প্রতিটি রাত। চৈতন্যে স্বপ্নছবি হয়ে আসে প্রিয়তমা। হাসে-কাঁদে, কথা বলে। যুবকের মনে তৈরি হয় এক পরাবাস্তব জগত। যুবক কথা বলে। সে বুঝতে পারে তার প্রতিটি কথার জবাব দিচ্ছে প্রিয়তমা। ]
 
 
 
 
 
 
 

          ১
মধ্যরাতে দূরাগত হাওয়ার ধবনি শুনতে পেলে  
আত্মার ভেতর বেজে ওঠে গোপন আর্তনাদ ।
স্রোতের প্রতিকূলে আসে স্রোত 
অবসাদে বনানীলতার মতো জীবন 
ধরে রাখি আত্মজ ছায়ার ভেতর । 
তবুও সময়ের হিসেব কষে 
বারবার ফিরে আসে স্বপ্নছবি ।
সবুজ ধানক্ষেত, শিশির ভেজা ঘাস
শীতের ভোরে কুয়াশার ভেতর পুকুর ঘাটে
পা ঝুলিয়ে যুগল বসে থাকা।
 
কেন স্বপ্নের মতো সব ফিরে আসে,
তুমি কী কেবল স্বপ্ন, অলীক মোহ,  
নাকি আমার আত্মার অনন্ত- তৃষ্ণা ?
কেন ফিরে আস চেতনা-চৈতন্যে 
গোপন প্রলয় প্রতীকের মত ?                     
 

পৃথিবী কী সূর্যকে আবর্তন না করে পারে , 
চাঁদের আবর্তন কী পৃথিবীর দিকে নয় , 
এখনও কী সমুদ্রের ডাকে নদী চঞ্চল হয়ে ওঠে না, 
হেমন্তের ডাকে ঝরে পড়া শিশিরে 
পুলকিত হয়ে ওঠে না ঘাস ? 
বল, মেঘ কী কখনও মুছে ফেলতে পারে জলের দাগ ? 
বাঁশি যখন বাজে ঐ বৃন্দাবনে
জানো রাধিকা ভুলে যায় স্বীয় জাতকুল । 
তোমার আহবানে এখনও আমি উতলা হয়ে উঠি । 
ফাগুনের চঞ্চল হাওয়া আমার হৃদয়ে ফুল ফুটায়,
লাল লাল ফুল, টুকটুকে লাল।
ইচ্ছে করে পাখির মতো উড়ে গিয়ে
তোমার জানালার ধারে বসি।


মাঝে মাঝে মনে হয় মেহগনি জানালার কপাটে 
রাতপাখির মত বড় একা 
বসে আছ চুপচাপ । 
কিংবা আমার টবে হঠাৎ ফুটা
রাতের রাণী ফুলের মতো তুমি জেগে আছো । 
কখনো মনে হয় তুমি ভয়ঙ্কর রাতের মতো
চতুর্দিক থেকে জড়িয়ে আছো আমাকে।
কখনো তুমি সময়ের অতীত
দীর্ঘ সময়ের ধুলো জমে জমে বিবর্ণ আমার মন 
আজ আর মনেই করতে পারি না ; 
সেদিন কি মধুর নাম ধরে ডেকেছিলাম তোমাকে । 


কি মধুর মুহূর্তগুলো আজো ভুলিনি ! 
একদিন ঝাউবন পেরিয়ে হঠাৎ বালিয়াড়িতে দেখেছিলাম 
বেগনি ভোলাফুল ফুটেছিল কতো, আর  
বালির বুকে বিছানো লতায় কি যে মায়া !
মুঠো ভর্তি ঘাসফুল তুলে
চুলে গুঁজে দেয়ার মতো দুষ্টামি তুমি প্রায় করতে।
ফুলের মাঝেই তুমি আমাকে করেছিলে আবিষ্কার
কখনও আমি ছিলাম তোমার গোলাপ 
কখনও চম্পা, জুঁই, চামেলী 
আবার কখনও ভোরের সুগন্ধ শিউলি । 
একবার আমার বুকের গন্ধ নিয়ে বলেছিলে , 
আমি নাকি হাস্নুহেনা । 
তোমার বহু বিশেষণে 
আমার কোন নামই দাঁড়াইনি । 
কেবল মনে হয় আজো আমি অনামিকা । 


সেদিন ঝাউবনে শোভন ছায়ার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে , 
আমার মনে হয়েছিল নাম বড় সুনির্দিষ্ট । 
তুমি ছিলে আমার মহাবিশ্ব , অনন্তের চেয়ে অনন্ত । 
একটি ছোট্ট নামের ভেতর তোমার অস্তিত্ব 
আমি ভাবতে পারিনি কখনও । 
তুমি আমার আত্মার অনুভবে বর্ণালী রংধনু 
মহাকালের স্বপ্নকুমারী । 
তুমি কুমারী পাহাড়ের প্রস্রবন
স্বর্গের তটিনী
আমার হৃদয়ের মধ্যবিন্দু থেকে প্রবাহিত 
একটি গোপন নদীর উৎসমুখ । 
    
     ৬
মাঝে মাঝে মনে হয় আমি নদীর উপমা । 
আমার ভেতরে কলকল ধবনি-মূর্ছনা 
প্রকৃতিকে বেঁধে দেয় গান।
বিহঙ্গ সে গান শিখে
অবিরল আমাকে বিহ্বল করে তুলে । 
হাজার নক্ষত্র ভরা 
রাতের আকাশ দেখতে দেখতে 
পৃথিবী যখন ঘুমিয়ে পড়ে , 
আমি শুনতে পাই এক অদৃশ্য আহবান
নিরবধি বহমান একটি আদি-নদীর ডাক
আমাকে পাগল করে তোলে।


একবার নদী বলে ডাকতেই তুমি ছুঠে এলে । 
মনে পড়ে ? 
তুমি এসেছিলে অবিকল নদীর প্রতিরূপ হয়ে , 
নিঃশ্বাসে ছিল নদীর কলকল ধবনি , 
বাতাসে উড়ন্ত চুল যেন নদীর দূরন্ত-স্রোত । 
তোমার আড়ালে ঢাকা পড়েছিল শরতের কাশবন ; 
জালের মত হাঁসের ঝাঁক 
উড়ে যাচ্ছে মেঘের নিচ দিয়ে। 
আর কিয়দূরে , 
পালহীন নৌকাতে
খেয়ামাঝি পারানির জন্য সে কি ডাকাডাকি ! 
চরাচরে অদ্ভূত নির্জনতা
সেদিন আমি আত্মস্থ করেছি নির্জনতার ভাষা 
যা আমার কিশোর চোখে দিয়েছিলো , 
অবারিত স্বপ্নের নীলঢেউ । 


তুমি সেই কিশোর ?
যার নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ার দুঃসাহস ছিল।  


মনে পড়ে তাহলে ! 
পুরানো একটি নদী
ভাঙ্গাচোরা ঘাট
বটের ছায়ায় দাঁড়িয়ে
পাল তোলা নৌকার মাস্তলের উপর
বালিহাঁসের উড়াউড়ি দেখা।

১০
 
কী করে ভুলে যাব- 
সেই সোনারোঁদে ফোটা ভাঁটফুল , বাতাসে লবণ গন্ধ , 
কেয়াবনে সবুজ গঙ্গাফড়িং , শালিক ছানার ভয়ার্ত চোখ
আর মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে গেলে , 
মেঘে ঢাকা ধূসর পাহাড়ের হাতছানি । 
তারপর অনাবিল উচ্ছ্বাসে ; 
নীল আকাশে মেঘের ঘুড়ি হয়ে , 
উড়ে যেত এক যুগল কিশোর- কিশোরী । 
আজ মনে হয় কি যেন নেই 
কোথায় হারিয়ে এসেছি পুরনো দিনের স্বর্গ । 

১১
আজ কতকিছু নেই 
শিশুর খেলনার মত হারিয়েছি শৈশব , 
যৌবনের মধুর দিনগুলি । 
নিজের অস্তিত্বের উপর বিশ্বাসও হারিয়েছি । 
তুমি যাওয়ার পর 
গাড়ির চাকার মত ঘুরে আসে সময়ের চাকা ; 
ঋতু যায় ঋতু আসে , 
বৃক্ষের শাখা থেকে ঝরে যায় 
অবাঞ্ছিত পাতা । 
স্বর্গ থেকে পতনের মত 
নিজেকে মনে হয় 
কুয়াশার বুক থেকে ঝরে যাওয়া 
একবিন্দু শিশির । 
তবুও হৃদয়ের টানে কতদিন গিয়েছি , 
একটি পুরনো নদীর ভগ্ন কিনারে । 
যদি ফিরে পাই শৈশব 
কিংবা একটি কিশোরের সাদাকালো ছবি । 
কেবল রোঁদের ভেতর আচমন সেরে 
আমি যেন রোঁদক্লান্ত তামাটে পথিক ; 
যাকে ঘিরে আছে 
মুমূর্শ নদীর নিঃশ্বাস । 
হয়ত নদীটি এখনও 
মেঘে মেঘে ভাসিয়ে দেয় স্বপ্নের সাম্পান । 
জানিনা কোন মায়াঘুমে 
আমার স্বপ্নগুলো আচ্ছন্ন হয়ে থাকে । 
শুধু একবার, শুধু একবার 
তুমি কী পারনা ফিরিয়ে দিতে 
আমার শৈশব, হারিয়ে যাওয়া মধুর মুহূর্তগুলো ? 

১২
না । আমার ক্ষমতা নেই । 
আমার দুদিকে শাসনের দেয়াল
যেন এক বশীকরণ স্রোতের নদী আমি
মাঝে মাঝে নিজেকে শোকেসের পুতুল মনে হয় । 
যার চোখ আছে কিন্তু দেখতে পায় না
কান আছে শোনার ক্ষমতা নেই
আজ মনে হয় আমি এমন কিছু হারিয়েছি 
যা আমাকে ভয়ানক নিঃস্ব করেছে , 
অঢেল প্রাচুর্যের মাঝে আমি মরুর মেঘ । 

১৩
তুমি নিঃস্ব নও । তোমার অনেক আছে ।            
তুমি পুরাণের পাতার কাল্পনিক দেবীও নও, 
শুধু আমার আত্মার মন্দিরে 
তোমাকেই আমি দেবী বলে জানি 
আজো দেবীই আছো , 
সারাজীবন দেবীই থাকবে । 
তুমি আমার মহামায়া 
ধূপের ধোঁয়ায় তুমি অসামান্যা ; 
তোমার দৃষ্টি যেন রামচন্দ্রের ধনুকের তীর
শক্তির গোপন মন্ত্র কৌশলে লুকিয়ে রাখ তুমি । 

১৪
কেন আমার শিরে তোলে দিতে চাও
দেবীত্বের অলৌকিক মুকুট।  
চতুর পুরুষ তুমি
অবলীলায় সাঁতার কেটে
পার হয়ে আস স্বার্থের নদী।
তাই নারীকে বানাও কখনো দাসী
আবার কখনো দেবী।
আমার ভয় হয় কারণ
আমি তো সামান্য নারী । 

১৫
নারী তো দেবীই
পুরুষ যাকে কামনা করে অন্তর থেকে।

১৬
বুঝতে পারিনা , 
সবকিছু গোলমাল মনে হয় । 
যখন দেবী বলে ডাক ; 
আড়ালে দেখতে পাই কুঠিল স্বার্থ । 
আবার নারী বলে ডাক যখন 
সেখানে দেখি অবিরল উড়ছে 
এক শিকারী ঈগল । 
তখন তোমাকে খুব বেশি পুরুষ মনে হয় । 

১৭
পুরুষ প্রেমিকও বটে ! 
তাই আত্মায় নির্মাণ করেছি প্রেমাশ্রম । 
সেখানে আমি সাধক, 
আমিই পুজারী । 
গভীর অনুরাগে তিলে তিলে নির্মাণ করেছি তোমাকে , 
তুমিই আমার প্রথম শিল্প , 
আমার সারা জীবনের সরস্বতী , 
গৃহদেবী লক্ষ্মী আমি তোমাকেই ডাকি , 
চুড়ান্তভাবে তুমি আমার নারী । 
আমার হৃদয়ের ডাকঘরে তোমার নামে জমা আছে 
হাজার পোষ্টখাম । 

১৮
তোমার হৃদয়ের ডাক এখনও শুনতে পাই । 
যখন আকাশে তারা সব জ্বলে ওঠে , 
ভোরের প্রথম আলোতে 
শিউলীরা যখন ঝলমল করে হাসে , 
বর্ষার তুখোড় বৃষ্টিতে 
নিসর্গ ভিজে যখন শীতল হয়ে আসে , 
কিংবা চাঁদ যখন না ডুবার প্রত্যয়ে 
সারারাত জেগে থাকে আকাশে , 
ঠিক তখন চারপাশ থেকে তোমার নিঃশ্বাস 
আমাকে ঘিরে ধরে । 
তখন মনে হয় বঙ্গোপসাগরের পশ্চিমকোণ থেকে 
ধেয়ে আসছে কীর্তিনাশা ঝড় ; 

১৯
যদি তাই হবে 
তবে কেন আর 
আকাশ ও মাটির দূরত্ব নিয়ে মিছে ভাবনা , 
কীসের অন্তরালে নিজেকে আড়াল করেছ ? 
একবার প্রকাশিত হও 
দিবসের নক্ষত্রের মতো । 
লাবণির চরের মতো এই আমার উদ্দাম বুক 
এখনও তোমার প্রতীক্ষায় উম্মুখ হয়ে আছে । 
পাঁজরের প্রান্তরে একবার রাখ করতল 
দেখবে, কী উষ্ণতায় ভরে গিয়েছ তুমি । 
এসো দেবী, 
বিমুগ্ধ রাত্রির অন্ধকারে 
পানের লতার মত তোমাকে জড়িয়ে রাখি । 
এসো, এসো আমার আলিঙ্গনে । 

২০
না । তুমি তো পুরুষ । 
এখনও পুরুষই আছো 
আমি অনস্তিত্ব সত্তা , 
আমি শুধু তোমার স্বপ্নছবি, কল্পনার আনন্দ । 
যে কণামাত্র নির্দিষ্ট নয় 
তাকে কীভাবে জড়াবে ? 

২১
অসম্ভব তো নয় ! 
অসম্ভবের মাঝে সম্ভাবনার ফুল ফোটানো 
পুরুষের ধর্ম । 
মনে আছে - 
বর্ষণের রাত , 
আকাশ ফেটে চমকানো বিদ্যুৎ 
মেঘ ভেঙ্গে ছড়িয়ে দিচ্ছিল ঘুমন্ত পৃথিবীর উপর । 
মনে হচ্ছিল, পৃথিবী যেন তার অপার বিস্ময় নিয়ে 
তলিয়ে যাবে জলের অতলে । 
তুমি এসেছে,
পরেছ পরীর পোশাকটি । 
তুষার স্নিগ্ধ সাদা মসলিন , 
পুরো পোশাকজুড়ে রূপোর চুমকিতে নকশা আঁকা , 
বুকের উপর ঘন পুঁতির কাজ , উজ্জ্বল কনককান্তিও
তোমার উন্নত স্তনকে আড়াল করতে পারেনি । 
শিশিরভেজা অধর নিয়ে 
তুমি এসে দাঁড়ালে আমার সামনে 
যেন সাক্ষাৎ বানেছাপরী । 
বাইরে তুমুল আষাঢ়মাস ; 
সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে
সেদিন আমি ছিলাম বিজয়ী বীর।

২২
তুমি অভিশপ্ত 
আলোহীন নক্ষত্রের মত বেঁচে থাকবে কীর্তিহীন । 
মাতাল নদীর মতো  
ভাঙ্গনের শব্দ শুনে যাবে রাতদিন।  

২৩
তোমার অভিশাপও মনে হয় আশীর্বাদ । 
তাই আবেগকে জ্বালিয়ে রাখি নিশিদিন
যাতে ভালোবাসা দীর্ঘজীবী হয়।


২৪
কেন মনে হয় ? কী চাও তুমি ?
কেন আমার শান্তি বিনষ্ট কর ?

২৫
তুমি ছিলে আমার আত্মার বৃক্ষ।  
দিনে দিনে সে বৃক্ষ হয়েছে মহীরুহ।
আজ আমাকে শীতল ছায়া দাও,
ফুল দাও
ফল দাও । 
এই অতৃপ্ত আত্মাকে করুনা ধারায় তৃপ্ত কর । 
 
২৬
আমি তো নিষিদ্ধ বৃক্ষ 
এর ছায়াতে
তুমি এসো না পুরুষ।  
তুমি কী চাও
স্বর্গ থেকে তোমার পতন ? 

২৭
স্বর্গের অপ্সরীরা পারে না ভাঙ্গাতে
আমার ধ্যান।
আমি ধ্যানগ্রস্থ এক প্রেমিক
বল, তোমার অভিকর্ষ থেকে
আমি কী করে বিচ্যুত হবো !  
তাই পতনেই যদি তোমাকে পাই 
তবে তাই হোক তোমার আশীর্বাদ । 

২৮
তোমাকে আমি কী দিতে পারি ? 
আমার যে কিছুই নেই । 
অন্তরের সমস্ত কামনা যখন মরে যায় 
সেই বৃক্ষে আর ফুল হয়না, ফলও হয়না 
বনস্পতি বৃক্ষে তুমি আর দিও না অঞ্জলি । 

২৯
তোমার ভেতরে আছে আরেক তুমি 
চাঁদের ভেতর যেমন জোছনা, 
ফুলের ভেতর লুকানো সৌরভ । 
আমি সেই অদৃশ্য আঘ্রাণের পুজারী । 
নৈবেদ্য সাজিয়ে বসে আছি 
করো না আমাকে বঞ্চিত । 

৩০
এখনও পাগল রয়ে গেছ ! 
এই নিঃস্তব্দ রাতের অন্ধকারে , 
কেন বারবার ডাক আমাকে ? 

৩১
এই পাষাণ প্রাচির ভেদ করে
তুমি ডাক শুনতে পাও
আকাশ-পাতাল দূরত্ব অতিক্রম করে
আমার ডাক শুনতে পাও ?                                

৩২
নয় তো কী ? 
যখন অভিমানে মেঘ হতে বলেছিলে 
পাওনি কী সাড়া ? 

৩৩
হা । মনে পড়েছে । 
আকাশের পূর্বকোণে
মেঘে মেঘে তোমার মুখ ছিল  
অভিমানে ঈষৎ হেলানো । 
কেন অভিমান ? 

৩৪
নিজেকে প্রশ্ন কর । 

৩৫
পাশ কাটিও না । 

৩৬
যদি বলি, ভীষণ কষ্ট পাবে । 

৩৭
এখন কী সুখে আছি ? 
পাশে তো নেই কেউ , 
না নদী , পাখি, ফুল, 
শ্যামল বৃক্ষের মায়াবী ছায়া,গন্ধমাখা ভাঁটফুল, 
হলুদ পোষ্টখামে লিখা ভালোবাসা শব্দটি ঘিরে 
কারো হৃদয়ের অফুরন্ত উচ্ছ্বাস, সবকিছু 
মহাবিশ্বের মত দূরগামী । 
নিঃসঙ্গ মানুষ , 
কেবল চারপাশ থেকে ভেসে আসে কীটের গুঞ্জন । 

৩৮
কেন একা ভাবো ? 
আমি তো তোমার পাশেই আছি । 

৩৯
বুঝতে পারিনা 
তোমার কতটুকু অস্তিত্ব 
না সম্পূর্ণটা অশরীরি । 
মায়াবী পর্দার আড়াল থেকে 
কতটুকু আর পাওয়া । 
মাঝে মাঝে সত্যবদ্ধ অঙ্গীকারও অভিযুক্ত হয় 
দাঁড়িয়ে পড়ে সন্দেহের কাঠগড়ায় । 

৪০
সন্দেহকে পাঠিয়ে দাও সীমানার বাইরে
এবার হৃৎ-চোখে দেখ 
এই আমার অস্তিত্ব, 
শুনতে পাচ্ছনা আমার ধবনি।
তোমার নিদ্রাহীন রাতে 
পৃথিবী যখন অন্ধকারের গান গেয়ে ওঠে , 
তখন তোমার শিয়রে আমিই তো দাঁড়িয়ে থাকি । 
আমি আছি শব্দে, ধবনিতে-প্রতিধ্বনিতে 
এমন কী তোমার কবিতায় । 
তোমার দুঃসংবাদের শিরোনামও আমি । 

৪১
দুঃসংবাদ ! 
বল, আর কত দুঃসংবাদ শুনাবে আমাকে । 
শুন তবে আমার দৃঢ় উচ্চারণ ; 
হিমালয় পর্বতের শপথ , 
বঙ্গোপসাগরের নীলঢেউয়ের শপথ , 
কবিতায় আর দুঃখ ছাপাব না । 
মুক্তি দাও, মুক্তি চাই - 
সমস্ত দুঃসংবাদ থেকে , 
নিঃসঙ্গ রাত্তির অন্ধকার থেকে । 
প্রেম চাই, প্রেম দাও - 
তোমার ওষ্ঠের মত চঞ্চল, চোখের মত গভীর , 
কাউছার হ্রদের পবিত্র পানির মত বিশুদ্ধ । 

৪২
আজ মন বড় চঞ্চল 
বিষণ্ণ মেঘের মত কেবল ওড়ছে । 
মনে হচ্ছে এক আকাশ বিষণ্ণতায় 
ঢেকে আছে আমার মন । 

৪৩
কেন বিষণ্ণতা ? 

৪৪
তুমি কী শুনতে পাচ্ছনা , 
নিসর্গের ফাঁকে ফাঁকে 
বরকতের মায়ের নিরাক ক্রন্দন ? 
তুমি কী দেখতে পাচ্ছনা, 
শহীদের রক্তঋনে গাছে গাছে লাল হল 
পলাশ আর কৃষ্ণচূড়া ? 
ঐ শুন একুশের শোভাযাত্রা থেকে 
ভেসে আসছে ফেব্রুয়ারির গান । 
সালাম,জব্বার,বরকত, রফিক 
ঘুম পাড়ানির গানে গানে 
ঘুমিয়ে গেছে কবরের দোলনাতে।  
শুনতে পাচ্ছ না ? 
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো 
একুশে ফেব্রুয়ারি 
আমি কী ভুলিতে পারি।” 

৪৫
বহুদিন আমি সঙ্গীতে বিমুখ , 
কোন গান আমাকে আর আন্দোলিত করেনা । 

৪৬
তবে তুমি আর প্রেমের উপযুক্ত নও । 
সঙ্গীত ছাড়া প্রেম শীতের বাতাসের মতো  
যেখানে আদ্রতা থাকে না । 
সঙ্গীতের মাঝেই প্রেমের লাবণ্য । 

৪৭
এখন তেমন হৃদয় জাগানো সুর শুনতে পাইনা । 
চতুর্দিকে বেসুরো হাওয়ার দাপাদাপি ; 
তুমি যাওয়ার পর শুনি নাই নদীর গান  
কেবল ভাঙ্গনের শব্দ শুনি । 
ঐ দেখ হিমছড়ির ঝর্ণা , 
নিরবধি ঝরছে ঝমঝম । 
মনে হয় এও যেন বঞ্চনার আর্তনাদ । 
ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল ডাস্টবিন ভেবে 
কোথা থেকে আসে কাক শকুনের দল 
জয়নুলের ছবির কাকও এসে ভিড়ে যায় তাদের দলে 
ওদের কোরাস শুনতে শুনতে আজ আমি বধীর । 
এ কি কম যন্রণা ! 
বল, যন্রণার চেয়ে বেশি দহন 
আমাকে আর কে দেবে ? 


৪৮
তবুও সঙ্গীত করে যন্ত্রণার বিনাশ । 
শুনতে পাচ্ছনা সেই কালজয়ী গানটি ? 
 
৪৯
আজ মনে হল , 
তুমি শুধু দেবী নও-মানবীও । 
এই কৃষ্ণচূড়ার লাল প্রভাতে 
কিঞ্চিত হলেও ভালোবাসা দাও 
আমি বড় ভালোবাসার কাঙ্গাল । 

৫০
এত ভুলো মন তোমার ! 
একদিন ভোরের কুয়াশার ভেতর এইখানে 
তুমি দাঁড়িয়ে থাকতে আমার প্রতীক্ষায় 
মনে কী পড়ে না তোমার ? 

৫১
মনে হয় আজ স্মৃতিও ঘুমিয়ে গেছে। 
এভাবেই তো বেঁচে আছি 
এই অন্ধকার নগরে । 

৫২
আজ মহান একুশ, 
শোকার্ত মেঘের শোভাযাত্রায় 
ঢেকে আছে ভোরের আকাশ । 
তবুও রক্ত-পলাশের ডাকে 
গর্বিত সূর্যোদয়ের এই দিনে ; 
দেখ, তোমার প্রতীক্ষায় কৃষ্ণচূড়া লালেলাল হল । 
 
৫৩
তুমি তো জান, 
অবাঞ্চিত ধুলোতে আজ আমি অন্ধ, 
কালের ধ্বনিতে বধীর । 
আমি সেই তৃণ, 
আমি সেই খড়কুটো , 
কেবল বাতাসে উড়তে উড়তে 
নীড়ের সন্ধান করি । 
মাঝে মাঝে মনে হয় , 
আমি যেন স্রোতের শেওলা । 
ভাসতে ভাসতে সাগর পেরিয়ে মহাসাগরে 
দিকহারা নাবিকের মত এলোমেলো ঘুরছি 
আমার চারদিকে শুধু জলের হিহিংস্রতা । 

৫৪
খুব বেশি অভিমান ; 
নয় কী ? 

৫৫
যে পুরুষ ভালোবাসতে শিখেনি, 
সে অভিমানও শিখেনি । 

৫৬
তবে ? 

৫৭
অভিযোগ । 
 
৫৮
অভিযোগ ! কেন ? 

৫৯
নিজেই নিজেকে দাঁড় করিয়েছি কাঠগড়ায় । 
আজ আমার বিরুদ্ধে আমি, 
হৃদয়ের রক্তাক্ত-প্রান্তরে চলছে লড়াই , 
এই লড়াইয়ে জয় নেই, পরাজয়ও নেই । 
কেবল শরবিদ্ধ পাখির মত ছটফটানিতে 
নিরন্তর ঝরে আত্মার শিশির । 

৬০
স্বপ্নভঙ্গের মনোবেদনা বড় ভয়ঙ্কর 
বিসুয়ভিয়াসের অগ্নিময় লাভার মত 
কেবল ধিকিধিকি জ্বলে । 

৬১
নিজের স্বপ্নভঙ্গের কথা মোটেও ভাবিনা । 
স্বপ্নভঙ্গের কথা ওঠলে মনে আসে জাতির জনক । 
যিনি স্বপ্ন দেখাতেন 
আমাদের সোনার দেশ হবে । 

৬২
কেন মনে পড়িয়ে দাও 
রক্তাত ১৫ আগস্ট । 
আমি যে কাঁদতেও পারিনা 
আবহমান কাল থেকে আমার চোখ নির্জল । 
বাষ্পহীন এ চোখের কথা ভাবলে 
মনে হয় আমি দেবী; 
দেবীর চোখে জল থাকে না । 

৬৩
একবার তার ডাক শুনে গিয়েছিলাম 
রেসকোর্সের বিশাল ময়দানে । 
তিনি ধীর পায়ে হেঁটে এলেন জনতার সমুদ্রে 
তারপর আমাদের মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়ে 
আবার ধীর পায়ে চলে গেলেন । 

৬৪
আজো তাঁর কথা ভেবে 
মেঘের অভিমান রোঁদ হয়ে যায়, 
কুয়াশা ঝরে হয় মহান শিশির, 
দারুন বিস্ময়ে চোখ মেলে ঘাসফুল, 
সন্ধের আকাশে উড়াউড়ি বন্ধ করে 
নীড়ে ফিরে পাখিরা, পুষ্পের টান ফেলে 
মৌমাছি ফিরে আসে মৌচাকে । 
তুমি জাননা,
তিনি বড় ভালোবাসতেন দুঃখিনী বাংলা।

৬৫
হাঃ ! দুঃখিনী বাংলা ! 
কবে ছিল কপালে তার ফুল- চন্দনের টিকা ; 
ইতিহাসের দিকে ফিরে দেখ একবার । 
দেখবে, বিজাতীয় পালের রাজ, 
শাহী সুলতান, মুঘল, পর্তুগীজ, বৃটিশ 
এবং সবশেষে পাকিস্তানের ফাঁদ । 
তারপর একাত্তর , 
রক্তস্নাত বাংলাদেশ । 
বিশ্বাস কর, কোথাও বিজয়ের হাসি দেখিনি 
কেবল দেখেছি মুজিবের চোখে জল । 

৬৬
আমিও হাসতে পারিনি । 

৬৭
কী করে পারবে ? 
তুমি যে মানবী । 

৬৮
যদি আবার দেবী বলে ডাক 
আমি আর আসবনা তোমার কাছে । 

৬৯
পারবে ? 
বৈশাখি ঝড় হয়ে যদি ডাকি তোমায় , 
তখন কী হবে ? 

৭০
তোমার সঙ্গে অভিমান চলে ? 
পাখির ডাকে যেমন সূর্য উঠে , 
মেঘের ডাকে ঝরে বৃষ্টি , 
আর তোমার ডাকে আমার ঘুম ভাঙ্গে । 
তবে কেন ঝড়ের নাম মুখে আন 
কালবৈশাখিতে বুঝি ভয় নেই ? 

৭১
ঝড় ! হে কালবৈশাখি ঝড় ! 
আমি তো বিচলিত নয় ঝড়ে । 
তুমি জাননা ফেব্রুয়ারির এক উজ্জল দিনে 
আমার জন্ম । 
জন্মেই দেখছি, রক্তমাখা বাংলাভাষার ঝড় । 
তারপর এ বুকে তুলে নিয়েছি বিশাল বঙ্গোপসাগর । 
ঝড় বল কিংবা তুফান 
এখনও অক্ষত বুকের পাঁজর । 

৭২
তবুও ঝড় যেন ধ্বংসের প্রতীক 
২৯শে এপ্রিল নূহের প্লাবণের কথাই মনে পড়িয়ে দেয় । 

৭৩
মানুষ প্রকৃতির কাছে ঋণী 
আবার প্রকৃতিই মানুষের প্রতিপক্ষ ; 
মানুষ প্রকৃতির সাথে লড়াই করে আজো বেচে আছে । 
দেখতে পাওনা ধ্বংসের নিচ থেকে জেগে ওঠে 
নব নব প্রাণ নব নব উদ্দীপনা । 
তাই উদাত্ত চিত্তে আহবান জানাই ; 
এসো চঞ্চল বৈশাখ 
তোমাকে স্বাগতম ! স্বাগতম ! 

৭৪
মনে হয় বহুদূর থেকে ভেসে আসছে 
নতুন দিনের জয়ধ্বনি । 
(“ঐ নতুনের কেতন উড়ে কালবৈশাখির ঝড় 
তোরা সব জয়ধ্বনি কর “) 
তুমি শুনতে পাচ্ছনা ? 

৭৫
না তো ! 

৭৬
দূরবর্তী অশ্বের পদশব্দ শুনার জন্য 
রাজার সিপাহীরা, 
যেভাবে উৎকীর্ণ হয়ে থাকে , 
তেম্নি সমস্ত বস্তুর ভেতর কান পেতে দাও । 
এবার শুনতে পাচ্ছ ? 

৭৭
না ! 
তুমি যখন পাশে থাক , 
মনে হয় তুমি আর আমি 
চুম্বকের দুই বিপরীত প্রান্ত । 
বল, 
পৃথিবীর অন্যকোন বস্তু কী আমাকে আকর্ষণ করতে পারে ? 

৭৮
তোমার শ্রবণেন্দ্রিয় কোন কাজের নয় । 

৭৯
তবে আশীর্বাদ দাও । 


কোরকের মত কোমল করতলে ধর আমার মস্তক 
ছল করে হলেও একবার আশীর্বাদ দাও । 

৮০
তেমন ক্ষমতাও কী আমার আছে ? 
আমি কেবল ছায়া 
নিজের ভেতর বিমূর্ত হয়ে আছি । 
তোমার আত্মায় তুমি জ্বালাও আত্মবিশ্বাসের প্রদীপ 
দেখবে, তোমার আকাশে হাজার নক্ষত্র জ্বলছে । 

৮১
হয়ত আমাকে তাই করতে হবে 
হাঁ। এবার শুনতে পাচ্ছি 
মনে হয় বৈশাখের হাওয়ায় হাওয়ায় 
রমনার গর্বিত বটমূলের উল্লাস । 
আহা ! কতদিন মেলায় যাওয়া হয়নি আমার ! 

৮২
যেতে মন চাই ? 

৮৩
খুব । 
কতদিন তোমার হাত ধরে কোথাও যাওয়া হয়নি । 

৮৪
চল । মেলা আমাকেও ভীষণ টানে । 
শক্ত করে ধরে রাখ আমার হাত ; 
যেন শিশুর মার্বেলের মতো হারিয়ে না যায়।

৮৫
এ কী ! 
কেমন শীতল তোমার হাত , 
মনে হচ্ছে বরফের ফসিল । 
কতদিন এ হাতে কংকনের শব্দ শুনিনি 
তোমার মুখের দিখে তাকানোও যায়না 
শুকনো ঠোঁট আর ঠোঁটের প্রান্ত থেকে 
প্রতিধ্বনির মত ফিরে যাচ্ছে বাতাস , 
চোখ দুটো যেন বসানো পাথর । 

৮৬
এ আমার সত্যিকার ছবি । 
আমি তো ধূসর দেওলিয়া মেঘ 
যার কাছে দুফোটা বৃষ্টির জলও জমা থাকেনা । 

৮৭
আমি একেবারে নিঃস্ব নয় । 
আমার আছে লুকানো লালচুড়ি, 
ঝিনুকের হাঁর, 
লালপারের ঢাকাই শাড়ি, আঁচলে সবুজপাতার নকশা 
পুরনো বইয়ের ভাজে 
তিলপুষ্পের মত নাকফুলটি এখনও আছে । 
আরও আছে কেয়াপাতার নোলক ও নূপুর । 
১১০টা বাগান তন্ন তন্ন করে যে লালটিপ এনেছিলাম ; 
আজো শহীদমিনারের লাল সূর্যটির মত সেটি লাল আছে । 

৮৮
এখনও ভালোবাস ? 

৮৯
বুঝতে পারনা ? 

৯০
এখন পারি । 

৯১
আগে পারনি ? 

৯২
কী করে পারব ? 
তুমি ছিলে অস্থির ঝড়ের পাখি , 
কখনও ভারসাম্যহীন নৌকার মতো । 
আমি ছিলাম পারানির যাত্রী 
ভয় তো আমার ছিল । 

৯৩
হাঁ ভারসাম্যহীন । 
যে পুরুষ জন্ম থেকে বিশাল সমুদ্র 
বুকে নিয়ে ঘুরে; 
সে কী করে হবে শান্তশিষ্ট ? 
তুমি তো জান, 
ঈশা নবী ঝড় থামাতে পারতেন 
নূহ নবী পারতেন না । 
আমি সামান্য কবি 
আমি আর কতটুকু পারি ? 

৯৪
কখনও বলনি তুমি কবি ! 
কেন গোপন করেছিলে ? 

৯৫
নিরবতাও কবির ভাষা 
মহৎ কবিতার জন্য কবি নিরবতার কাছে প্রার্থনা করেন । 
তুমি ছিলে আমার কবিতা । 

৯৬
আমি তখন অতশত বুঝতাম নাকি ? 

৯৭
জানি, অবুঝ হৃদয়ে আবেগের ঢেউ তুলে 
চলে গেলে তুমি। 
দেখ, এই সেই লালচুড়ি , 
যৌবনের এক উজ্জ্বল দিনে 
তোমার জন্য কিনেছিলাম । 
তারপর কত বৈশাখ এল, 
কত রঙ্গের মেলা বসল , 
নাগরদোলার মত ঘুরতে ঘুরতে 
আবার ফুরিয়েও গেল । 
কেবল বয়স বাড়ল চুড়ির 
কিছুই আর হল না । 
মেলাটির কথা আজো ভুলিনি , 
নদীর তীর ঘেঁষে ধূসর একটি গ্রাম , 
ঘোলাটে জলের মৃদু মৃদু প্রবাহ , 
তীরে ছায়াবিস্তারি প্রচীন বটবৃক্ষের তলে 
চুড়ির ডালা সাজিয়ে বসেছিলেন 
মুক্তিযোদ্ধার এক বিধবা । 
যুদ্ধবিধস্ত বাংলাদেশের মতো ছিল তার মুখ , 
রোঁদপোড়া গতর, পাটকড়ির মত হাত , 
একবার ভেবেছিলুম লালচুড়ি বিধবাকে দিয়ে দিই । 

৯৮
বিধবা এখন কোথায় ? 

৯৯
আমি জানিনা । 

১০০
মেলায় যাওনি আর ? 

১০১
যদি যেতাম একশিশি আলতার কথা 
বিলকুল ভুলতাম না । 
কতদিন দেখিনি তোমার পায়ে আলতার রঙ । 
মাঝে মঝে ভাবি, 
তুমি আলতা পায়ে সবুজ শাড়ি পড়ে, 
নিঃশব্দে হাঁটছ আমার সামনে । 
এই দৃশ্য কোনদিন মুছবেনা আমার মন থেকে । 
মানুষের মৃত্যু হয় জানি কিন্তু ছবির মৃত্যু নেই । 
এবার বাড়াও হাত - 
এই লালচুড়ি বহুদিন তোমার প্রতীক্ষায় ছিল । 


১০২
না । না কবি না । 
আমাকে ক্ষমা কর । 
আমি বন্ধনহীন এক সত্তা , 
আমি তোমার হাত ধরে হাঁটছি 
তবুও আমি স্পর্শহীন, 
আমি তোমার পাশে আছি 
তবুও আমার অস্থিত্ব বহুদূরে , 
আমার আড়ালে আমি আছি 
তবুও আমি নিজ থেকে অনেক দূরে । 
লালচুড়ি, আলতা, সবুজশাড়ি, পুঁতিরমালা 
আমাকে আর স্পর্শ করেনা । 
আমি আছি কিংবা নেই 
দুটোই কেবল সান্তনা । 

১০৩
তবুও তুমি আছ বলেই আকাশ নীল 
পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ভেসে আসে সেখানে । 
বৃষ্টির শব্দে ভেঙ্গে যায় অরণ্যের গোপন ধ্যান ; 
ডানায় রোঁদের গন্ধ নিয়ে নিশঙ্ক পাখিরা 
উড়ে যায় বহুদূরে , 
সন্ধ্যায় জোনাকিরা জ্বালায় অলৌকিক বিদ্যুৎ, 
নদীর উজানে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে ছুঠে চলে ছিপনৌকা , 
ভোরে নদীর ঘাটে গ্রামবধূদের সমাবেশ থেকে 
ভেসে আসে চুড়ির রিনরিন মিহি আওয়াজ , 
সবি তো আমার সান্তনা । 
আর সান্তনার মাঝে কিঞ্চিত হলেও স্নেহ থাকে । 

১০৪
বুঝতে পার তাহলে ? 

১০৫
কেন পারবনা ? 
এখনেই তো নির্ভরতার ছায়া , 
বেঁচে থাকার সাধ, অমরত্বের লোভ । 

১০৬
অমরত্ব চাও নাকি ? 

১০৭
প্রভুর কাছে অন্যকিছু তো চাইনি । 
(বলেছি) কিছুই দিওনা প্রভু 
যদি পার অমরত্ব দিও । 

১০৮
কেন অমরত্ব ? 

১০৯
যেদিন পৃথিবীর মৃত্যু হবে 
কেমন হবে তখন । 
পৃথিবী প্রচন্ড শক্তিতে কেঁপে উঠবে, 
আসমান-জমিন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হবে, 
পাহাড়-পর্বত কার্পাসের তুলোর মত উড়ে যাবে, 
সমস্ত প্রাণের মর্মান্তিক মৃত্যু হবে, 
বিষাদগীতি গাইবার কেউ থাকবেনা , 
সেই বিরল দৃশ্য দেখার বড় সাধ । 

১১০
বড় বেশি চাওয়া 
কোনদিন পূরণ হবার নয় । 

১১১
পাবনা বলেই বেশি করে চাওয়া ; 
যেমন তোমার ভালোবাসা । 
জানি, কোনদিন ফিরে আসবেনা । 
তবুও চাওয়ার মধ্যে আকুলতা আছে, আনন্দ আছে , 
হয়ত রবী ঠাকুরের মত আমারও পথ চাওয়াতে আনন্দ । 
মনে হয় পাওয়ার চেয়ে পাওয়ার আশা অনেক বড় । 

১১২
এভাবে আর কতদিন ........ 

১১৩
যতদিন পাখির ডাকে সূর্য উঠবে 
পথের শেষ হবেনা । 

১১৪
আর পারিছনা 
মাঝে মাঝে ঈভের মত চঞ্চল হয়ে উঠি । 
আত্মার ভেতর উদ্বেগের ঝড় কিছুতেই শান্ত হতে চায়না 
আত্মবিনাশের নেশা বড় ভয়ঙ্কর । 

১১৫
মনে বড় বোঝা 
এই বোঝা হিমালয় সমান 
তাই বিনাশের কাছে আশ্রয় খুঁজি । 

১১৬
গ্যাসফীল্ডের চুল্লির মত নিজেকে পুড়িওনা আর । 

১১৭
আত্মায় আগুন তুমিই দিয়েছ । 
কোনদিন বুঝলেনা বাউল মন । 

১১৮
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় , 
আমিও বাউল হয়ে দুঃখিনী নদীর স্রোতের মত 
কোথাও হারিয়ে যাব। 
হয়ত মধ্যাহ্নের ক্লান্তি নিয়ে যদি 
বটের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ি 
তখন আমাকে জাগিয়ে দেবে চিরচেনা একটি ঘুঘুর ডাক । 
কিংবা ফড়ফড় করে বাতাসে কাঁপা ছেঁড়া পালের শব্দ । 

১১৯
সকলে বাউল নয়, 
কেউ কেউ বাউল হয়ে যায় । 
তোমার তো পিছুটান আছে, 
চতুর্দিকে আছে মায়া বিতান, 
এমন কী তোমার নিজস্ব পুরুষ আছে । 
মায়া-প্রাচীরে থেকে একতারার জীবন তোমার জন্য নয় । 

১২০
প্রাচীর কেমন করে ভাঙ্গি 
আমার তেমন শক্তি কই ? 
প্রাচীর বেয়ে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা
অপরাজিতার লতা 
সারাক্ষণ আমাকেই জড়িয়ে রাখে, 
বল, কীভাবে তাকে উপড়ে ফেলি ? 
তবে প্রাচীরের আড়াল থেকে নিঃসঙ্গ দুপুরে 
কুহলি পাখির ডাক শুনতে পাই । 
উদাস দুপুরে বাউল রোদ্দুরে 
তার পিচু পিচু যেতে মনের খুব সায় আছে । 

১২১
কেন মনে পড়িয়ে দাও 
কুহলি পাখির গল্প 
স্মৃতিকে ঘুম পাড়িয়ে 
বিস্মৃতির দর্পণে আমি নদীর ঘোলাজল ঢেলে দিয়েছি 

১২২
কতটুকু আর বিস্মরণ ? 
আচমকা সেও জেগে উঠে দেখে 
বেনোজলে তার ছায়া । 

১২৩
সবকিছু যেন ছায়া, ছায়া 
আমিও যেন ছায়াপথে ছায়ামানব । 

১২৪
তবুও ছায়ার সঙ্গেই আছ 
ছায়াও শরীর খুঁজে অন্ধকারে । 

১২৫
পৃথিবীর লজ্জিত মুখে 
আবার যদি অন্ধকার নামে ; 
তুমি শুধু একবার এসো জ্যোতির্ময়ী , 
           যেন ছায়াটুকু খুঁজে পাই নির্দিষ্ট দূরত্বে । 

১২৬
কেন দূরত্বের কথা বলছ ? 

১২৭
আমার করতলে তোমার হাত 
স্পর্শে, অনুভবে তোমার অস্তিত্ব 
এর নাম কী দূরত্ব ? 

১২৮
যদি বলি ক্ষণিক স্পর্শের নাম 
উসকে দেয়া যন্ত্রণা , 
না পাওয়ার নাম দূরত্ব । 

১২৯
কতটুকু আর পাওয়া 
আমরা কী সম্পূর্ণটা পাই ? 
ভালোবাসারও তো একটা দাবী থাকে 
বলতে পার কতটুকু সে পাই ? 
মানুষের জীবনে যন্ত্রণাটা চরম সত্য 
বাকি সব ম্লান-প্রদোষের মত । 

১৩০
প্রতিদিন পৃথিবীর ম্লানমুখ দেখতে দেখতে 
সেগুনের বনে জমে উঠে ধূসর মেঘ 
আমি এসে দাঁড়াই পৃথিবীর মুখোমুখি 
মনে হয় কিছু পেলাম নাকি কিছুই পেলামনা 
কেবল হাওয়ার পিছে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি ক্লান্ত 
তুমি জাননা মেয়ে আমি সারাজীবন 
যেন হাওয়ার পিছে ......... 

১৩১
শুধু তুমি নও 
আমরা সকলে ছুটছি । 
           পৃথিবী নিরলস চেনাপথে ঘুরছে 
মানুষের কোন পথ নেই, দিক নেই 
মানুষ এখনও ঠিক করতে পারেনি 
চূড়ান্তভাবে তারা কী চাই ? 
কিন্তু তুমি কেন ক্লান্তির বন্দরে 
নিজেকে ডুবাতে চাও ? 

১৩২
যখন দেখি অন্ধকারে পাথরের মত 
পৃথিবীর আদিম-মুখ ; 
ঈর্ষার ভেতর জন্ম নেয় লোভের বৃক্ষ , 
শিউলীর পাতা থেকে ঝরে যাওয়া শিশিরের মত 
ভূ- লুন্ঠিত মানবতা , 
মিথ্যে আশ্বাসে কেউ যখন ভাঙ্গে বিশ্বাসের বৃক্ষ , 
তখন নেশা কেটে যায় 
আর নেশা কেটে যাওয়ার অর্থ 
সবকিছু সাদাসাদা । 
ঠিক তখন পৃথিবীকে মনে হয় 
কুমারী বিধবার মুখের মত । 
তারপর হৃদয়ের বিশাল ক্যানভাসে 
ভেসে উঠে তোমার মুখ ; 
ফের জমে উঠে নেশা । 

১৩৩
আমি কী কেবল নেশার পুলক ? 

১৩৪
মোটেও নয় 
এ নেশা অন্ধকার শয্যায় মাংসের লোভ নয় নারী , 
ওষ্ঠ, স্তন কিংবা জঙ্ঘার দাবী মেটাতে 
সে উদগ্রীবও নয় । 

এ নেশা প্রেমের 
এ নেশা মনের 
এ নেশা ধ্যানের 
প্রেমের বিপরীতে মন 
আবার মনের বিপরীতে প্রেম 
তারপর ধ্যান । 

১৩৫
তারপর গুহার তিমিরে তিলে তিলে 
মৃত্যুকে ডেকে আনা ; 
এ কেমন নেশা তোমার ! 
আকাশের দূরবর্তী নক্ষত্রের মতো আর কত দূরত্বে 
নিজেকে নিয়ে যাবে ? 
আজ এই রমনার বটবৃকক্ষকে সাক্ষী রেখে বলছি 
তুমিই যথার্থ প্রেমিক 
তুমিই পুরুষ 
এবং তুমিই কবি । 
আজ আমি কৃপাপ্রার্থী 
আমাকে আশীর্বাদ দাও 
ওঠে দাঁড়াও
ওঠে দাঁড়াও
ওঠে দাঁড়াও
এই মূর্তজ রাতে বিমূর্ত সুন্দর !!