মুহূর্তে এসেছি ফেলে
জানালার চাপা দৃষ্টি ব্যাকুল বাগান
ভ্যান গগের আঁকা স্বদেশী মাঠের হাওয়া
রাস্তার ধারের সেই খেঁজুর গাছ গাড়োয়ানরা
ইজারা নিয়েছিল বলে যে আট বছর শৈশবের
মাঠে দাঁড়িয়েছিল– মনে পড়ে আমাকে তোমার
উনিশ শ সাতচল্লিশের বাংলাদেশ
আমার সুতো-ভর্তি লাটাই ফেলে
আমি জারির দোনার কুমিরের ভয় ফেলে
অচেনার চেয়ে সুদূর অন্য দেশে চলে গিয়েছিলাম
–মনে পড়ে
(মনে পড়ে, জ্বালামুখে কবিতার /উত্তম দাশ)


তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমানো খ্যাতিমানদের কাতারে কবি-প্রাবন্ধিক উত্তম দাশ কে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করা যায় । তিনি নোয়াখালী জেলার চর আলেকজান্ডার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । এলাকাটি বঙ্গপোসাগরের বুকে একটি  দ্বীপাঞ্চল । সাতচল্লিশের দেশ বিভাগের সময় তাদের পরিবার পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসিত হয় । জন্মভুমি ত্যাগের স্মৃতিতাড়িত শব্দ মিছিল তাঁর এই কবিতাটি । এ যেন উদাসী হাওয়ার তরঙ্গে তরঙ্গে বেদনামথিত কবির আত্ম দীর্ঘশ্বাস ।  


গত ১২ জুন পশ্চিমবঙ্গের কবি উত্তম দাশের আকস্মিক তিরোধানের খবরটা পড়ে হৃদয়ের গভীরে একটা বেদনার ভার  অনুভব করেছিলাম । কবি ড. উত্তম দাশের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল হুদা ভাই (জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা)  এর    কল্যাণে । ২০১০ সালে তিনি স্বস্ত্রীক (ড.মালবিকা দাশ) কক্সবাজার এসেছিলেন । আমরা দরিয়ানগর কবিতা বাংলার পক্ষ থেকে কক্সবাজার পৌরসভা মিলনায়তনে কবিকে সংবর্ধনা দিই এবং উদযাপন করি তাঁর সত্তরতম জন্মবার্ষিকী। অনুষ্ঠানের শুরুতে আমার স্বাগত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে স্বস্ত্রীক কবিকে বরণ করে নিয়েছিলাম । সে সময় কবির সাথে আমার অন্তরঙ্গ  সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং আমরা সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনাও করি । অত্যন্ত অমায়িক, আলাপপ্রিয়, সুদর্শন ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী  ছিলেন তিনি । তাঁর মহাপ্রয়াণে আমি গভীর শোকাহত এবং বৌদির প্রতি জানাচ্ছি অকুণ্ঠ সমবেদনা ।


কবিসত্ত্বার বাইরে তাঁর আরও অনেক পরিচয় আছে । তিনি ছিলেন পেশাদার শিক্ষাজীবী ও প্রাবন্ধিক । বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ,   সুক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি ও স্পষ্টভাষীতা হচ্ছে কোন প্রবন্ধের পাঠকপ্রিয়তা পাবার পূর্বশর্ত । উত্তম দাশের প্রবন্ধে এসব শর্তের কোন ব্যতয় ঘটে না । বাংলা কাব্যনাট্যের উপর তিনি একটি অসাধারণ বই লিখেছেন । বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ও কাব্যনাট্যের  উপর লিখেছেন বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ ।


মূলত তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে কবিতার ছন্দ নিয়ে । কবিতার ছন্দ, কবির ছন্দ বইটি নিঃসন্দেহে তাঁর উৎকৃষ্ট কাজ । প্রবোধচন্দ্র সেন সারা জীবন ছন্দ নিয়ে কাজ করেছেন । এমন কি রবীন্দ্রনাথের ছন্দ বিশ্লেষণ ও বিবর্তন নিয়ে তাঁর কাজ আছে । আর উত্তম দাশ তাঁর প্রবন্ধে প্রবোধচন্দ্র সেনের কাজের যথাযত মূল্যায়ন করেছেন । রবীন্দ্র সঙ্গীতের উপর লেখা ‘ছন্দোবন্ধনে অধরামাধুরী’ তাঁর উৎকৃষ্ট রচনা হিসেবে স্বীকৃত । সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও  সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার ছন্দ নিয়ে রচিত চারটি প্রবন্ধ আছে এই গ্রন্থে । ‘বাংলা ছন্দের অন্তঃপ্রকৃতি’ তাঁর আরও  একটি মুল্যবান কাজ ।


সম্পাদক হিসেবে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ‘সত্তর দশকের কবিতা’, ‘আধুনিক প্রজন্মের কবিতা’, ‘আঞ্চলিক ভাষার কবিতা’এবং ‘শতাব্দীর বাংলা কবিতা’  । তিনি দীর্ঘদিন বহ্নিশিখা ও মহাদিগন্ত পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ।  


রোমান্টিকতা কবিতার অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ । রোমান্টিকতা বিবর্জিত কোন কবিসত্ত্বাই পূর্ণাঙ্গ নয় । কারো রোমান্টিকতা বাগানে প্রস্ফুটিত পুষ্পের মত যা সহজে ধরা পড়ে । আবার কারো রোমান্টিকতা ঝিনুকের ভেতর মুক্তোর মত লুকিয়ে থাকে  । কবি উত্তম দাশ দ্বিতীয় ধারার রোম্যান্টিক কবি ।