আলীবাবা চল্লিশ চোরের গল্পটা আমরা সবাই জানি । বাংলা সাহিত্যে আলীবাবা কবির সংখ্যা নেহায়েত স্বল্প নয় । আগের দিনে পর্যাপ্ত মিডিয়া ছিল না । ফলে চুরি করার পরও আলীবাবারা নিশ্চিন্তে আড়ালে থেকে যেতেন । বর্তমান ডিজিটাল  মিডিয়ার যুগে আলীবাবাদের দুর্দিন বলতে হবে । কারণ তাকে কোন না কোন সময় ধরা পড়তেই হবে । আমি আল মাহমুদের একটি কবিতা উল্লেখ করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি ।


দেখায় কবির মত, অথচ সে শব্দ চোর, খ্যাতিতে প্রবীণ ;
সে আছে আমাকে ঘিরে আমারি ঝুলির দিকে চোখ ।
যা আছে আমার কছে, সবুজ পুঁতির মালা, আর
সুরভি ঘাসের বীজ। কিশোরীর ভাঙ্গা চুড়ি, নীল নাকফুল ;
কালো পাহাড়ের মৃণ্ময় বাসনকোসন, পুতুলের বৌ-
সে চায় চোরের মত কেড়ে নিতে । কিংবা বুক মেলানোর ছলে
গোপন খঞ্জর তার হাতড়ে ফেরে-
বুকের কোথায় থাকে গ্রাম্য এই কবির ভোমরা ?
না, দেবো না আমি লাল শিলাজুত- এই পাথরের ঘাম ;
চোখের জলের টোপা- কারার আড়াল থেকে আনা ;
দেবনা পাখির ঠোঁট, তক্ষকের চোখ ;
নদীর গভীর থেকে তোলা এই ছিনায়ের রূপার চামচে  
খেতে চাও ? দেব দুধ, তবু এই
চামচ চেয়ো না ।


শোন ভাবের চোর শব্দ তস্কর
খ্যাতির চেয়ারে বসে লকলকে জিহবা তুমি যতই বাড়াও,
সাবধান, আমার ঝুলিতে আছে বেতসের কাঁটা, আছে-
খাকোশ মাছের পাকা লেজ ।
পাগলা মৌমাছি আমি পুষেছি ঝুলিতে,
আমার সংগ্রহে আছে ছুঁতরার পাতা আর
বাঁদরহুলার কিছু ফল ।


(শোন ভাবের চোর শব্দ তস্কর / মায়াবী পর্দা দুলে উঠে- আল মাহমুদ )


বাংলা সাহিত্যে পুকুর চুরি বলে একটা কথা আছে । বড় রকমের চুরি অর্থে কথাটি ব্যবহৃত হয় । কোন কবির পুরো কবিতা চুরি হয়ে গেলে সেটা পুকুর চুরির পর্যায়ে পড়ে । পুকুর চুরি যারা করে তাদেরকে ছিঁচকে চোর বলা যাবে না । তারা চোর শ্রেষ্ঠ । অর্থাৎ আলীবাবা । আলোচনা সভায় কবি কামরুল ফারুকির লেখা থেকে অবগত হলাম তার পুরো কবিতা জনৈক চোর কবি চুরি করে নিজের নামে প্রকাশ করেছে । এ জাতীয় চোরদের সাবধান করে আল মাহমুদ এই কবিতাটি রচনা করেছেন বলে আমার মনে হয় ।  সাহিত্যে চৌর্যবৃত্তি বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে কবিতাটির বহুল প্রচারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি ।  


সাধারণত কবিদের মধ্যে বহুবিধ চোর দেখা যায় । কেউ শব্দচোর, কেউ পংতিচোর, কেউ ভাবচোর আবার কেউ কেউ কবিতাচোর । অন্যের লেখা থেকে চুরি করা গর্হিত ও জঘন্য কাজ । তবে ঋণ স্বীকার করলে দোষনীয় নয় । দেখা যায়   অনেক খ্যাতিমান কবি চৌর্যবৃত্তির সাথে জড়িত ছিল । গগন হরকরার গান ‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়/ মনে পড়ে মোরে প্রিয়/ চাঁদ হয়ে রব আকাশের গায় / বাতায়ন খুলে দিও ।’
নজরুল লিখলেন- ‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায় / মনে পড়ে মোরে প্রিয় / চাঁদ হয়ে রব আকাশের গায় / বাতায়ন বন্ধ করে দিও ।‘ নজরুলের এই গানটা জনপ্রিয় হয়নি । গগন হরকরার গানটাই আমরা শুনতে পাই বেশী ।  


এবার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। কবি সবুজ তাপস তার প্রবন্ধে লিখেছেন-  “তিনি ঋণস্বীকার না করে গগন  হরকরার ‘ আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনের মানুষ যে রে’ ও স্কটল্যান্ডের কবি রবার্ত বার্নসের ‘ Ye Banks and Braes o’ Bonnie Doon’(১৭৯১) গানের সুর হরণ করেছেন। উক্ত দুটো সুর তিনি যথাক্রমে ‘ আমার সোনার বাংলা’ ও ‘ফুলে ফুলে দোলে দোলে ‘গানে ব্যবহার করেছেন। ‘আমার সোনার বাংলা’ গীতিকবিতাটি আহামরি কিছু নয়। গগনের হদয়স্পর্শী সুরের কারণেই এটি যেকোনো শ্রোতার কাছে সুন্দর লাগছে। শুধু সুর নয়, এ-দুটো গীতিকবিতার স্ট্রাকচারও তিনি হরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন, কোনকালে কেউ তার চৌর্যবৃত্তি আবিষ্কার করতে পারবেন না। বাংলার সাধককবি লালন ও ইউনানি কবি রুমির অধ্যাত্ম্যবাদী চিন্তাই খুঁজে পাওয়া যায় তার বেশিরভাগ গীতকবিতায়। ‘খাঁচার অচিন পাখি’ কিংবা ‘বাড়ির পাশের পড়শিরা’ই তার ‘হিয়ার মাঝে লুকিয়ে আছে’। তার গদ্য সাহিত্যও ভেজালযুক্ত। প্রমথনাথ সেনগুপ্তকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়া ‘বিশ্বরচনা’কে আত্মপ্রতারক রবীন্দ্রনাথ যে-কৌশলে ‘বিশ্বপরিচয়’ বানিয়ে নিজের নামে প্রকাশ করেছেন, আজ সে চাতুর্যপূর্ণ কাহিনিও কোনো কোনো লেখকের আলোচনায় উঠে আসছে।” ( সূত্র-চৌর্যবৃত্তি ও প্রভাবিত কবিতা/ সবুজ তাপস ) ।  


কখনও কখনও দেখা যায় কবিতায় অংশ বিশেষের ঘনিস্ট মিল । সেটি চেতনে কিংবা অবচেতনে হোক প্রত্যেক কবিদের উচিৎ এ বিষয়ে সতর্ক থাকা ।  আবু হাসান শাহরিয়ারের এরকম একটি কবিতার সন্ধান পাই । সেটা আংশিক চুরি না  অনুসরণ পাঠক বুঝে নিবেন । বিষয়টি বুঝার জন্য প্রথমে শঙ্খ ঘোষের কবিতাটি পাঠ করে নিই ।  


আমি উড়ে বেড়াই আমি ঘুরে বেড়াই
আমি সমস্ত দিনমান পথে পথে পুড়ে বেড়াই
কিন্তু আমার ভালো লাগে না যদি ঘরে ফিরে না দেখতে পাই
তুমি আছো তুমি।
(তুমি/ শঙ্খ ঘোষ)


এবার আমরা আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতাটি পড়ব ।


আমি উড়ে বেড়াই
উড়ে উড়েই ঘুরে বেড়াই
… … …
তাই আগুনে হাত রাখলে আগুন নিজেই পোড়ে।
আর রক্তগোলাপ ফোটে জমাট শ্বেতপাথরে।


আমি উড়ে বেড়াই
উড়ে উড়েই ঘুরে বেড়াই
কালে-কালান্তরে
ধর্মে আমার কুলায় না তাই থাকি বৃহত্তরে।
(অকুলচারীর পাঠ্যসূচি/আবু হাসান শাহরিয়ার)


আদিত্য প্রকাশন, চট্টগ্রাম থেকে উত্তরআধুনিক কবি আশীষ সেনের ‘এক ক্লান্ত পদাতিক’ গ্রন্থটি প্রকাশ হয় ২০০৭ সালে । এই গ্রন্থের  ‘মশালের আলোয় দেখা’ কবিতাটি পড়ার আগে প্রয়াত কবি খান শফিকুল মান্নানের ‘কখনো কোথাও’ কবিতাটি একবার পাঠ করে নিই । এটি প্রকাশ হয়েছিল ‘পদাতিক’ একুশে সংখ্যায়, ১৯৭৮ সালে । সম্পাদক ছিলেন মাহাবুব-উল-আজাদ চৌধুরী । এতে বুঝা যাবে আশীষ সেনের কবিতাটি কতটা খাদ কতটা খাঁটী ।


কখনো কোথাও মাহুত মাতাল হয়
ম্যাপের কোনায় রক্ত ফিনকি দিয়ে
কখনো কোথাও লালের আভাস রাখে
কখনো কোথাও হরিণ পালায় বনে
খাতার পাতায় ঝড়েরা বন্দী থাকে
মোমের বাতিটি নীরবে জ্বলিয়া যায়
প্রাচীন প্রাণীর লেজের মহিমা আজো
বঙ্গসাগর উথাল পাতাল করে
ছুটেছে মহিষ লবণ মাঠের বুকে
বেপথু ঝড়ের ছোবল বারংবার
বিপুল নখরে ছিঁড়েছে সাইকলপ্স
ইথাকা এখনো বিরান পাহাড়ভূমি
বেদিয়া পাখীরা অনেক গাঙের চিল
হাতিরা কখনো মাঝারি শূকর হয়
কখনো ইঁদুর বিলাসী হোটেল ঘরে
অশোক কাননে সোনার লঙ্কা জ্বলে।
(কখনো কোথাও/খান শফিকুল মান্নান)


আশীষ সেনের কবিতা


কখনো কোথাও মাহুত মাতাল হয়
ম্যাপের হৃদয়ে রক্ত ফিনকি দিয়ে
কখনো সে লাল ভোরের আভাস রাখে
জাগে লোকালয় হরিণ পালায় বনে।


খাতার পাতায় ঝড়েরা বন্দী থাকে।
মোমের বাতিটি নীরবে জ্বলে ফুরায়
প্রাচীন প্রাণীর লেজের তাড়ন আজো
বঙ্গসাগর উথাল-পাতাল করে।


ছুটছে মহিষ লবণ মাঠের বুকে
ঝড়ো খুরে হানে ছোবল বারংবার,
সুবিধাবাদীরা ছিঁড়ছে পুঁথির পাতা
শয্যাসঙ্গী পানাহার হলাহল।


ইথাকা এখনো বিরান পাহাড়ভূমি
বেদে-পাখিরাও খোঁজে নিজ বাসাবাড়ি
হস্তী কি কভু শুকরের পাল হয়
রাজা হতে কভু ইঁদুর নাহি তো পারে।


অশোক কানন নিরাপদ যতো হোক,
তবুও সেখানে সোনার লঙ্কা জ্বলে।
(মশালের আলোয় দেখা/আশীষ সেন)


এখন পাঠকই বলতে পারবেন এসব কী দৈবক্রমে ঘটে যাওয়া মিল নাকি অন্যকিছু ।