কর্ণফুলীর মেয়েটা
হলনা তার বিয়েটা ।
হারিয়ে কানের দুল
ভারী তার মনটা ।
উজানে চলে নৌকা
ছলাৎ ছলাৎ বৈঠা  ।
গলুইয়ের ভেতর নাওরি
মুখে তার ঘোমটা  ।
মাঝি গায় গান
নেচে উঠে মাছটা
ছোট ছোট ঢেউ ভাঙ্গে
উড়ে আসে বকটা  
কর্ণফুলীর মেয়েটা
হলনা তার বিয়েটা
প্রথমে বলে রাখি এটি একটি শিশুতোষ ছড়া । আমি জটিল শব্দ বর্জন করে শিশুর পাঠ্য উপযোগী করার চেষ্টা করেছি । এটি কবিতার আসরে প্রকাশ হওয়ার পর অনেক সুন্দর সুন্দর মন্তব্য পেয়েছি । এক কবি জানতে চেয়েছেন মেয়েটার বিয়ে হলনা কেন, কর্ণফুলীর মেয়েটা কে, পুরোটা বুঝা গেলনা ইত্যাদি । আমি সবার মন্তব্যগুলো বেশ উপভোগ করেছি । তাই ছড়াটির জন্মরহস্য উম্মোচন করার তাগিদ অনুভব করছিলাম ।


নিছক ভাবাবেগ আধুনিক কবিতায় উপেক্ষিত । আধুনিক কবিতায় দৃষ্টিগোচর হয় কল্পনা ও অভিজ্ঞতার কৌশলী প্রয়োগ । ফলে পাঠক কবির ভাবটুকু পায় বটে, কিন্তু অভিজ্ঞতার পুরোটা ছুঁতে পারেনা । তখন কবিতা বিচরণ করে আলো আঁধারি এক জগতে । অনেক সময় কবিতার বিরুদ্ধে উঠে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ । কবিতার রবীন্দ্র-নজরুল যুগের সেই জনপ্রিয়তা আজ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে । দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত কবিতাগুলো নিতান্ত কবিতাপ্রেমী না হলে সাধারণ পাঠক পড়েও দেখেনা । আমরা বর্তমানে যে কাল অতিক্রমণ করছি আমাদের মানস জগত থেকে তারই প্রতিফলন  কবিতা ঘটে যাচ্ছে চেতনে কিংবা অবচেতনে। যাক কথা না বাড়িয়ে আসল কথায় আসি ।  


চট্টগ্রামের প্রধান নদীর নাম কর্ণফুলী । ভারতের মিজোরামের লুসাই পাহাড়ে এর উৎপত্তি স্থল । পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এর শেষ গন্তব্য বঙ্গোপসাগর । ১৫৮৮ সন থেকে প্রায় ১০০ বছরের অধিক সময়ব্যাপী চট্টগ্রাম আরাকান (বর্তমানে বার্মার একটি প্রদেশ) রাজের শাসনাধীনে ছিল । তারও পূর্ব থেকেই কর্ণফুলী নদীর নামের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন কিংবদন্তী চালু ছিল । কথিত আছে আরাকানের এক রাজকন্যা চট্টগ্রামের এক আদিবাসী রাজপুত্রের প্রেমে পড়ে । এক পূর্ণিমা রাতে তারা দু’জন এই নদীতে নৌকা ভ্রমণ উপভোগ করছিল । সে রাতে আকাশের চাঁদ যেন পূর্ণ রূপ নিয়ে নেমে এসেছিল নদীর জলে । সেই অপরূপ দৃশ্যে বিভোর রাজকন্যার কানের দুল (চট্টগ্রামের ভাষায় কানের দুল কে কানফুল বলে অর্থাৎ কর্ণফুল ) জলে ভেসে যায় । কানফুল হারিয়ে বিমর্ষ রাজকন্যা সেটি উদ্ধারের জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে । কিন্তু প্রবল স্রোতে রাজকন্যা ভেসে যায় । তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি । রাজকন্যাকে উদ্ধারের জন্য রাজপুত্র জলে লাফিয়ে পড়ে । কিন্তু সে ব্যর্থ হয় । রাজকন্যার শোকে পরে সে নদীতে আত্মবিসর্জন দেয় । এই হৃদয়বিদারক কাহিনী থেকে নদীটির নাম হয় কর্ণফুলী ।


আমি ছড়াটি রচনা করতে ইতিহাস থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছি । তারপর কল্পনার আশ্রয় নিয়েছি । রাজকন্যাকে কর্ণফুলীর মেয়ে, কানের দুল হারানোকে বিয়ে না হওয়ার কারণ এবং চিরাচরিত বাংলার নদীর চিত্র আঁকার চেষ্টা করেছি । যদি আমি ইতিহাসের ঘটনাকে কবিতার রূপ দিতাম সেটি হত সরল পাঠ । আর ইতিহাস লেখা কবির কাজ নয় ।