'কবিতা ছাড়া কোন সমাজ থাকতে পারে না। কিন্তু সমাজকে কবিতা হিসেবে বোঝা যাবে না। সমাজ কাব্যিক নয়। কখনো কখনো 'সমাজ' ও 'কবিতা' এ দুটো পদ এক অপরকে ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা পারে না।'
-অক্তাভিও পাজ


বিংশশতাব্দীর ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ছিলেন কবি অক্তাভিও পাজ লোজানো । ১৯৯০ সালে নোভেল বিজয়ী এই সাহিত্যিকের নতুন করে পরিচয় দেবার দরকার নেই । তবে ভারতের সাথে তাঁর ছিল নিবিড় সম্পর্ক । তিনি প্রথম ভারতে আসেন ১৯৫২ সালে । দ্বিতীয় বার আসেন ১৯৬২ সালে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত হিসেবে । ভারতের সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম তথা ভারতীয় দর্শন তিনি অত্যন্ত গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন ।


তাঁর প্রথম দিককার কবিতাতে পরাবাস্তবতা ও অস্থিত্ববাদী দর্শন এবং মার্ক্সবাদ এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । গোড়ার দিকে অনেক কবিতার মধ্যে হিন্দুধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের প্রভাবও প্রতিফলিত হয়েছে । নোবেল কমিটিতে তাঁর ' স্যুরপাথর ' কবিতাটি পরাবাস্তব কবিতা হিসেবে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছিল । পরবর্তীতে তিনি কবিতার বিষয়বস্তু হিসেবে প্রেম, কাম, বৌদ্ধিক দর্শন ও সময়ের প্রকৃতির দিকে ঝুঁকে পড়েন । আধুনিক চিত্রকলার প্রতি অনুরাগও তাঁর কিছু কবিতায় ধরা পড়ে ।


যৌবনে পাজ নিজেকে একজন বর্বর কবি মনে করতেন । কবিতার জন্য পুরস্কার গ্রহণের মনোবৃত্তিও তাঁর ছিল না । তিনি মনে করতেন 'পুরস্কার সার্বজনীন, কবিতা ব্যাক্তিগত "। ১৯৬৩ সালে তিনি ব্রাসেলস থেকে একটি টেলিগ্রাম পেলেন । এতে জানানো হল, কবিতার জন্য নোককে লে জুউতে (Knokke Le Zoute) তিনি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন । এই সংবাদে তিনি অত্যন্ত মানসিক সংকটে নিপতিত হলেন । কারন নীতির সাথে আপস করে তাঁর পুরস্কার গ্রহণের আদৌ অভিপ্রায় ছিল না । তিনি তখন রাষ্ট্রদূত হিসেবে ভারতে অবস্থান করছিলেন । ভারতে অবস্থান কালে অনেক বিশিষ্ট জনের মধ্যে রাজা রাও এর সঙ্গেও ছিল তাঁর ঘনিস্টতা । তিনি তাঁর সমস্যার কথা রাজা রাওকে জানালেন । রাজা রাও বলেছিলেন, ' আপনাকে আমি উপদেশ দিতে পারি না, কিন্তু আমি এমন একজনকে চিনি যিনি সমাধান দিতে পারেন । আপনি রাজি হলে আমি আগামিকাল আপনাকে তার কাছে নিয়ে যেতে পারি ।'


পরদিন বিকেলে রাজা রাও এর সঙ্গে দিল্লীর প্রান্তদেশে একটি পরিমিত বোধসম্পন্ন বাড়িতে উপস্থিত হলেন । বাড়িটি ছিল একটি আশ্রম । এটির আধ্যাত্মিক পরিচালক ছিলেন আনন্দ মাঈ নামে একজন নারী । পাজ আশ্রমে প্রবেশ করতেই আনন্দ মাঈ তাঁর দিকে একটি কমলা ছুঁড়ে দিলেন । আর সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাত দিয়ে কমলাটি লুফে নিলেন । আনন্দ মাঈ হাসতে হাসতে বললেন, ' রাজা রাও ইতিমধ্যে তোমার ছোট্ট সমস্যাটির কথা আমাকে বলেছে । কী দেমাগ ! বিনয়ী হও এবং পুরস্কারটা গ্রহণ করো । কিন্তু গ্রহণ করো এটা জেনে যে, অন্যসব পুরস্কারের মতোই এটারও মুল্য খুবই কম কিংবা নেই বললেই চলে । এটা গ্রহণ না করা মানে এটাকে অতিরিক্ত মূল্যায়িত করা, এটার যতটুকু মূল্য আছে তার চেয়েও বেশি মূল্য দিয়ে ফেলা । এটা হয়ে উঠতে পারে একটি অহংকৃত দৃষ্টিভঙ্গী । একটি ভুয়া শুদ্ধতা, অহংকারের একটি মুখোশ ।' এ ঘটনার পর পাজ তাঁর নীতি বিসর্জন দিয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কারটি গ্রহণ করেছিলেন ।