গত বছর নভেম্বরের মাঝামাঝিতে মরুভুমির দেশ আরব আমিরাতে হঠাৎ এক ঘণ্টা বৃষ্টি হল। তবে ভারী বর্ষণ নয়, হাল্কা ও মাঝারি মেজাজের বৃষ্টি। এর তিনদিন পর আবার বৃষ্টির দেখা পেলাম। সকালের দিকে লক্ষ্য করি আকাশের পূর্বকোণে মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। প্রকৃতির ঘুমট ভাব মনের কোথায়  যেন অপ্রীতিকর ছায়া ফেলেছে। কর্মব্যস্ত দিন পাড়ি দিয়ে করোটিতে ক্লান্তির বোঝা নিয়ে বাসায় ফিরলাম। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে মনে হল আকাশ ফেটে গিয়েছে। রজনী দ্বিপ্রহর ধরে ভারী বর্ষণে অবশেষে তপ্ত মরু যেন শান্ত হল। পরদিন ছিল সাপ্তাহিক ছুটি। স্বভাবতই এমন দিনে ঘুম  ভাঙ্গে দেরিতে। ঘুম থেকে জেগে আবার এক পশলা বৃষ্টির দেখা পেলাম।  


এই বৃষ্টি কদিন ধরে মস্তিস্কের ভেতর অবিরল ধারাপাত করে যাচ্ছে। যেন আষাঢ়- শ্রাবণের কল্লোলিত জলতরঙ্গ আমাকে বারবার তাঁর কথাই মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর প্রবল ঋতু মনস্কতা আমাদের মুগ্ধ করে। বিশেষ করে বর্ষা তাঁকে মাতিয়ে ও জাগিয়ে রেখেছে   সারাটা জীবন। তাঁর গান ও কবিতায় প্রকৃতির এক মহান ভাবুকের সন্ধান পাই আমরা। তাঁকে নিয়ে কত কথা লিখা যায়। তবে আজ আর বর্ষা  বন্দনা নয়। কেননা ১৩ নভেম্বর ২০১৩ সাল ছিল রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির শত বছর পূর্তি দিবস। আমার ভাবনায় সেটিই কেবল  ঘুরেফিরে দোলা  দিচ্ছে।


শত বছর পূর্বে তিনিই প্রথম নন ইয়োরোপিয়ান যিনি সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটি তা হল তিনিই প্রথম বাঙালি যিনি বাংলা ভাষাকে সাংস্কৃতিমান ভাষার মর্যাদায় বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তাঁর এই অর্জন অতি দ্রুত সারাবিশ্ব ভারত ও বাংলা ভাষার প্রতি  কৌতূহলী হয়ে উঠল। তার কারণও অমূলক ছিল না। সেই সময় ছিল ভারতের এক চরম ক্রান্তিকাল। ভারতবাসী উপনিবেশিক ভিক্টোরীয়া শাসনের বিরুদ্ধে দূর্বার আন্দোলন সংগ্রাম  করে যাচ্ছিল। তখন প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ সারা পৃথিবীকে এক ভয়াবহ সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ভারতীয়রা শর্ত সাপেক্ষ বৃটিশদের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তাদের দাবী ছিল ভারতের স্বাধীনতা। আর রবীন্দ্রনাথ সারাটা জীবন ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার ছিলেন। উপনিবেশিক বৃটিশ শাসনের উপর তাঁর মনস্তাপের অন্ত ছিলনা। ১৯০৫ সালে ব্রটিশ রাজ রবীন্দ্রনাথকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক ভারতীয়রা যখন চরম নির্যাতিত নিষ্পেষিত হচ্ছিল এবং জালিয়ানওয়ালা বাগে নির্বিচারে গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালাল, রবীন্দ্রনাথ নিশ্চুপ থাকতে পারলেন না। তিনি এর প্রতিবাদ স্বরূপ নাইট উপাধি বর্জন করলেন।  
১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর ছিল এক আকর্ষণীয় শীতের সকাল। নোবেল কমিটি রবীন্দ্রনাথকে জানাল সাহিত্যে  তিনি নোবেল প্রাইজ পেতে যাচ্ছেন। গীতাঞ্জলী কবিতাগ্রন্থটি তাঁকে সেই অনন্য সম্মানের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দিয়েছে। নোবেল কমিটি চিঠিতে লিখলেন, ‘’The Noble Prize in  Literature 1913 was awarded to Rabindranath Tagore because of his profoundly sensitive, fresh and beautiful verse, by which, with consummate skill, he has made his poetic thought, expressed in his own English words, a part of the literature of the west’’.  


যুদ্ধের ভয়াবহতা ও দূরত্বের কারণে কবির পক্ষে যথাসময়ে স্টকহোম গমন সম্ভব হয়ে উঠেনি। যাহোক স্টকহোমের তদানীন্তন বৃটিশ রাষ্ট্রদূত মিস্টার ক্লাইভ কবির পক্ষে স্বর্ণপদক ও সনদ গ্রহণ করেন। ১৯১৩ সালের ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমের গ্রান্ড হোটেলে নোবেল কমিটি প্রদত্ত ভোজসভা থেকে ক্লাইভ রবিন্দ্রনাথকে ছোট্ট একখানা টেলিগ্রাম পাঠালেন। তার পাঠানো টেলিগ্রামের বাণী ছিল এরকম- ‘’ I beg to convey to the Swedish Academy my grateful appreciation of the breath of understanding which has brought the distant near, and has made a stranger a brother’’.


এই টেলিগ্রামের সারমর্মই ছিল কবির পুরস্কার গ্রহণোপলব্ধির উপলক্ষ্য মাত্র। প্রত্যেক নোবেল লরিয়েন্ট স্বশরিরে উপস্থিত হয়ে তার নোবেল ভাষণ উপস্থাপন করবেন, এটিই ছিল কমিটির রেওয়াজ। কিন্তু রবিন্দ্রনাথের বেলায় ঘটে গেল এর ব্যতিক্রম। তিনি দীর্ঘ আট বছর পর তাঁর নোবেল ভাষণ প্রদান করেছিলেন। ১৯২০ সালে কবি আমেরিকা ভ্রমণে যান। তখন সুইডিশ একাডেমির সেক্রেটারি Dr.Erik Axel Karfeldt রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ ভ্রমণের সম্ভাবনার কথা  জানতে পারেন। তিনি টেলিগ্রাম পাঠালেন কবিকে। লিখলেন-‘’ If you intend going Sweden,(the) Swedish Academy bids you welcome to Noble Feast December 10.’’


সুইডিশ একাডেমির আমন্ত্রণ স্বত্তেও কবি যথাসময়ে সুইডেন পৌঁছতে পারলেন না। ১৯২১ সালের ২৪ মে তিনি সুইডেন গমন করেন। স্টকহোমের রেল ষ্টেশনে কবিকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেয়া হয়। তিনি নোবেল ভাষণ প্রদান করেছিলেন মে মাসের ২৬ তারিখ। ষোল পৃষ্টার এই ভাষণে কবি সুইডিশ একাডেমির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এভাবে। ‘’ I am glad that I have been able to come at last to your country and that I may use this opportunity for expressing my gratitude to you for the honour you have done to me by acknowledging my work and rewarding me by giving me the Noble Prize.’’


নোবেল সাহিত্য কমিটিতে ছিল ১৮ জন সদস্য। তাদের মধ্যে Esaias Henrik ও Vilhelm Tegner (১৮৪৩-১৯২৮) প্রাচ্যভাষা বিশারদ। তাঁরা উভয়ে বাংলা জানতেন। গীতাঞ্জলী কমিটির অপরাপর সদস্যের চিত্তে তেমন আলোড়ন জাগাতে পারলনা। কিন্তু একজন সদস্য গীতাঞ্জলীর প্রতি খুবই আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তিনি ছিলেন সুইডেনের সুপরিচিত কবি Verner Von Heidenstam. তিনি রবিন্দ্রনাথের বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং তিনিও ১৯১৩ সালে নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে Heidenstam ১৯১৬ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান।
রবীন্দ্রনাথ নিজেই গীতাঞ্জলীর ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত সচেতন ভাবে গীতাঞ্জলীকে সংস্কৃতের বলয় বন্ধন মুক্ত করেছিলেন। কবিতার বিষয়বস্তু সাধারণ মানুষের আত্মিক চাহিদাকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করেছিল। ইউরোপিয়ানরা গীতাঞ্জলীতেই বাইবেলের মেজাজটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছিল। গীতাঞ্জলীর প্রকাশক ছিলেন W.B Yeats. অনেকে বলে থাকেন সে কারণে গীতাঞ্জলী নোবেল কমিটির অধিক মনোযোগ পেয়েছে। তারা আরও বিরূপ ধারণা পোষণ করত যে W.B Yeats –ই ছিলেন গীতাঞ্জলীর ইংরেজি অনুবাদক।


এসব সমালোচনায় রবীন্দ্রনাথ খুব বিব্রত বোধ করেছিলেন। এর জবাবে তিনি ১৯৩১ সালের ২৯ অক্টোবর লিখেন- ‘’ There is a question in your letter whether I have engaged paid agents to spread my fame. This sort of suspicion is possible only in Bengal. It is here that people whisper that I won the Noble Prize by a trick, and the English of the poems which brought me fame was written by a certain Englishman.’’


রবীন্দ্রনাথ যেরূপ সমালোচনায় নিপতিত হয়েছিলেন, আজকের দিনে অনেক নোবেল লরিয়েন্টকে অনুরূপ সমালোচনা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে ড. মুহাম্মদ ইউনুচের নাম প্রাসঙ্গিক ভাবে এসে যায়। ভদ্রলোকের নোবেল প্রাইজ পাওয়া মোটেও সুখকর হয়নি। নিজের নাক কেটে অপরের যাত্রা অনিষ্টের যে প্রবাদ বাঙালি সমাজে প্রচলিত আছে, রবীন্দ্রনাথ, ইউনুচ তারই শিকারে পরিণত হয়েছেন। ঈর্ষা কাতরতায় বাঙালিদের অবস্থান সর্বাগ্রে কিনা জানিনা। ‘তবে যাহা বলিব সত্য বলিব’ এরকম হলফ করে বলতে পারি বাঙালিরা অন্যের প্রশংসায় বড়ই হাড়কিপ্টে। বাঙালি জাতির ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। মাত্র হাজার বছরের ইতিহাস। ইতিহাস থেকে  জানা যায় ভারতবর্ষের পূর্বপ্রান্তে বঙ্গ ছিল অনগ্রসর জনপদ। প্রাচীনকালে বাঙালি জাতির প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যের প্রকাশ দেখা যায়। এমন কি গালি হিসাবে বাঙ্গাল শব্দটির প্রচলনও ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের কোথাও কোথাও অশিক্ষিত মূর্খ লোকদের বাঙ্গাল বলে হেয় করা হয়। প্রাচীন সাহিত্য চর্যাপদেও এ ধরনের আভাস পাওয়া যায়। বাঙালিদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথেরও আক্ষেপের অন্ত ছিল না। ‘রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’- প্রভুর প্রতি এরকম অভিযোগ তাঁর প্রবল মনোযন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয় ।    
                              -------------------------  
তথ্যসুত্র—গ্লাফ নিউজ
দুবাই