দশক বিচার একজন কবির সময়কাল নির্ধারণের অন্যতম পন্থা । এর মাধ্যমে কবি কিংবা শিল্পী তার কর্মে কালকে ধরে রাখার প্রয়াস পান । বাংলা কবিতায় দশক বিচারের প্রবনতা লক্ষ্য করা যায় রবীন্দ্রনাথের পর থেকে । কবিতায় তার অভিযাত্রা ছিল দীর্ঘকাল ব্যাপি । তাঁর নৈপুণ্য এবং কুশলতা কোন নির্দিষ্ট সময় বা দশকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না । তিনি ছিলেন সর্বকালীন প্রবাহের সাক্ষী । অনেক ক্ষেত্রে সময় এবং প্রবাহেরও অগ্রগামী ।


রবীন্দ্র পরবর্তী তিরিশের দশক থেকে দশক গণনা শুরু হয় । দশক বিচারে কবি হাফিজ রশিদ খান আশির দশকের কবি । দীর্ঘ এক যুগেরও অধিককাল যাবত তিনি আদিবাসীদের জীবনধারা ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন । জীবিকার প্রয়োজনে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন । সেই সুবাদে তিনি খুব ঘনিষ্ঠভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন আদিবাসী জীবনধারা । অভিজ্ঞতার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে কল্পনার সোনালি বীজ বপন করে প্রেম-ভালোবাসা, আশা-নিরাশা,  স্বপ্ন, জীবনের চালচিত্র, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রাত্যহিক জীবনের বিবিধ অনুষঙ্গের সমন্বিত ফসল- কবি হাফিজ রশিদ খান এর  “এই সুন্দর আমাঙ হারাবো ” না কাব্যগ্রন্থটি ।


গ্রন্থটি সমকালীন সময়ে কবিতায় আদিবাসী জীবনচিত্র রূপায়নের অনন্য মাইলফলক । কবিতাগুলো  প্রকরণগত দিক দিয়ে ভিন্ন মেজাজ ও ভিন্ন স্বাদের । গ্রন্থটিতে রয়েছে ৩৯টি কবিতার শৈলী বিন্যাস । এর  মধ্যে ১৮টি কবিতায় কবি ৮টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা থেকে শব্দ আমদানি করে কবিতায় সফল ভাবে প্রয়োগ করেছেন । কবির কাব্য-চেতনায় ভিন্ন ভিন্ন অনুষঙ্গ হয়ে ধরা দিয়েছে খুমি, ত্রিপুরা, চাকমা, ম্রো, মণিপুরী, তনচংগ্যা, রাখাইন প্রভৃতি জাতি-উপজাতির জীবনাচার ।  


বাংলা কবিতায় লোকজ ও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার নতুন নয় । কবি আল মাহমুদ ও কবি মোহাম্মদ রফিকের কবিতায় আমরা পূর্বেই লক্ষ্য করেছি লোকজ শব্দের সার্থক প্রয়োগ । এতে কবিতার কোন প্রকার শিল্পমান ক্ষুণ্ণ হয়নি । আমার ধারনা কবি হাফিজ এই দুই অগ্রজ কবি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলা কবিতায় বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা থেকে শব্দ আহরণের সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন ।


২০০৩ সালে সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত শরীফা বুলবুল সম্পাদিত বলাকা ছোট কাগজে কবি হাফিজ রশিদ খানের একটি সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম । তার সাক্ষাৎকারে বিষয়টি আরও বেশি প্রঞ্জাল হয়ে উঠে । তিনি বলেছেন-  “১৯৯০ সালে পার্বত্য বান্দরবানের ডনবসকো স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হই । এ সময় কবিতা বিষয়ে নানা পঠন-পাঠন আমাকে বুঝতে সাহায্য করলো ঃ বাংলার লোকায়ত জীবনধারার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বিশাল শব্দ ভান্ডারটি বাংলা কবিতার শরীর থেকে ভীষণভাবে আলগা ও অবহেলিত রয়ে গেছে । পাশাপাশি কবি আল মাহমুদ, কবি মোহাম্মদ রফিকের কিছু কিছু কবিতায় বংলার লোকজ ও লোকজ অনুষঙ্গের শব্দাবলীর যুতসই ও আনন্দদায়ক প্রয়োগ লক্ষ্য করে আমার মনে হল; আমাদের প্রতিবেশি আদিবাসী ক্ষুদ্র জনজাতিসমূহের প্রাত্যহিক জীবনের অনেক শব্দ ও শব্দানুসঙ্গ বাংলা ভাষায় অনায়াসে অবস্থান নিতে পারে ।”  


এক্ষেত্রে বলা যায় হাফিজ কোন প্রকার হুজুগ কিংবা স্বপ্নতাড়িত হয়ে এ কাজটি করেননি । কারণ হাফিজ খুব ভালভাবেই জানেন স্বপ্নচারণ আধুনিক কবিতায় উপেক্ষিত । অনুপ্রেরণা লব্ধ সত্যকেও আধুনিক  কবিরা স্বীকার করেন না । এক সময় স্বপ্ন ও অনুপ্রাণিত হওয়াকে কাব্যক্ষেত্রে মুল্য দেয়া হত বেশি ।  বর্তমানে কবিতায় ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ কৌলিন্য বলে বিবেচিত হচ্ছে । প্রতিদিন আমাদের দৃষ্টিসীমায় যে বস্তুগুলো মূর্ত হয়ে উঠে, তাকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করে স্মৃতির ব্যাংকে জমা রাখতে পারছি, সেগুলোকে অস্বীকার করে নিছক কল্পলোকে ভেসে বেড়ানো বর্তমানকালে কবিতার ক্ষেত্রে মূল্যবান বলে বিবেচিত হচ্ছে না । যে বস্তু ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ তার অগোচরে কোন কাল্পনিক সত্যকে বর্তমানকালের কবিরা আবিষ্কারের চেষ্টা করেন না । বর্তমান সময়ের কবিরা যা কিছু দেখেন তার জন্য প্রয়োজন হয় একটি বিশেষ ধরনের অন্তর্দৃষ্টির । সেই অন্তর্দৃষ্টি হচ্ছে বস্তুকে স্পর্শ করে, বস্তুকে উপলব্ধির আয়ত্তে আনা এবং বস্তু দ্বারা সম্পূর্ণভাবে প্রভাবমুক্ত থেকে তার অন্তর্নিহিত নিগুঢ় সত্যকে আবিষ্কার করা বা আবিষ্কারের চেষ্টা করা । কবি হাফিজও স্বীয় প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে স্পর্শ করেছেন অরন্যের সুভাসিত ফুলদের এবং আবিষ্কার করতে চেয়েছেন অরণ্যবাসীদের কঠিন সত্যকে, যা এতদিন তাদেরই নিকট প্রতিবেশী সমতলি সমাজে অজানা ছিল অথবা জানলেও আমরা ভুলে থেকেছি নির্লিপ্তভাবে । এখানেই কবি হাফিজের বিশিষ্টতা এবং বাংলা সাহিত্যে তাকে আমরা স্বাতন্ত্র্যভাবে নির্দিষ্ট করতে পারি ।


মানুষ প্রকৃতির সন্তান । প্রকৃতি মনস্কতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি । হাফিজের মধ্যেও দেখি সেই প্রবৃত্তি ক্রিয়াশীল । প্রকৃতির সাথে এদেশের ভূমিজ সন্তানদের তিনি সমার্থক করে তুলেছেন । তিনি স্বীকারও করেছেন, তার জন্মের আগে নিয়তিই তাকে সেই দায়ভার দিয়েছে । এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি নিজের অজান্তে হয়ে উঠেছেন একজন প্রকৃত আদিবাসী । তিনি সত্যিকার ভাবে উপলব্ধি করেছেন দেশি ও আন্তর্জাতিক এমন কি বিভিন্ন ছদ্মবেশী ঔপনিবেশিক অপশক্তিগুলো আদিবাসীদের ঐশ্বর্য লুটেপুটে নিয়ে গেছে এবং আঘাত হেনেছে তাদের চিরায়ত সংস্কৃতির উপর । যার কারণে আদিবাসীরা অস্তিত্বের সংকটে পতিত । তাদের এমন দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থায় হাফিজ কি বিষণ্ণ না হয়ে পারেন ? তারই একটি সার্থক চিত্র---
“আমার দুচোখে ভাসে নাউই পাখির মত
একঝাঁক বিষণ্ণতা ।”  
( বিষণ্ণতা / পৃষ্ঠা ১০ )  


আদিবাসী গ্রাম কবিতায় হাফিজকে খুঁজে পাই ভিন্নভাবে । তিনি এখানে আদিবাসীদের ইতিহাস ঐতিহ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন । তিনি যখন আদিবাসী গ্রামে গিয়েছেন, সেখানে বাতাসে বৃক্ষের সবুজ গন্ধ ভাসছিল এবং বনপাহাড়ের ফুলগুলো মুখ তুলেছিল আকাশের দিকে ।
হাফিজ বলেছেন---
“ওরা ওই দূর তারাদের চেয়ে সেরা”  
( আদিবাসী গ্রাম / পৃষ্ঠা ১১ )


কবির সাবলীল কাব্যভাষা পাঠককে দূরবর্তী সত্য ও নিকটবর্তী সত্যের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেয় । কবির মতো পাঠকেরও উপলব্ধিতে আসে দূরের তারা নয়, অতি কাছের বনপাহাড়ের ফুলগুলোর শাশ্বত সৌন্দর্য । এই কবিতায় আমরা আরও দেখি ঝিরির পাশেই  ত্রিপুরা বাবুর ঘর, ম্রোদের ডেরা এবং পাহাড়ের পাশেই আদিবাসীদের পাড়াগুলোর অবস্থান । কবি আবিষ্কার করেছেন, এক সময় চাকমারা এই এলাকায় বসবাস করত এবং প্রতিদিন ভোরে তাদের লোকগল্পের  রাজকুমারী ‘রাঙাবি’ অনেক স্বপ্ন নিয়ে আসত তাদের জন্যে । এখন সেখানে মারমাদের ঘর । তাদের ঘরে ঘরে স্বপ্নের নায়ক-নায়িকা ‘সাথানু-মনরি’ খ্রেখ্রঙ বাজাচ্ছে ।


স্বপ্ন এবং কল্পনার দাপট আধুনিক কবিতায় প্রকটভাবে দেখা যায় না । আমাদের শিল্প-সামগ্রীর উপাদান অবশ্যই সনাতন এবং এই উপাদান প্রতিদিনের সংসার থেকে আহরণ করতে হয় । আধুনিক কবিরা তা করে থাকেন বুদ্ধির দ্বারা, চেতনা দ্বারা এবং অভিজ্ঞতা দ্বারা । একজন কবির অভিজ্ঞতা অন্য একজন কবির অভিজ্ঞতা থেকে ভিন্নতর হবে । ব্যক্তি বিশেষের সাথে সাথে দৃষ্টিভঙ্গীরও পার্থক্য থাকবে । সুতরাং কবিতা যদি অভিজ্ঞতা প্রসূত হয়, কবিতা যদি একাগ্র সংকল্প থেকে সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে একজনের কবিতা অন্যজনের কবিতার সাথে মিলবে না- একটা পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে । কিন্তু স্বপ্নের ক্ষেত্রে সে পার্থক্যটা দৃশ্যমান নয় । আধুনিক কবিতার ক্ষেত্রে কবির এই যে নিষ্ঠা, অর্থাৎ অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করা, অভিজ্ঞতাকে লালন করা এবং অভিজ্ঞতার সত্যের মধ্যে জীবনকে আবিস্কার করা- কবির এই স্বভাবের মধ্যে বর্তমান সময়ের চেতনাকে পাঠক আবিস্কার করতে পারেন । তাই এই গ্রন্থটির মুল্যায়নে বলা যায়- এটি কবির অভিজ্ঞতালব্ধ চৈতন্যের প্রতীক বিন্যাস ।


আমার মনে হয় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের একটি উদ্বৃতি এখানে প্রাসঙ্গিক হিসেবে উল্লেখ করা যায় । তিনি বলেছেন- “ অভিজ্ঞতার নিজস্বে যদি কোন কবিতা সমৃদ্ধ না হয়, তাহলে সে কবিতার অভিব্যক্তি বিশিষ্ট হবে না । অভিজ্ঞতার স্বকীয়ে যে মুহূর্তে কবিতা বিশিষ্ট হচ্ছে সে মুহূর্তে কবিতার রূপকল্পও একটি  বিশিষ্ট স্বকীয়ে পাঠকের সামনে উপস্থিত হবে । ”


আমরা দেখি, এই সুন্দর আমাঙ হারাবো না, বিষণ্ণতা, আদিবাসী গ্রাম, গেংখুলি গায়ক, মনের মণিপুরে, মাঘনিশীথের যুবক, কাব্যং শরং, জুমিয়া পাড়ার ঘর, রিঝি, অহিংস, যাইনি গভীর বনাঞ্চল প্রভৃতি কবিতা ছাড়াও আরও অনেক কবিতা বিশিষ্টরূপ নিয়ে হাজির হয় পাঠকের কাছে । পাঠকের মনোচৈতন্যে জেগে উঠে দিগন্তবিসারী পার্বত্যাঞ্চলের প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, ছোট ছোট আদিবাসী গ্রাম, জীবনের চালচিত্র, ধর্মীয় মিথ, লোকজ ঐতিহ্য, কৃষি নির্ভর পরিশ্রমী কর্মজীবন, প্রেম-ভালোবাসা ইত্যাদি বিষয়াবলী ।


এখানে পাঠক নিজেই কল্পলোকের কবি হয়ে উঠে । চিম্বুক আর ফুরামেন পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আদিবাসী গ্রামে হাফিজ আর পাতার মুকুট পরা নিঃস্ব মানুষ নয় । তিনি হয়ে উঠেন তাদের কাছে মেনলে ম্রো এর  মতো প্রার্থিত পরম ব্যক্তিত্ব । আবার হাফিজকেও দেখি শীতরাতে পাহাড়ি বন্ধুর সাথে একাত্ম হয়ে যেতে । বন্ধুর মেন্ডোলিন সুরে জ্বলে উঠে তার সবুজ হৃদয় । তার মন পড়ে থাকে বনের গভীরে জুমঘরে । আর এখানেই তিনি রাঙাবিকে কামনা করেছেনে সে যেন সয়ম্ভর সভায় আসে মহাভারতের পঞ্চপান্ডবের গুণবতী স্ত্রী দ্রোপদী হয়ে । অর্থাৎ তিনি জুমঘর কে মহাভারতের স্বয়ম্ভর সভার সাথে তুলনা করেছেন । আর চাকমাদের লোকগল্পের রাজকুমারী রাঙাবি কে তুলনা করেছেন দ্রোপদীর সাথে । কবি এখানে অসাধারণ সৃষ্টিশীল কবিসত্ত্বার পরিচয় দিয়েছেন ।  


কবির ভাষায় ---
“বনের গভীরে গড়া মন-জুমঘরে
তুমি রাঙাবি দ্রোপদী হয়ে এসো স্বয়ম্ভরে । ”


হাফিজের কবিতায় দেখি মানবতাবাদের মর্মর ব্যঞ্জনধ্বনি । মানুষের উপস্থিতি ছাড়া যেমন প্রকৃতি নিঃস্ব, প্রকৃতি হয়ে পড়ে মূল্যহীন, তেমনি কবিতা যদি মানব জীবনকে স্পর্শ না করে  সে কবিতার আবেদন হয় গৌন এবং তা সাময়িক উম্মাদনা ছাড়া আর কিছু নয় । হাফিজ ছিলেন এ বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন বিধায় তার কবিতা পাঠককে কোন প্রকার উম্মাদনার অলীক স্রোতে ভেসে নিয়ে যায় না । তার কবিতা যে বস্তুভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে এরই শাশ্বতরূপ একদা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল চিম্বুক পাহাড়ের গাঢ় কালো মেঘে । তিনি সেই অশুভ মেঘের পর্দা উম্মোচন করে আদিবাসীদের শাশ্বত সত্য আবিস্কারে ব্রতী হয়েছেন এবং আমরা দেখি, পাঠকও সেখানে তার সহযাত্রী । কেননা এ গ্রন্থে তিনি খুলে দিয়েছেন পাঠকের তৃতীয় নয়ন ।  
আমরা জানি মানবতাবাদের মূলমন্ত্র নিহীত বুড্ডিজমে । হাফিজের ঝোঁকও সেদিকেই । গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব তৎকালীন ভারতবর্ষে প্রচলিত আর্য কৌলিন্য প্রথার উপর মারাত্মকভাবে আঘাত করে মনবতাবাদের যে জয়গান গেয়েছিলো এরই বলিষ্ঠ উচ্চারণ হাফিজের মাঘনিশীথের যুবক কবিতাটি । এখানে মাঘনিশীথের যুবক হচ্ছে কপিলাবস্তুর শান্ত, সুশ্রী গৌতম বুদ্ধ । যার মতবাদ আঘাত হেনেছিল আর্য সংস্কৃতির উপর ।


কবির ভাষায় ---
“রাগী সূর্যোদয়ে ভেঙে দিলো আর্যত্বের জীর্ণ লোকাচার
আর মদির স্থাপত্যকলা ।”
( মাঘনিশীথের যুবক/ পৃষ্ঠা ১৯ )  


মানুষ পৃথিবী নামক গ্রহের বাসিন্দা । মানুষের জীবনকে ঘিরে আছে সুখ আর দুঃখ দুই সহোদর । মানুষ সুখেও শান্তি চাই আবার দুঃখেও শান্তি খুঁজে । কখনও স্রষ্টার কাছে, কখনও নিসর্গের কাছে, আবার কখনও আপনজনের কাছে যুগে যুগে শান্তির নির্ভার আশ্রয় খুঁজেছে মানুষ । জীবনানন্দও দুদন্ড শান্তি খুঁজে পেয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেনের কাছে । কাব্যং শরং কবিতায় দেখি পার্থিব জ্ঞানসমৃদ্ধ ভিক্ষু সম্প্রদায় অরণ্যের আলো-আঁধারি পিচঢালা পথ বেয়ে যেতে যেতে আশ্রয় প্রার্থনা করছে অমিতাভ গৌতম বুদ্ধের কাছে । কিন্তু হাফিজ এখানে ব্যতিক্রম । তার ধ্যানে-জ্ঞানে একমাত্র কবিতা ছাড়া বাকি সবকিছু গুরুত্বহীন । তাই তাকে তেলাওয়াত করতে শুনি কাব্যং শরং গচ্ছামি । এখানেই প্রতিভাস হয় হাফিজ একজন আপাদমস্তক কবি ।


হাফিজের কবিতায় প্রেমের বিষয়টি এসেছে অত্যন্ত সুন্দর এবং সাবলীলভাবে । বৈশাখি পূর্ণিমাতে আদিবাসী প্রিয়তমাকে পাওয়ার আকুতি এবং সুতন্বী শংখ নদীর কূল ঘেঁসে পাহাড়ের চূড়ায় উঠার তীব্র ইচ্ছা ব্যক্ত হতে দেখি কবির কণ্ঠে । সন্ধ্যায় মেঘভাঙা ভরা পূর্ণিমার পূর্ণচাঁদের উল্লাসিত মুখ নিয়ে কবির প্রিয়তমা আসবে বলে তিনি প্রায়িঙ ( চোলাই মদ ) পানের আহবানকে উপেক্ষা করে প্রতীক্ষায় উদগ্রীব থেকেছেন ।  


“সন্ধ্যার সুবাসে আসবে আমার খ্যাসুগা  
মেঘভাঙা ভরাচাঁদের স্বভাবে উল্লসিত মুখ
মনে নেই আজ বৈশাখি পূর্ণিমা ।”
( আজ বৈশাখি পূর্ণিমা/ পৃষ্ঠা ২৬ )


আধুনিক কিছু কিছু কবিদের ক্ষেত্রে একটা প্রবনতা লক্ষ্য করা যায় । কাব্যগ্রন্থে কবিতার সাথে কয়েক পৃষ্টা গদ্য জুড়ে দেয়া । কবিতার অতৃপ্তি থেকেই কী তারা কাজটি করে থাকেন তা পরিষ্কার নয় । হাফিজও সে পথের পথিক । তিনি ম্রোদের ধর্মগুরু মেনলে ম্রো (পৃঃ ১৩ ) এর যে ইতিহাস তুলে ধরেছেন তাকে কবিতা বলতে কষ্ট হয় । কাব্যগ্রন্থে কবিতার সাথে গদ্যের সহ-অবস্থান কাব্যানুরাগী পাঠকের মনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে । তারপরও গদ্য কবিতা বলে একটা কথা আছে ।  


আদিবাসীদের খন্ড খন্ড জীবনচিত্রের স্টিল ফটোগ্রাফী প্রচ্ছদকে করেছে অত্যাধিক আকর্ষণীয় এবং   গ্রন্থটিকে করেছে আরও অর্থবহ । প্রচ্ছদশিল্পী পীযূষ দস্তিদার কে ধন্যবাদ দিতেই হয় ।


গ্রন্থটিতে বিভিন্ন আদিবাসী শব্দাবলীর বাংলা টিকা প্রদান করাতে পঠন-পাঠনে পাঠকের কোন প্রকার অসুবিধা হবে বলে আমার মনে হয়নি । এখানে হাফিজ আদিবাসী সবুজ সেবিকাদের ( চা শ্রমিক বা শ্রমজীবী নারী ) হাতের অভয় মুদ্রায় যে স্বপ্ন দেখেছেন তা যেন শাশ্বত হয় সে কামনা করছি এবং কবির কণ্ঠে একাত্ম হয়ে বলছি -- এই সুন্দর আমাঙ হারাবো না ।  
       -------------------------------
দ্রষ্টব্য -- চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ছোটকাগজ পুষ্পকরথ ও কক্সবাজারের দৈনিক বাঁকখালী তে প্রকাশিত ।


নাহার মনজিল
গোল দিঘি, কক্সবাজার ।
সেপ্টেম্বর , ২০০৯ খৃঃ