“চীন দেশের কবিতার স্বর্ণযুগ কোনটা?”
“ট্যাং যুগ।”
“চীন দেশের কবিতায় ‘হারমিট’ কাকে বলা হয়?”
একটু ভেবে বললাম, “দু মু-কে।”
“চীনের ক্লাসিক্যাল কবিতায় সর্ব শ্রেষ্ঠ কবি কে?”
“দু ফূ।”
আজ ওয়ান সুণ থাং বলেছে ওর পাঁচটা প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর দিলে, তবেই গল্প। ণা হলে পিৎজা খেয়ে বাড়ী। রবিবার সকালের এই আড্ডাটা আমি কোন ভাবেই মিস করি না। যাই হোক, তিনটে প্রশ্ন হল। বাকি আরও দুই। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে ওয়ান সুণ থাং ওর পরের প্রশ্ন করল।
“মডার্ন চীনা সাহিত্যের প্রথম মহিলা কবির নাম?”
“বিং জিন।”
“ব্রাভো! শেষ প্রশ্ন। রেডি?”
হেসে বললাম, “রেডি।”
“জুয়েজু ঘরানার কবিতার শ্রেষ্ঠ কবি কে?”
এই মেরেছে, জুয়েজু-টা আবার কী? আমাকে চুপ থাকতে দেখে ওয়ান সুণ থাং ভুরু নাচিয়ে বলল, “কি, পারলে না তো? আজ নো গল্প।”
কি আর করি, ওকে জোরাজুরি করে লাভ হবে না জানি। তাই বললাম, “চীনা কবির গল্প নাই বা বললে, এই জুয়েজু জিনিষটা কি সেটা তো বলবে?”
একটু ভেবে ও বলল, “আচ্ছা তাই। জুয়েজু হল এক ধরণের কবিতার স্টাইল। এখানে প্রতি দুই লাইনের মিল থাকবে। হ্যানস ফ্রাঙ্কেলের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই?”
এটা জানতাম, বললাম, “চীন ভাষা বিশেষজ্ঞ সেই জার্মান প্রোফেসর তো?”
“কারেক্ট। এই ফ্রাঙ্কেলের মতে পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতাব্দীতে প্রথম দেখা যায় এই ধরণের কবিতা। আর প্রধানত ট্যাং সাম্রাজ্যের কবিতায় এই ধারা দেখা যায়।”
“আচ্ছা। তা এই ধরনেই কবিতার শ্রেষ্ঠ কবি কে?” ওয়ান সুণ থাং-এর প্রশ্নটাই ওকে করলাম।
প্রশ্নটা শুনে হো হো করে একটু হাসল ও। তারপর বলল, “গল্প বলিয়েই ছাড়বে না?”
এরপর আমাকে আর বেশি কিছু বলতে হয়নি। ওয়ান সুণ থাং নিজেই একটা বই নিয়ে এসে গল্প শুরু করে দিল, চীন দেশের বিখ্যাত কবি আর জুয়েজু কবিতার শ্রেষ্ঠ ওয়াং ওয়ে-র গল্প।
ওয়াং ওয়ে চীন দেশের সেরা কবিদের মধ্যে একজন। ৬৯৯ খ্রিষ্টাব্দে জিনঝং-এ জণ্ম গ্রহণ করেছিলেন। ট্যাং সাম্রাজ্যের সেরা কবি বলা হয় তাকে। দু ফূ-র সাথে একি আসনে বসানো নয় ওয়াং ওয়েকে। ‘Three Hundred Tang Poems’  কাব্যগ্রন্থে তাঁর লেখা ২৯ টা কবিতা আছে।
উনি বিশেষত কবি ও চিত্রকার ছিলেন।  ওনার লেখা কবিতার মাত্র চারশোটা উদ্ধার করা গেছে, বাকিগুলো হারিয়ে গেছে সময়ের অন্ধকারে। ওনার লেখা একটা কবিতা অনুবাদ করলাম।


                       সংসান পাহাড়ে ফিরে যাওয়া


ছোট্ট নদীটা নির্জন ঝোপের মাঝে বয়ে চলে,
ঘোড়ার গাড়িটাও ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে পথে,
জল যেন নিজের ইচ্ছে মতই এগিয়ে চলতে চায়,
বিকেল হলে, পাখি দুটো পাশাপাশি বসে গাছের ডালে।
পরিতক্ত গ্রামটায় কোন আদিম আভিসাপ বিরাজমান,
অস্তমিত সূর্যটা শরতের বাতাস ছড়িয়ে দেয়,
দূরে দেখা যায় সংসান পাহাড়ের চুড়া,
ঘরে ফিরে আমি মনের জানলা বন্ধ করে দি।  


ওনার লেখা সম্বন্ধে সূ ছি নামক এক চীনা সাহিত্যিক বলেছেন, “ওয়াং ওয়ের কবিতা যেন এক একটা চিত্র স্বরূপ। আর ওনার আঁকা ছবিগুলো যেন এক একটা কবিতা।”
সাধারণত ওনার লেখায় আমরা বিশেষ ভাবে প্রকৃতিকে পাই। পাহাড় আর নদী বিষয়ে ওনার লেখা অতুলনীয়। উদাহরণ স্বরূপ দুটো কবিতা অনুবাদ করে দিলাম।


                              ১) নদীর দক্ষিণ প্রান্তে


নদীর দক্ষিণ দিকের উদ্দেশ্যে ছোট নৌকোটা,
এই নদী পার হওয়া বেশ দুষ্কর,
দক্ষিণ পাড়ে আমার জন্মস্থান,
কিন্তু, এখন আর কেউ আমাকে চিনতে পারবে না,
সেই গ্রামটায়।


                                ২) হুয়াজি পর্বত


ঈগলের উচ্চতার কোন বাঁধ নেই,
পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসে শরতের সকাল,
হুয়াজি পর্বতের উপর থেকে দেখি,
দুঃখের কোন অন্ত নেই নীচে।


প্রকৃতি নিয়ে কবিতা লেখায় উনিই ছিলেন শ্রেষ্ঠ। ওনার সমসাময়িক কবি মেণ হাওরান-ও এই বিষয়ে বিশেষ পটু ছিলেন। সেই সময়ের প্রকৃতি বিষয়ক কবিতাকে ওয়াং-মেণ ধারার কবিতা পর্যন্ত বলা হত। শেষ বয়সে, ওয়াং ওয়ের চাকরীতে মন ছিল না। উনি ডুবে থাকতেন ধর্ম আর কবিতা নিয়ে। সেই সময়ের লেখা একটা কবিতা দিলাম।


                                  আমার উত্তর


এখন বয়স হয়েছে বেশ, তাই নিস্তব্ধতার মর্মটা বুঝি,
দেশের রাজনীতি আর আমাকে ভাবায় না,
ভবিষ্যতের বিশেষ কোন পরিকল্পনাও নেই,
আমি এখন বৃদ্ধদের জঙ্গলে চলে যেতে চাই।
পাইন গাছ থেকে ভেসে আসা হাওয়া আমার মাথা ছুঁয়ে দেয়,
পাহাড়ের পিছনে চাঁদ উঁকি দেয়, আমি শান্ত,
তুমি জানতে চাও, পৃথিবী কেন এই রকম শান্ত নয়,
আমি বলি, এই দেখ
নদীর ধারে মাছুয়ারাটা কি শান্তিতে গান গাইছে।


ওনার লেখায় আমরা প্রকৃতিকে পাই ঠিকই, কিন্তু মানুষের চিহ্ন খুব কম থাকে ওনার কবিতায়। উনি প্রকৃতির সৌন্দর্যকে নিজের কবিতায় এনেছেন ঠিকই, তবে সেই সৌন্দর্যের বাস্তবতা সম্বন্ধে প্রশ্নও রেখেছেন তাঁর লেখায়। ওয়াং ওয়ের আর তিনটে কবিতা অনুবাদ করলাম।


                                 ১) বিদায়


আমারা একে অপরকে বিদায় জানালাম সেই চেনা পাহাড়ের নীচে,
যখন বিকেলে, দিন মিশে যায় সন্ধ্যের আঁচলে, আমি মনের দরজা বন্ধ করি।
আগামী বছর শরতে আবার মাঠ ভরে যাবে নতুন সবুজ ঘাসে,
ভাবি, আমার বন্ধু কি আবার নতুন করে ফিরবে আমার পাশে?


                                ২) কবিতা


তুমি আমার নিজের গ্রাম থেকে এসেছ,
আমার ঘরের খবরটা জানো তুমি।
ভোরবেলা দেখি জানলার ঝাপসা কাঁচে,
নতুন ফুল ফোটার সময় এখনো আসে নি।


                                 ৩) আবদ্ধ

পাহাড়ি রাস্তাটা নির্জন, মানুষের দেখা নেই,
তবুও দূর কোথাও শব্দ আসছে কথা বলার,
গভীর বনানীর মাঝে দিনের আলো প্রবেশ নিষেধ,
শুধু পথের শেওলাগুলো স্নান করে আদিম সূর্যালোকে।


আজকের লেখাটা শেষ করছি ওনার লেখা সেরা কবিতাটা দিয়ে। আশা করি চীন দেশের মহান কবি ওয়াং ওয়ের গল্পটা আপনাদের খারাপ লাগলো না।


                                একক হৃদয়


শরত কালে যখন নতুন ফল ধরবে,
তোমার বাগানে, তোমার বসানো গাছে,
এক মুঠো তুলে রেখো আমার জন্য,
আমাদের ভালোবাসার নামে।