গত রবিবার চীনে ফিরে এসেছি। দেশে গিয়ে সত্যিই সময় পাইনি লেখার। তবুও একটা লেখা দিয়েছিলাম অনেক কষ্টে। এবার থেকে আবার নিয়মিত আসব চীন দেশের কবিতা নিয়ে। যে গুটিকতক মানুষ আমার এই চীন দেশের কবিতার সিরিজ পড়েন, এই সাময়িক বিরতির জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আজ নিয়ে এলাম চীন দেশের পাঁচ কবিতা সিরিজের পাঁচ নম্বর পর্ব। আজ আমি বলব চীন দেশের বিখ্যাত অথচ বিতর্কিত কবি মাং কে-র কথা। সাথে থাকবে তার লেখা পাঁচটি কবিতার অনুবাদ।
জিয়াং শিওয়েই ১৯৫১ সালে বেজিং শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। জিয়াং শিওয়েই বলে ওনাকে বিশেষ কেউ হয়তো চিনতে পারবে না। উনি বিখ্যাত মাং কে নামে। চীন দেশের বিখ্যাত ‘মিস্টি পোয়েট’ –দের অন্যতম এই মাং কে। শুধু কবি নন, চিত্রকর হিসাবেও বিশেষ বিখ্যাত ছিলেন ইনি। ১৯৭৮-৮০ সালে উনি কবি বাই দাও-য়ের সাথে জিয়ান্তিয়ান নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। যদিও চীনা সরকারের হস্তক্ষেপে সেই পত্রিকা ১৯৮০ সালে ব্যান করা হয়। জিয়ান্তিয়ান চীন দেশের প্রথম বেসরকারি পত্রিকা। চীন দেশে ওনার লেখা কোনদিন গ্রহণযোগ্যটা পায়নি। ওনার কবিতা বিশেষত ফোটোকপিতেই পাওয়া যায়। যদিও ওনার কবিতার ইংরেজি অনুবাদের একটা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। নাম ‘October Dedications’’। বর্তমানে উনি বেজিং-য়ের বাইরে সংঝউ শহরে বসবাস করছেন। ওনার লেখা পাঁচটা কবিতার অনুবাদ দিয়ে আজকের লেখা শেষ করছি। কেমন লাগলো জানাবেন।  


                                   মতবিরোধ
            
জীবনের জন্য


মাঝে মাঝে আমি পাহাড়ের কাছে চিৎকার করি,
পাহাড় ফিরিয়ে দেয় আমার চিৎকার।
আমার স্বর
আমাকে বিষণ্ণ করে।


জন্মভূমির জন্য


আমার জন্মভূমি!
তুমিই আমার স্বপ্নের জন্ম দাও।


সূর্যের জন্য


আজ আবার তুমি ঘুম ভেঙে উঠেছ
তোমার চুলে শুভ্র রং ধরেছে।


কবির জন্য


তুমি একটা ঈগল পাখির মত,
উড়ে চলেছ গোরস্থানের দিকে।


মেয়েটির জন্য


সময় আমাকে মানুষ করতে পারেনি
কিন্তু সেই অল্প সময়ে
তুমি দিয়ে গেছ এক অস্থির উষ্ণতা।


রাতের জন্য


কোন নারীই কোন পুরুষকে অস্থির করতে পারে না
আর কোন পুরুষই কোন নারীকে করতে পারে না গর্ভবতী


পিংয়ের ১৮ তম জন্মদিনের জন্য


ছোট্ট শিশুটার অসুস্থ চোখে
যাও, খুঁজে পাবে পৃথিবীর সৌন্দর্য্য।  


কবিতার জন্য


মহান অথচ শীতল কল্পনায়
আমরা পাল্টাচ্ছি
এক নতুন ভয়হীন জীবনে।


কারুর জন্য


এই কথাটাই যথেষ্ট।


বন্ধুর জন্য


এই শক্তিহীন আঙুল
পরিণত হয় শক্তিশালী পাঞ্জায়।


শীতের জন্য


জীবন
দেশলাইয়ের মত জ্বলে।
উষ্ণতা দেয়
পুড়িয়ে দেয়
আর পড়ে।


আমার ২৩ তম জন্মদিনের জন্য


সুস্থ
উজ্জ্বল
স্বপ্নে ভরা।


                                      বাতি


হঠাৎ বাতিটা জ্বলে ওঠে
আমি শুধু দেখি আলোর ভয়ঙ্কর নখ
আঁচড় কাটে আমার শীতল ললাটে।
বাতিটা তার ডানা ঝাপটায়।
আমি বিস্ফারিত চোখে দেখি
তার বীভৎস ডানার নীচে
সাগরের মত শান্ত
এক জোড়া মৃত চোখ...


হঠাৎ বাতিটা জ্বলে উঠল।
একটা বিরক্তির জন্ম দিল।
আমার মাতাল চোখ চিৎকার করে উঠল
‘কোথা থেকে উড়ে এলে?
কেন চলে যাচ্ছ না?
কেন আমাদের খেয়ে ফেলছ?
আমরা অন্ধকারেই মরতে চাই।’


হঠাৎ বাতিটা জ্বলে উঠল
আমার কানে কে যেন প্রশ্ন রেখে গেল ঠাণ্ডা নিশ্বাসের
‘বাতিটা জ্বলুক,
নাকি নিভিয়ে দেওয়াই শ্রেয়?’


                                  চাঁদ আর রাস্তা


১)
চাঁদটা আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়।
আমি চাই কালকেও সে আমার সাথে আসুক।
সেই চিরন্তন শান্তির মাঝে...


২)
মিয়াঁও, মিয়াঁও, মিয়াঁও...
আমাকে বিরক্ত কর না।
তুমি কি মানুষ
না আরও ভালো কোন জীব?


৩)
নিশ্চই,
মানুষ না হওয়াও গর্বের।
কিন্তু তুমি?
তুমি বিড়াল।
আর ইঁদুর ভেবে তুমি তাকাও মাও-য়ের দিকে।


৪)
আমি চাই কালকেও সে আমার সাথে আসুক।
যাই হোক –
একটু ভাবনা ভালো, একটু ভালো ভাবনা।


৫)
জীবনটা খুব সুন্দর।
ঘুমাও!


৬)
নর্দমার জলে ভেসে যায় চাঁদ।
আমি তাঁকে ছুঁতে পারি না।
ঠিক সেই সময়, হঠাৎ সে হারিয়ে যায়, কোথায়।


                                সূর্যের আর সূর্যমুখী


তুমি কি দেখেছো?
তুমি কি দেখেছো সূর্যের আলোয় সূর্যমুখী ফুল?
তুমি দেখো সে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে নেই
সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়
ঠিক যেন কামড়ে ছিঁড়ে দিতে চায়
তার গলার দড়িটা
সূর্যের ইশারায় আর নাচবেনা সে।

তুমি কি দেখেছো?
তুমি কি দেখেছো সূর্যমুখীটা সূর্যের দিকে তাকিয়ে?
তার দৃষ্টি কঠোর।
মাথা দিয়ে প্রায় ঢেকে দিয়েছে সূর্যকে।
একদিন যখন কোন সূর্য থাকবেনা
সূর্যমুখীটা তখনও মাথা উঁচিয়েই থাকবে।  


                       একটি কবিতা বসন্তকে উৎসর্গ করে


১) শস্য


সন্তর্পণে বসন্ত ভরিয়ে দেয় আমার মুখ,
আমি স্বপ্ন দেখি।


২) কাজ


আমি ঘোড়া আর ঘোড়া গাড়ির সাথে এক হয়ে
সূর্যকে টেনে আনব গমের ক্ষেতে...


৩) ফল


নিষ্পাপ শিশুদের,
নিষ্পাপ চোখ;
অগুন্তি রূপকথার মাঝে
সূর্যটা ঠিক যেন একটা লাল আপেল।


৪) বসন্তে বনানী


এখানে তোমার দেখা নেই।
নেই তোমার মধুর স্বর,
শুধু আঁকাবাঁকা পথের মাঝে পড়ে আছে একটা লালচে ওড়না...


৫) পৃথিবী


আমার যত আসা
পুড়ে গেছে সূর্যের তাপে।


৬) ভোর


আমি চাই, তুই আর আমি একসাথে
মুছে দেব রাস্তার সব অন্ধকার।


৭) নৌকা


ঠিক সময়ে
আমি ফিরে আসব ঝোড় হাওয়ার হাত ধরে।


৮) শুধু তোমারই


সূর্যের আলোয় রাঙা একটা গোলাপের পাপড়ি
নিবেদন করব তোমার প্রেমে।


আজ এখানেই শেষ করছি। আবার ফিরে আসব পরের সপ্তাহে চিন দেশের অন্য কোন কবির কবিতা নিয়ে। ভালো থাকবেন সবাই।