আজ নিয়ে এলাম চীন দেশের পাঁচ কবিতা সিরিজের ছয় নম্বর পর্ব। আজ আমি বলব চীন দেশের বিখ্যাত অথচ বিতর্কিত কবি দুও দুও-র কথা। ইনিও সেই বিখ্যাত মিস্টি কবিদের একজন। সাথে থাকবে তার লেখা পাঁচটি কবিতার অনুবাদ।
লি শিঝেং, ১৯৫১ সালে বেজিং শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। চীনা সাহিত্যে তিনি দুও দুও নামেই বিখ্যাত। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় উনি বেজিং থেকে বাইয়ান্দিয়ান নামক গ্রামে যেতে বাধ্য হন। সেখানেই তাঁর কবিতা লেখার শুরু। তাঁর স্কুলের সহপাঠীরা ছিলেন কবি বাই দাও, কবি গু ছেং ও কবি মাং কে। এক সময় উনিও এই মিস্টি কবিদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
দুও দুও-র প্রথম দিকের কবিতা ছোট আর কঠিন ভাষায় রচিত, আর বেশির ভাগ কবিতাই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা। ওনার কবিতায় ছায়া দেখা যায় বিখ্যাত সব কবি চার্লস বুঁদেলের, মারিনা ভেতিয়াভা, সিল্ভিয়া প্লাত –এর কবিতার।  ওনার পরবর্তী কবিতাগুলো (১৯৮০ সালের পর) অন্য স্টাইলে লেখা, বড় আর দার্শনিক ভাবধারার। উনি অন্তমিলের কবিতা কিচ্ছু লিখেছিলেন বটে তবে ওনার বিখ্যাত কবিতাগুলো সবই গদ্য কবিতা যেমন ১৯৮৪ সালে লেখা ‘শিক্ষা’। এই কবিতাটিতে উনি চীনের হারিয়ে যাওয়া যুগের কথা বলেছেন ঠিক যেমন বলেছেন কবি বাই দাও তাঁর ‘উত্তর’ নামক কবিতাটায়।
১৯৮৯ সালের ৪ ঠা জুন, তিয়ানান্মেন প্রতিবাদের সময় উনি লন্ডন যাচ্ছিলেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামের আমন্ত্রনে। তিনি আর ফেরন নি। তারপর বহুবছর তিনি ইংল্যান্ড, কানাডা আর হল্যান্ডে বসবাস করেন। আবার পরিবর্তন হয় ওনার কবিতার ভাব, এইবার আসে বিতাড়নার যন্ত্রণা আর দেশাত্ববোধ। চীনা ভাষার লোকের অভাবে দুও দুও চীনা ভাষায় লেখা কমিয়ে দেন। ‘সাগরের দিকে তাকিয়ে আছি’ সেই সময় লেখা ওনার বিখ্যাত কবিত।  
২০০৪ সালে, দুও দুও চীনে ফিরে আসেন ডাচ পাসপোর্ট নিয়ে। তৎকালীন চীনা কবিদের কাছে উনি হয়ে ওঠেন ভীষণ রকম জনপ্রিয়।  বর্তমানে উনি হাইনান বিশ্ববিদ্যালয়য়ে অধ্যাপনা করেন। ২০১০ সালে ওনাকে সাহিত্যে নেউস্ট্যাড আন্তর্জাতিক পুরুস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়। উনিই একমাত্র চীনা লেখক যিনি এই পুরস্কারটি পান। ওনার লেখা পাঁচটি বিখ্যাত কবিতার অনুবাদ দিয়ে এই লেখা শেষ করছি। আশা করি খারাপ লাগলো না। কেমন লাগলো জানাবেন দয়া করে।


                              আজ, শেষ রাত


জুঁই ফুল, শেষ দিনটা আর ভেসে যাওয়া;
কত বিছানা ভরে থাকে বীজে, জন্ম দেয় প্রেমের।
আজ, বরফের তৈরি পিয়ানোয় সুর তোলে সময়;
মাছটার গভীর ভাবনার ফল,
সাগর যেন তবুও নিশ্চল, মাঝে মাঝে শুধু ফুলে ওঠে।
আজ, হাওয়া যেন নতুন গান গাইছে
আজ, ওখানে শান্তি আর এখানে? বাদ দাও।
চার্চের দরজাটাও আজ বন্ধ।
আজ, কোন ভিখারি ভিক্ষে চায়নি
সেই সব চোখ যা আমাদের দেখত আর দেখে পরস্পরকে।
চল, যাবতীয় গোপন কথা আজ চেঁচিয়ে বলি সবাই,
মেঘের ওপার থেকে কেউ জড়িয়ে নেবে আমায়।

আজ, প্রথমবার আমরা দুদিক ফিরে শোব।


                          যে ছেলেটা প্রজাপতি ধরে


যখন এখানে বাতাস নেই, পাখিরা আছে;
“যখন পাখিরা আছে, সকাল নেই।”
যে ছেলেটা প্রজাপতি ধরে বেড়ায়, প্রবেশ করল ছবিটার ভীতর,
গাছেদের ডাক অগ্রাহ্য করে পাখিরা।
“মা, তোমার গমের ক্ষেত আমায় ডাকে।”
তিনটে সূর্য ছুটে আসে একটি পাখির দিকে।
“মা, আস্তাবলের ঘোড়াটা খুব ডাকছে।”
পৃথিবীর সবচেয়ে কালো ঘোড়াটা ছুটে আসে;
“মা, অজানা ঠিকানা থেকে একটা কফিন এসেছে।”
ছেলেটার মাথায় ঘুরছে ঐ বনের গাছগুলো,
ছেলেটার চিৎকার ঢেকে দিয়েছে একখানা ক্ষুদ্র ফল।
ছবিটার বাইরেও অনেক মানুষ আছে,
ছেলেটা, পাঁচ পায়ে দাঁড়িয়ে, এখন।
ওর পাগুলো আস্তে আস্তে বালি হয়ে যায়
প্রশাখাটা পাতার জন্ম দিতে অক্ষম
পচে যাওয়া ফল চিৎকার করে ওঠে – “তুমি-আমরা।”


                                  হঠাৎ


কারখানায় বন্দী লোকটার মনে পড়ে যায় রাস্তার কোলাহল।
সন্ধ্যার আকাশের শেষ আলোটুকু হারিয়ে যাচ্ছে।
মৃত রেল ষ্টেশনের গায়ে
ছড়িয়ে আছে পচা গলা অন্ত্র।
তার বাইরে আর কিছুই নেই
শুধু একটু আশা, ভেসে আছে নদীর বুকে
সেই আশাটুকু ঐ স্বপ্নের সম্বল।


এখন সব নিশ্চুপ;
শুধু শান্তি বিরাজ করে কারখানাটায়।
গাছেরা রঙ বদলে ফেলেছে
শিশুরা দুগ্ধ পান করে নিঃশব্দে।
নৌকোটাও ভেসে থাকে বালির মাঝখানে।
আমরা দেখি, ঠিক যেমন টালি দেখে ছাদকে,
আমরা গন্ধ শুঁকি, তুমিও – একসাথে।
সবকিছু এখন মৃতপ্রায়।
যারা বেঁচে ছিল, এখন শুধুই টিমটিমে আলো।
যারা আছে, তারা অপেক্ষারত।
যারা বলেছিল, যে আমাদের জীবন ক্ষণিকের
আজ সেই ক্ষণ, ঠিক যেন নদীর জল,
হঠাৎ ভাসিয়ে দেয় দুই পাড়।


                                   মারিনা


“মারিনা, আমি তোমায় ভালবাসি।”
ঠিক কালকের মতই সে আমায় দেয় তার সিক্ত ঠোঁট দুটো।
শান্ত, নিশ্চুপ সেই ক্ষণ
“আমি তোমারই, মারিনা।”
ঠিক কালকের মতই তার নীলচে চোখদুটো চেয়ে থাকে দূরে
সৌভাগ্যের কোন লক্ষন নেই, নেই দুঃখের...


“আমায় ছেড়ে যেওনা, মারিনা।”
ঠিক কালকের মতই, আজও সে আমার আলিঙ্গনে।
নিরুত্তর, নির্দ্বিধায়।
“আমায় ছেড়ে যেওনা, মারিনা।”
ঠিক কালকের মতই তার নীলচে চোখদুটো চেয়ে থাকে দূরে
সৌভাগ্যের কোন লক্ষন নেই, নেই দুঃখের...


                                  গোধূলি


অস্তমিত সূর্যের সবুজ আভা
আবার বাসা বাঁধে আমার একাকী হৃদয়ে, চিহ্ন রেখে যায় স্বপ্নের।
ইন্দ্রজালের মত বিছিন্ন হয় চিন্তাশক্তি।
অজস্র বুনো জন্তুর পিঠে চড়ে
স্নান করি সূর্যালোকে।
মাঝরাতের সোনালি চন্দ্রালোক
সেই সব দৃশ্য লেগে আছে আমার চোখে,
কি অপূর্ব!
যেন হাজার অচেনা লোকের ভিড়ে
আমি হাঁটছি, ধীরে ধীরে।
তাদের গলার স্বর,
কিছু লাল, কিছু কালো।
কাঁটার মুখে বিষ।
আস্তে আস্তে আমায় ঘিরে ধরছে,
এই বুঝি সব শেষ।