### বিনোদনের অন্যতম স্পট হিসেবে পরিচিত জাতীয় সংসদ ভবনের অদূরেই অবস্থিত চন্দ্রিমা উদ্যান। কয়েকটি কারণে এ উদ্যানটি অন্যতম। তার মধ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের পবিত্র মাজার এ চন্দ্রিমা উদ্যানের প্রান কেন্দ্রেই অবস্থিত। এছাড়াও এর পাশে রয়েছে ক্রিসেন্ট লেক।
যাহোক, ইট-পাথরের এই শহরে সারা দিনের ব্যাস্ততার মাঝে একটু প্রকৃতির ছায়ায় বিশ্রাম নিতে অনেকেই আসেন এই চন্দ্রিমা উদ্যানে। সকাল ও বিকেল জুড়ে সকল বয়সী ছেলে-মেয়েরা এখানে বিভিন্ন খেলাধুলা ও আড্ডা দিয়ে সময় কাটায়, বিশেষ করে স্থানীয় বাসিন্দারা এখানে এসে সকালে এবং বিকেলে হাটাচলা তথা শরীরচর্চা করে থাকেন। কিন্তু বর্তমানে এখানে স্বাভাভিকভাবে কেউ খেলাধুলা ও হাটাচলা  করতে পারছে না; এমনকি পরিবার-পরিজন নিয়ে এসব স্থানে গিয়ে অনেককে পড়তে হয় বিপাকে। তার কারণ এখানে দিনদুপুরে চলে উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ। রাত যত গড়ায়, এ ধরনের কার্যকলাপ বাড়তে থাকে। সেই সাথে বাড়ে যৌনকর্মীদের আনাগোনাও। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথেই জমতে শুরু করে যৌন ব্যবসায়ীদের হাট। এখানে ভাড়ায় প্রেম চলে। ঘণ্টা চুক্তিতে চলে তাদের প্রেম নামের যৌন ব্যবসা। বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক স্থাপনের জন্য নির্ধারিত থাকে বিভিন্ন রেট। ৫০ টাকার বিনিময়ে শুধু গল্প করা যাবে, আর ১০০ টাকা দিলে হাত ধরতে দেয়া হবে। এর পর যদি আরো এগুতে চান তাহলে রেট আরও বেশী। টাকার পরিমাণ যতই বাড়বে ততই বাড়বে সম্পর্কের গভিরতাও। এমনকি টাকা দিয়ে বাসায় পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সারা রাত জুড়ে এমন প্রেমিকারা অপেক্ষায় থাকে প্রেমিকের জন্য। মিলে গেলেই কোন গাছের ফাঁকে, কিংবা আড়ালে প্রেমিক-জুটির চলে আড্ডা। উদ্যানের সবুজ ঘাসের গালিচা তখন তাদের বিছানায় পরিনত হয়। তাদের দেখাদেখি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও মেতে ওঠে রঙ্গলীলায়। ভাড়াটে প্রেমিকারা কাছে এসে নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করে। পরক্ষণেই বলে ওঠে, “মামা, বসবেন নাকি?” টার্গেট করা যুবকের সম্মতি পেলে কম দামেই তারা বসে পড়ে। এরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শিফট হিসেবে সময় দেয় উদ্যানে। যারা সকালে বা দিনে থাকে তারা রাতে আসে না। এদেরকে ভদ্র সমাজ পতিতা হিসেবেই চিনে আবার কেউ কেউ তাদের রাত জাগা পাখি হিসেবেও ডেকে থাকে।
এতক্ষণ বললাম চন্দ্রিমা উদ্যানের পরিবেশের যে বাস্তব চিত্রটা তার কথা। কিন্তু আরো একটা কঠিন বাস্তব আছে, সেটা হচ্ছে পতিতাদের এই পথে পা বাড়ানোর গল্প। এই নির্মম গল্পগুলো না শুনলেতো অপূর্ণতা থেকে যাবে বৈকি। একটা কথা বুকে হাত দিয়ে বলেনতো, তারা পতিতা হোক আর রাত জাগা পাখিই হোক না কেন, কেউ কি কখনো তাদের মনের ভিতরের না বলা কষ্টগুলো জানার চেষ্টা করি?। জীবিকা অর্জনের তাগিদে তাদের যে বুক ফাটা হাহাকার, হৃদয়ের করুণ আর্তনাদগুলো শুকনো হাসির আড়ালে সেগুলো চাপা দিয়ে রাখে। কিন্তু এদের প্রত্যেকের চোখ বলে যে, ওদের আমরা যতটা খারাপ ভাবছি ওরা হয়ত ততটা খারাপ না। হয়ত তারাও এই পথে মানসিক শান্তি পাচ্ছে না। কেউ ইচ্ছে করে আসেনি এই পথে। তবুও করছে, করতে বাধ্য হচ্ছে। হয়ত তাদের বুকের ভিতরে অফুরন্ত চাপা কষ্ট; যেগুলো কাউকেই বলতে পারেনা। দেখাতেও পারেনা তাদের হৃদয়ের রক্তঃক্ষরণ। একজন পতিতার কথা কে শোনবে বলেন?।তাদের নিয়ে ভাবার সময় কোথায় আমাদের?।
শিউলি নামের ২২-২৩ বছরের একটা মেয়ে চন্দ্রিমা উদ্যানের অন্যতম একজন রাত জাগা পাখি। যাকে আমরা পতিতা বলে থাকি। যে সকল ভদ্রলোকগণ এ পথের পথিক তারা হয়ত সকলেই চিনবেন এই শিউলিকে। এ পেশার জন্য শিউলিকে কম ধিক্কার সহ্য করতে হয় না। কিন্তু শিউলি তো কোন অন্যায় কিছু করে না। বেঁচে থাকার জন্যই আর দু-চারটা ব্যবসায়ীদের মতো সেও দেহ ব্যবসা করছে, ভদ্র ঘরের নারীদের মতো দৈহিক তাড়না কিংবা ভোগ বিলাসিতার জন্য নয়। সে যা করে স্রেফ বেঁচে থাকার জন্যই করে; এক্ষেত্রে দেহ তার ব্যবসার মূলধন। সমাজের সভ্য মানুষগুলো তো তার কাছে আসে দেহের গন্ধের লোভে, মাংসাশী প্রাণির মতো খাবলে-খুবলে খায় তাকে, সুখের নেশায় মাতাল হয়ে আচড় কেটে দেয় তার জর্জরিত শরীরে। একেকটা আচড় তার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। পতিতা শব্দটা যদি এতই ঘৃণার হবে তবে আসল পতিতা তো ওরা; যারা ঘণ্টায় ঘণ্টায় মুখোশ পাল্টায়। দিনের আলোয় যারা ভালো মানুষের মুখোশ পরে সভ্য সমাজের বাসিন্দা হতে চায়, রাতে তাদের নগ্ন চেহারা দেখে শিউলির খুব কষ্ট হয়। শিউলি তো এই সমাজেরই একজন; প্রতিটা মানুষের মতো করে সেও বেঁচে থাকতে চায় এই সুন্দর পৃথিবীতে। আসল কথা হলো, টিকে থাকাটাই এখানে সব। রাত হলে কতো নামী-দামী সাহেবরা লালা ফেলতে ফেলতে চলে আসে চন্দ্রিমা উদ্যানে শিউলির তা ভাল করেই জানা আছে। শিউলি সব সময় মনে মনে ভাবে যে, ওরাই বড় পতিতা অথচ সকাল হবার সাথে সাথে যেনো এক একজন ধোয়া তুলসী পাতা। অন্ধকারে থাকে বলেই হয়ত শিউলি জানে মানুষ কতটা হিংস্র হতে পারে। অল্প বয়স থেকে শুরু করে ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধও আসে শিউলির কাছে। পাঠকরা শোনে অবাক হলেন? অবাক হলেও এটাই বাস্তব। একটা কথা বলে নেওয়া ভাল যে, শিউলি মুলতঃ কন্ট্যাক্ট এ বাসায় যায়। রেটও মোটামুটি বেশী। তবে যেদিন বাসায় নিয়ে যাওয়ার কেউ না থাকে, সেদিন অল্প রেটেই কারো সাথে বসে পড়ে লেকের পাড়ে না হয় কোন গাছের আড়ালে।  
যাহোক, সাদা সালোয়ার-কামিজ পরতেই বেশী পছন্দ করে শিউলি। হাতে লেডিস ঘড়ি, চোখে সাদা-কালো ফ্রেমের চশমা আর পাকা আপেলের মত রসে ভরা যৌবন নিয়ে সন্ধ্যার পর বেশীর ভাগ সময় ব্রিজের দক্ষিণ পার্শ্বে রাস্তার ওপরেই দাড়িয়ে থাকে শিউলি। যে কোন খদ্দের তাকে দেখার সাথে সাথেই পছন্দ করে ফেলে; তাকে ভোগ করার জন্য মুখ দিয়ে লালা পড়তে থাকে খদ্দেরদের। বিলাসবহুল গাড়ী নিয়ে খদ্দেররা তার সামনে এসে ব্রেক করে, দু-চার মিনিট কি যেন ফিস ফিস করে আলাপ-আলোচনা করে দু’জন; এরপর ওরা গাড়ীতে চড়ে চলে যায় অজানার উদ্দেশ্যে।
গ্রামের মেয়ে শিউলি। শিউলির পরিবার ছিল, সম্মান ছিল; তার সাথে ছিল অনেক লেখাপড়া করে বড় কিছু হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু দারিদ্রতা আর ভাগ্য তার স্বপ্নগুলোকে দুমড়ে মুচরে দিয়েছে। ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে তার কোমল মনের চাওয়া পাওয়াগুলোকে।    
শিউলির বাবা পেশায় একজন দিনমুজুর। ছোটবেলায় শিউলির বাবা শিউলিকে খুব আদর করতো। কারণ শিউলির চেহারাটা ছিল খুবই সুন্দর। তখন শিউলির বয়স সাত কি আট। প্রায়ই ফেল ফেল করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতো শিউলি। দেখতে পেত সমবয়সী ছেলে-মেয়েরা দল বেঁধে স্কুলের দিকে ছুটছে। সেই দলে যেন শিউলি নিজেকে খোঁজে পায়। সারাদিন সাংসারিক কাজকর্মে মাকে সাহায্য করতে করতেই বিকেল গড়িয়ে যায়। শিউলি আবার চেয়ে থাকে পথের দিকে। এখন যে স্কুল ছুটি হবে! ছোট্ট শিউলির মন যেন কিছুতেই মানছেনা। এভাবে করে একদিন স্বপ্না বাবা- মাকে রাজিও করাল। শুরু হয়ে গেল শিউলির স্কুলে যাওয়া আসা। মোটামুটি ভাল ভাবেই এগুচ্ছিল শিউলির স্বপ্নের ভেলা। শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিল শিউলি। এক এক করে দশম শ্রেণীতে উঠলো শিউলি। সামনে মেট্রিক পরীক্ষা। হঠাৎ করেই একদিন শিউলির বাবা মারা গেলেন। শিউলির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। সাথে সাথে তার স্বপ্নগুলোও মুখ থুবড়ে পড়ল। অভাবের সংসার, উপার্জন করার কেউ নাই। বন্দ হয়ে গেল লেখাপড়া। কিছুদন পরে হঠাৎ শিউলিকে তার মা এসে বলল, বাড়ীতে মেহমান আসবে। শিউলি কিছুই বুঝতে পারেনা। মনটা কেমন জানি হয়ে গেল তার। কিসের যেন ভাবনার মধ্যে ডুবে গেল শিউলি। আচমকা শিউলির মা ঘরে এসে তাকে বলে উঠলো “আজ তোকে দেখতে আসছে”। মাথায় যেন বজ্রপাত পড়ল শিউলির। কি করবে না করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা সে। বিছানায় মা তার পাশে বসল। পরম মমতায় মেয়ের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল “ভাল একটা ছেলে পাওয়া গেছে, জেলা শহরে ভাল ব্যবসা আছে, টাকা পয়সার কোন অভাব নাই”, ইত্যাদি ইত্যাদি। ।
যাহোক, শিউলির শত আপত্তি সত্ত্বেও সপ্তাহ খানেক পরে এক শুভদিনে শিউলির বিয়ে হয়ে গেল কথিত ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর সাথে। শ্বশুরবাড়ীতে এসে একি দেখল শিউলি। কোথায় সেই ব্যবসা, কোথায় সেই টাকা পয়সা?। তার স্বামী একটা মোটর গ্যারেজে কাজ করে। মাসে বেতন ৬০০০ টাকা। বাস্তবতাকেই মেনে নিয়ে কিছুদিন সংসার করেছিল শিউলি। কিন্তু বেশীদিন শিউলির কপালে সংসার জুটলোনা। শিউলির স্বামী নেশাগ্রস্ত ছিল। নেশা করে এসে রোজ রাতে শিউলিকে খুব মারধর করতো। এদিকে আরেকটা নাকি বৌ ছিল শিউলির স্বামীর। ঠিক মত ভাত কাপড়ও দেয় না। এদিকে শ্বশুড়-শাশুড়ী যৌতুকের জন্য তার ওপর নানা ধরণের নির্যাতন শুরু করল। এভাবে কতদিন সহ্য করা যায়। কিন্তু নিজের বাড়ীতে যে ফিরে যাবে তারও কোন সুযোগ ছিল না। তাই মুখ বুঝে সমস্ত কিছু সহ্য করে সংসার করতে লাগল। হঠাৎ একদিন শিউলির শ্বশুড়-শাশুড়ী টাকার বিনিময়ে শিউলির ঘরে লোক উঠিয়ে দিল। স্বামী বাড়ীতে এলে তার কাছে বলেও কোন বিচার পেলনা শিউলি। বরং উল্টো আরো কপালে জুটলো মার। কি করবে শিউলি? কিছুই ভেবে পাচ্ছিলনা। নানা হতাসার মধ্যে দিন কাটছিল তার। হঠাৎ একদিন শিউলি সিদ্ধান্ত নেয় স্বামীর ঘর আর করবে না। সে ঢাকা শহরে গিয়ে প্রয়োজনে গার্মেন্টস এ গতর খাটিয়ে খাবে। একটা কাজের আশায় অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে শিউলি। অনেক কষ্টের পর ঢাকা শহরে একটা গার্মেন্টস এ কাজ পায় সে। কিন্তু ঐখানে কি আর মাংসাশী প্রাণির অভাব?। শিউলির শরীরের প্রতি লোভ হল অনেকের। নানা ধরণের যৌন নীপিড়ণ সহ্য না করতে পেরে এক পর্যায়ে চাকরীটা ছেড়ে দিল শিউলি। কিন্তু খাবে কি, জীবনতো চলতে হবে?। এরপর পরিস্থিতিই শিউলিকে লালবাতির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা পেশা গ্রহণ করতে বাধ্য করেছে। বছর তিনেক হয়ে গেল রাতের আঁধার নামার সাথে সাথে চন্দ্রিমা উদ্যানের লেকের পাড়ে লালবাতির নিচে শিউলি তার উচু বুকটা ভাসিয়ে দিয়ে রাত জাগা পাখিদের মত অপেক্ষায় থাকে নতুন কোন সঙ্গীর প্রত্যাশায়। হয়ত কোনদিন সঙ্গি জুটে আবার কোনদিন জুটে না। এভাবেই চলে যায় শিউলিদের মত রাত জাগা পাখিদের অভিশপ্ত জীবন। ###


এম. গোলাম মাহমুদ শিশির
সরকারী তিতুমির কলেজ, ঢাকা
মোবা-০১৫৫৪৮৬০৩৮৫