পদ্মা! তোর নরম মাটিতে চলতে চলতে,
কোমল পলি-বালির স্পর্শ পেতে পেতে ;
উঁচু নীচু ঢেউয়ের খেলা দেখতে দেখতে ,
উড়ো বাতাসের মোলায়েম ভেজা পরশে,
কখন যে মনটা ভিজিয়ে গেছিলি,.. বুঝতেই পারিনি ।
তোর ছায়া ও জলের লালনায় লালিত চঞ্চলা_
কোমল মনের মেয়েটিও ছিল রে তোর মতই সহজাত ও সুচারু ।
তার তীক্ষ্ণ,  চোখের ভ্রুযুগল ও ছিল তোর_
জলের মতোই ঢেউ খেলানো ।
ওর গলার ভাঁজ অবিকল তোর পারে পড়ে থাকা,
পলিমাটির ভাঁজের মতো মনে হতো ।
ভোরের প্রথম প্রহরে ;
যখন সবাই ঘুমের ঘোরে অচেতন _
ওর স্বর সাধনা ,রাগ ভৈরবীর আরাধনা _
তোর জল তরঙ্গের রেওয়াজ বলেই মনে হতো ।
তোর বেদীতে আমি যে ফুলের ডালি  
অর্পণ  করেছিলাম,
তার বিনিময়ে সৌরভ পুঞ্জের বায়ুমালা দিয়ে
আমাকেই সুরভিত করবি ,
আমার হৃদয়ের শূন্য স্থানে চুপিসারে;
গোপনে গোপনে প্রেমের  অভিসারে ,
আমার হৃদয়ে থালাভরে ফাগ নিয়ে মেখে দিবি,
আমি স্বপ্নের ঘোরেও বুঝতে পারিনি পদ্মা ।
আমি যে বাগিচায় ফুলের বীজ পুঁতে ছিলাম_
তুই মালিনী হয়ে জল দিবি, গাছের গোড়ায়
কর্ষণ করে আরো উর্বর করে তুলবি ;
গাছে গাছে নানা রঙের ফুল ফুটাবি ,
তা আমি ঘুণাক্ষরেও টের পারিনি ।
এমনকি তোর একমাত্র অস্তিত্ব ,
তোর পরিচয় পত্রের নামটাও ওকে_
বিলিয়ে দিবি, একটুও বুঝতে পারিনি ।
ঐ মেয়েটার নাম ও ছিল পদ্মা ,
যেন পদ্মা নদীর অবিকল ছায়া ।
বোঝা গেল  ভালোবাসার আর এক নাম ত্যাগ ,
কাছে পাওয়ার থেকে ভালোবাসার ছায়া থাক;
হৃদয়ের কাছে হৃদয়ের এ এক দরদী অনুরাগ ।
তুই যে আমার অশান্ত মনটাকে পদ্মার কাছে সঁপে দিয়ে_
তোর নদীময় হাতটি আমার প্রাণে বুলাতে চাস,
আমি বুঝতেই পারিনি ।
আমি যে বড্ড বোকা ছিলাম রে পদ্মা ।
তোর ভাটার জল আমাকে যে এমন শান্ত ;
করে দেবে একদিন , আমি বুঝতে পারিনি ।


এরপর এল ভয়াবহ শূন্যতা.......
তোর জলে একদিন দেখি অজস্র খরস্রোতা ঢেউ ।
আমিও ছিলাম মাঝ দরিয়ায়, ছিল না সাথী কেউ ।
বঙ্গ ভঙ্গ হবে শুনে রাগে ও দুঃখে ,
তোর ঢেউ সেদিন খুব  উত্তাল হয়ে উঠেছিল ।
একদিকে হাহাকার,জৌলুস, মার -কাট ,লুঠপাট _
অন্যদিকে কেহ ভাঙে জানালা ,কেহ ভাঙে কপাট।
ভয়ে প্রাণের দায়ে ছোটাছুটি করি,পালায়।
এর পর সব শুরুর হয় যেমনি একদিন শেষ ;
যবনিকা পরে আমার ভালোবাসায়  !
দেশভাগ হয়ে নাম হল বাংলাদেশ ।
আমার সব কিছু ধুয়ে মুছে হয় শেষ ,
আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে বেঁচে আছি এপারে ;
আমার দুই পদ্মা রয়ে গেল কাঁটাতারের ওপারে।


চার দশক পর কল্লোলের কিছুই মনে নেই ।
সায়াহ্নে অলি গলি পথ সব যেমন অন্ধকারে
চোখ বুজে থাকে_
তেমনি কল্লোলের কিছু মনে পড়ে না ।
মস্তিষ্কের সব ধমনী যেন কবে ছিঁড়ে গেছে ,
ওর জানা নেই ।
তবু দুটো ধমনীতে এখনও রক্ত চলাচল করে ।
একটি দিয়ে নদী পদ্মার জল বয়ে যায়;
অন্য ধমনী দিয়ে নিজের পদ্মা বিচরণ করে কোমল পায় ।
খাটে শুয়ে আছে কল্লোল , রুগ্ন শীর্ণ এক কায়া;
দেহের মতো স্মৃতিও মর্মর বেদানাদায়ক ও মায়া ।
শ্বাস-প্রশ্বাস টা মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায় ।
একমাত্র মেয়ে চিৎকার করে ওঠে ,
বাবা!  বাবা!  তোমার কি হলো ?
বাবা মিনমিনে কি বলে, মেয়ে কিছুই শুনতে পায়না ।
শুধু মাত্র দুটো শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেল ।
পদ্মা ! আমার পদ্মা ।


বাবুল আচার্যী   09/09/2019