ল্যাম্পপোস্ট একা একা ভিজে ঝুম বৃষ্টিতে,
সাদা আলো উজ্জ্বল পাখির ডিমের মতো,
কাঁপছেই একটানা দুরন্ত বাতাসে!
রাস্তাটা নির্জন আক্রান্ত নগরীর মতো ভীত,
তার দ্রুত হৃদস্পন্দন টের পাবে সবাই এখন!
বাড়ী ফিরে গেছে ভিড় বিপদের আভাসে,
বৃদ্ধ শহরের পুরোদিন ভরা ছিলো বুলেটিন-
আসন্ন দুর্যোগ নাকি হবে নজিরবিহীন!
কেউ নাই বাহিরে! খুব একা ল্যাম্পপোস্ট
কাঁদছে বৃষ্টিতে!  


পাদদেশে পড়ে আছে একটি গোলাপ!
শহরের সব ক্লেদ নিয়ে শুয়ে আছে আধমরা,  
পাপড়িতে জমানো কাঁদা খুব বেশি গাড়,
ছিঁড়ে হয়েছে ক্ষত শরীরের রঙে উজ্জ্বল লাল!
ব্যর্থ বৃষ্টির তোড় ধুতে লোহিত বাহার,
তবুও জ্বলছে সে এই আধা আলো অন্ধকারে,
খনির গভীরে জ্বলা রূবির ছটায়!
ল্যম্পপোস্ট, চোখ তার অন্ধ সাদায়,
চালশের চোখ দিয়ে অস্পষ্ট দেখে সেই লাল,
ভালোবেসে ফেলল তরূণের মতো উচ্ছ্বাসে,
প্রথম দেখায়!
যন্ত্রের অভিশাপে আজ সে সিমেন্টের প্রহরী,
জড়! জীবিত আলো হাতে মৃত দ্বারপাল!
খুবই অসম্ভব সামান্য ছোঁয়ার আশা তাকে,
তাই অব্যক্ত ভাষায় সে মহা ঝড়কেই ডাকে!
সত্য হয়ে বুলেটিন, আসুক সে দুর্বিনীত!
ভেংগে তার জড়ের শরীর যদি হয় অবনত,
হয়তোবা একবার অন্ধকারে ছোঁয়া যাবে,
সাধের গোলাপ! শুধু একবার!


একজন যুবক দুরন্ত গতিশীল একটি বাইকে,
পৌছালো ল্যাম্পপোস্টে ঝড়ের আগেই!
চুল তার এলোমেলো বাতাসের মতোই উদাস,
এখানে প্রেমিকা তার নিয়মিত আসে!
আজ প্রেম টেম পালিয়েছে এ ঝড়ের শহরে,
তার না আসাটাও খুব স্বাভাবিক!
তবুও প্রেমের মানে যুক্তির লঙ্ঘন,
এই ভেবে বৃষ্টিতে সিগারেট ধরালো সে ভুলে!
একরাশ বিতৃষ্ণার মতো কিছু ব্যর্থ প্রচেষ্টায়,
হেরে গিয়ে বলে ফিসফিস করে-
“ ভালো আছো অরুণা?”
অরুণা নিরুত্তর! চোখে পড়ে কাদায় গোলাপ!
যৌবনের বিস্ময় উল্লসিত হয় ভেবে,
প্রেমিকা কি ফেলে গেছে গোলাপটা তবে!
নাহ, এমন নোংরা ফুল অরূণার দেয়া নয়,
সেতো শুভ্র খুবই মেঘেদের মতো!
দৃষ্টি সরিয়ে রাইডার বাইকারদের মতো কৌশলে,
পালায় যুবক ছেড়ে অকুস্থল!


মধ্যবয়সী নারী জাপানি কিশোরীর মতো হেঁটে,
দুলিয়ে রঙিন ছাতা বাতাসের তালে,
ফিরছিলো বাড়ি খুব তাড়াতাড়ি।
ভিজেই গিয়েছে বোকা শালিকের মতো!
বাতাসটা উড়াচ্ছে তার অবাধ্য আঁচল,
কতো কিছু মনে আসে, পুরানো হিন্দী গান,
ফিল্মের সুচিত্রা! মন খুলে গান গাওয়া অন্য জীবন!
বহুদিন আগের নাম ফারূক হাসান।
এখানেই আসতো সে!
লুকিয়ে কতো কথা হতো! ল্যম্পপোস্টের আশেপাশে,
কোথায় সে! কতোদিন হলো দেখা নেই আর!
বাতাসটা খুব বেশি উতলা করছে তাকে বড় অসময়ে,
খুব তাড়াতাড়ি তার পালানো দরকার।
রোমান্টিসিজমের চাষ নিষিদ্ধ এখন!
তারও চোখ পড়ে গেলো অভাগা গোলাপে,
তুলে নিয়ে ঘ্রাণ নিলো খুব আদরে,
তবে কি অর্ঘ্য তার হারানো প্রেমের দিয়ে গেলো কেউ!
আশেপাশে সন্তর্পণে দেখে,
রঙিন ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে দিতে দিতে থেমে গেলো,
ছুড়ে ফেলে দিয়ে হুলিয়ার মতো হাঁটা দিলো জোরে,
জোর বৃষ্টিতে তার অপসৃয়মাণ ছায়া বলে গেলো-
“যা কিছু হারিয়ে গেছে, হারিয়েই যাক!
চাইনা ফেরত আমি বিরহের কাল!”  


চুল তার খুব সাদা, মাথার ব্যাগি ক্যাপ ভিজে আজ ঢোল,
চশমাটা ভিজে গিয়ে সব কিছু ধোঁয়াটে!
সত্তরের ঘরে বাস করা বয়সের মতো,
পৃথিবীটাও বুড়ো হলো নাকি আজ?
খুক খুক করে কেশে খানিকটা হেসে বলে বৃদ্ধলোক-
শোন হে দুনিয়া! এতো তাড়াতাড়ি বুড়ো তুমি হয়োনা!
গোলাপটা দেখে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ আপন সম্বিতে।
মনে পড়ে ইন্দুর কথা, মরে গেছে বছর চারেক!
খুব খুশি হতো পেলে দু একটা গোলাপ ঝগড়ার শেষে,
কথা রাখেনি সে! মরে গেছে অনেক আগেই!
কথা ছিলো সবখানে একসাথে যাবে! তাকে ছাড়া যাবেনা!
তবু চলে গেছে সে নিজের মতোই একা!
বৃদ্ধের চোখ থেকে নেমে আসা জল মিশে যায় বর্ষায়,
গোলাপকে বলে- “ কিহে তুমিও যাচ্ছ মরে?”
তা বেশ! বর্ষায় মরে যাওয়া রৌদ্রে পোড়ার চেয়ে ভালো!
দেখা হলে ইন্দুকে বলে দিও ভাই,
বুড়োটা আসবে খুব শিগগিরই!


পাশের বাড়ির মেয়ে,
দোতালার জানালায় গ্রীল ধরে বসে থাকে পুরোটা সময়,
সাথি তার  কয়েকটা মানিপ্ল্যান্ট, একটা বিড়াল!
গ্রীলটার ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে আকাশকে খোঁজে,
পায়না যদিও! তবুও খোঁজে বারবার!
আজকে ঝড়ের দিনে, এই ভরা তান্ডবে,
সেও দেখে ল্যম্পপোস্টের আলোয় ভাসা একটি গোলাপ।
বারবার মানুষের সেখানে থেমে যাওয়া!
অবাক চুলদের আলতো সরিয়ে,
ভাবে সে দেখবেই যদি তবে ভালো করেই দেখুক!
একছুটে রাস্তায় ফুলটানা নকশার ওড়নায় দুলিয়ে বাতাস,
ফুলটাকে তুলে নিয়ে সুতো দিয়ে বেঁধে দেয় ল্যম্পপোস্টের গায়!
সাদা আলো আনন্দে দুম করে যায় বেড়ে,
তারপর নিভে যায় ঝড়ের অন্ধকারে!