আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ে ।
সব সময় মনে পড়ে।
আমার মায়ের জীবনটা বড়ো সংগ্রাম করে কেটেছে -
বন্দী জীবন, সংসারের বাঁধনে আটক জীবন,
সংসারের জন্যে জীবন-দেওয়া জীবন।
আঠারো থেকে সত্তর বছর পর্যন্ত বিশ্রামবিহীন জীবন। বাড়ীর পুরুষদের সেবা করার জীবন,
ছেলে-মেয়েদের জন্যে ভোর-থেকে-রাত্রি ক্রমাগত কাজ করার জীবন।
সব্জি কাটা, মসলা বাটা, টিউবওয়েলে জল তুলে কাপড় কাঁচার জীবন।
ঘুপচি, দম-বন্ধ হয়ে যাওয়া, রান্না-ঘরে উবু হয়ে বসে কয়লার উনুনে সারাদিন রান্না করার জীবন।


এক আঠারো বছরের মেয়ের জীবন শুরু হয়েছিল
চা-বাগানের পাহাড়ী বাংলোতে,
বাবার অর্গানের বাজনার সঙ্গে গান গেয়ে,
মিশনারী স্কুলের টিচারের কাছে সেলাই শিখে,
উদয়শঙ্করের নাচ দেখতে গিয়ে,
পাহাড়ী পরিবেশের প্রকৃতির ভুবন-জুড়ানো রূপের আঙিনাতে খেলে বেড়িয়ে।


সব, সব ভেঙে গিয়েছিল এক কঠিন আঘাতে -
একজনের আকস্মিক মৃত্যু পালটে দিল সকলের জীবনকে-
সেই নারী সব মেনে নিয়েছিল,
পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করেছিল,
নরম হাতে শক্ত করে হাল ধরেছিল দেশ-বিভাগের স্রোতে ভেসে যাওয়া পরিবারের।
অন্দরমহল থেকে অংশ নিয়েছিল বিপ্লবে।


বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, যুবক, যুবতী, শিশু - তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা
প্রতিকুল পরিবেশে।
দিনের পর দিন না-খেয়ে থাকা, বা যতটুকু না-খেলে নয় মুখে দেওয়া,
ভোর থেকে রাত বারোটা - কাজ আর কাজ আর কাজ,
কাঁপড় কাচতে কাচতে চুলগুলো ভেজা,
রান্না করতে করতে শীর্ণ দুটি হাতে হলুদের দাগ,
না খেয়ে খেয়ে ক্ষুধার অনুভূতিই চলে যাওয়া।
এ বই পড়ে শেখা সংসারের সেবা নয়,
জীবন দিয়ে শেখা। বাড়ীর নগন্যতম, তুচ্ছতম সদস্যকেও যত্ন করা,
তাদের প্রয়োজনকে বড়ো মনে করা নিজের প্রয়োজনের থেকে।  
আমার মা হলো সেই নারী,
দুরারোগ্য অসুখে-ভোগা, মরনাপন্নের সেবায় ঢেলে-দেওয়া যেটুকু বাকী ছিল নিজের।


আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ে
যখন আমার জ্বর হয়।
মনে পড়ে - ছোটবেলায় জ্বর হলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মায়ের জন্যে অপেক্ষা করতাম - কথন মা আসবে,
অনেক বেলায়, সব কাজ সেরে,
মাথায় ঠান্ডা জল ঢেলে জ্বর কমিয়ে দেবে!
এখনও সেই জন্যে যেন অপেক্ষা করি চট করে মুখে জ্বর-কমানোর পিল ঢুকিয়ে দেওয়ার আগে।


পূজোর তিনটে দিন কি আনন্দ সবার!
নতুন জামা-কাপড় পরে, প্রতিমা দর্শন করে, থিয়েটার-যাত্রা দেখে, কোলাকুলি করে,
কি উৎসব ঘরে ঘরে!
সন্ধ্যেরাতে যখন বাড়ীতে নেই একটি প্রানী,
একা মাতা তার অসুস্থ শিশুকে কোলে নিয়ে রাতভোর বসা,
হাঁপানী রোগের ইনহেলার তখনও দেখা দেয়নি!


এই আমার মা।
এই মাকেই মনে পড়ে প্রতিটি দিন।