সব ভাষারই একটা নিজস্ব গতি ও ছন্দ-প্রকৃতি আছে।সমাজ ও দেশের মানুষের মন-মেজাজ ও যাপিত জীবনের সাথে ভাষার এই ছন্দ-প্রকৃতি বা গতির আছে বিশেষ সম্পর্ক।সাহিত্য যেহেতু সমাজ এবং সামাজিক মানুষের ধ্যান-ধারণা,স্বপ্ন ও কল্পনাকে ঘিরে আবর্তিত হয়,সেহেতু সব সমাজের সাহিত্যের উপর সেই সমাজের ভাষার একটা স্বতন্ত্র প্রভাব থাকে।ভাষার এই প্রকৃতিগুলো সাহিত্য সৃষ্টির স্বতন্ত্র উপাদান হিসেবে কাজ করে।কোন ভাষা একটু বেশি ঘাত-প্রতিঘাতময়,কোন ভাষা একটু শিথিল আবার কোনটা বা মাঝারি তরঙ্গের গীতিপ্রধান।সার্বজনীন অনুভূতির সাধক যে রবীন্দ্রনাথ বাংলায় লিখেছেন,সেই রবীন্দ্রনাথ একই মন-মেজাজ নিয়ে ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সে জন্মে যদি ইংরেজি বা ফরাসিতে লিখতেন,তবে নিশ্চয় তার প্রকাশ কিছুটা অন্যরকম হত।হয়তো এত মিহি আর অন্তর্ঘাতমূলক না হয়ে তা আরও কিছু উচ্ছ্বাস ও জাগরণমূলক হত।ভাষার এই বৈশিষ্ট্যগুলো সাহিত্যের নির্ধারিত টুলস।ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবোধ,মেধা,প্রজ্ঞা ইত্যাদির বিশিষ্টতার কারণে একই ভাষার একেক কবির কবিতায় মাতৃভাষা একেক রূপ নিয়ে প্রকাশিত হয়,তবে সেই নান্দনিকতারও একটা নির্দিষ্ট অঞ্চল রয়েছে,আলাদা মানচিত্র রয়েছে।প্রাজ্ঞ কবিমাত্রই একথা অনুধাবন করেন এবং বৈচিত্র‍্যের এই সীমারেখা মেনেই তার সৃষ্টিশীলতাকে বিচিত্র করে তোলেন।এখানে সীমারেখা মানে কোন সীমাবদ্ধতা নয় বরং শরীরের সার্বিক গঠনের সাথে সংগতি রেখে অন্যান্য অঙ্গের মানানসই বিকাশ।


বাংলা ভাষায় এমনিতেই ঝোঁক বিশিষ্ট শব্দ কম।ইংরেজি বাক্যের মত তার এত ঘাত-প্রতিঘাত নেই-যা শুনামাত্র পাঠকের মনে বিক্ষেপ সৃষ্টি করতে পারে।তাই ছন্দ ও সুরকে আশ্রয় করে প্রাচীন-মধ্য ও রবীন্দ্রযুগ পর্যন্ত কবিগণ পুষিয়ে নিলেন ভাষায় ঘাত-প্রতিঘাতের এই অভাব।প্রাচীন চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন,বৈষ্ণব পদাবলী,কবিগান,বাউলগান সবকিছুতে আধ্যাত্মিকতার সমান্তরালে আছে সুরের এই প্রাধান্য।ছন্দ ও সুর স্মৃতির সহায়ক,একটি ছন্দে বাঁধা সম্পূর্ণ কবিতা যতদিন মস্তিষ্কে স্থায়ী হয়,ভাবসম্পদ ও অলংকারে অপেক্ষাকৃত উচ্চমানের একটি গদ্যকবিতাও স্মৃতিতে ততদিন স্থায়ী হয় না।আধুনিক যুগে প্রিন্টমিডিয়া এবং ছাপাখানার বিস্তারের সাথে সাথে স্মৃতিতে সংরক্ষণের এই বাধ্যবাধকতা না থাকায় এবং কবিতায় ইউরোপিয় নাগরিক হাওয়া এসে ধাক্কা দেয়ায়,কালক্রমে কবিতা হয়ে ওঠলো গদ্যময়।ফলে কবিতার ভাষা হয়ে ওঠলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মসৃণ ও সমতল।ছন্দ ও সুরের এই অভাব ঘুঁচাতে চিত্রকল্প ও উপমার সার্থক প্রয়োগে কবিরা কবিতাকে করে তুলতে চাইলেন রূপ-কল্পনায় দৃষ্টিগ্রাহ্য ও চিত্তাকর্ষক।কবিতায় শুরু হয়ে গেল ঘ্রাণপ্রধান,দৃষ্টিপ্রধান,কাল্পনিক অনুভূতিপ্রধান ইত্যাদি চিত্রকল্পের বিপুল ব্যবহার।কবিতা এক্ষেত্রে মনের বিভিন্ন অংশে দোলা দেয়ার চেয়ে মনকে নানা বাহনের সওয়ারী করে প্রদক্ষিণ করালো ভাবের নানা জগত।কবিতার এই বহির্মুখী যাত্রায় বিচিত্র ভাব-তরঙ্গের পরিবর্তে প্রাধান্য পেল একই ধরনের তরঙ্গের টানা বিস্তার,সুর ও তালের অভাব ঘুঁচাতে শব্দের পরতে পরতে সৃষ্টি হল ঘোর ও রহস্যের।


বাংলার তুলনায় ইংরেজি ভাষাটা অনেক বেশি ঘাত-প্রতিঘাতময়,শ্বাসাঘাতপ্রধান এবং অনেক বেশি উচ্চারণমুখী।তাই ইংরেজি ভাষার বিপ্লবাত্মক একটি কবিতাও বাংলায় অনুবাদ করা হলে,বিশেষ করে অনুবাদক একান্তভাবে শব্দ ও ধ্বনিসচেতন না হয়ে আক্ষরিক অনুবাদ করলে,সেই কবিতাটিও অধিকাংশ সময় অনুচ্চ শোনায়।প্রতিবাদের পরিবর্তে কিছুটা লঘুস্বরে তার অভিযোগের স্বরটিই তখন বেশি স্পষ্ট হয়।বাংলা ভাষার এই অলসতা ও শিথিলতার কারণ কী?স্বল্পজ্ঞানে কিছুটা আলোকপাত করা যাক এ বিষয়ে।বাংলা ক্রিয়াপদ বেশির ভাগই শেষ হয় স্বরধ্বনি দিয়ে।যেমন..যায়,খায়,নেয়,পায়,হারায়,বাড়ায় ইত্যাদি।আবার মুক্তাক্ষর হলে শেষে স্বরধ্বনির থাকে দীর্ঘটান।সেটাকে আবার প্রয়োজন অনুযায়ী যত খুশি টানা যায়,এমনকি শব্দের অন্ত-মধ্য-পূর্ব যেকোন জায়গায়।যেমন করে(করেএএএ/কঅঅরে),হাঁটে,ধরে,মারে ইত্যাদি।ফলে বাংলা বাক্য হয়ে ওঠে অনেকটা লতানো গাছের মত।তাই তাকে ছাদে তুলতে খুঁটি হিসেবে বক্তাকে স্বর উঁচু করে চেঁচাতে হয় বা যুক্তবর্ণের খানা-খন্দের ব্যবহার করতে হয়।'আগুন' শব্দের চেয়ে 'অঙ্গার' শব্দ কত শক্তিশালী তা সহজেই বুঝা যায়,কিন্তু ইংরেজি 'ফায়ার' শব্দে কোন যুক্তবর্ণ না থাকা সত্ত্বেও তাকে কম শক্তিশালী মনে হয় না।কারণ তার শেষ হয় বদ্ধাক্ষর ও কম্পনজাত ধ্বনি 'র' দিয়ে।ইংরেজি শব্দে তীব্র কম্পাঙ্কবিশিষ্ট 'ট' (T) ধ্বনির ব্যবহার খুব বেশি।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে আবার আরেকটি ব্যঞ্জনধ্বনির (s,d বা n) সাথে যুক্ত হয়ে ব্যবহৃত হয়।যেমন...মেজারমেন্ট,জাস্টিস,রেন্ট,স্টান্ড আপ ইত্যাদি।'T'একাও সে কম শক্তিশালী নয়।যেমন-সেটল,কিউট,মিউট ইত্যাদি।Go,Do শব্দে যুক্তবর্ণ না থাকলেও সেখানে স্বরধ্বনিকে মুখবিবরে বাতাসের ধাক্কা খাইয়ে বেশ শক্তিশালী করানো যায়।সেই তুলনায় যাও,করো বাংলা ক্রিয়াপদগুলো কুলিয়ে উঠতে পারে না।'দাঁড়াও' বললে বাঙালী কেঁশে ধীরে-সুস্থে দাঁড়ায়।'স্টান্ড আপ' বললে শব্দের শক্তিতে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে যায়।
বাঙালি অলস জাতি,তাই তার ভাষাতেও এত অলসতা।তরুণ প্রজন্মের কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের মূল কারণও এই,কথাকে মচমচে করে প্রকাশ করার ইচ্ছা,শব্দের উত্থান-পতন ঘটিয়ে আরেকটু মনোযোগ আশা করা।


বাংলা ভাষার এই অলসতাকে সুদে-আসলে কাজে লাগিয়েছেন কবি জীবনানন্দ দাশ।অক্ষরবৃত্তের দীর্ঘলাইনে স্বরধ্বনির ডাল-পালা ছড়িয়ে ড্যাস,সেমিকোলন ইত্যাদির বহুল প্রয়োগে কবিতাকে করে তোলেছেন ক্লান্তিময় ও ঘোরপ্রবণ।সমকালীন সাহিত্যে বিষয়টি এত আলোচিত যে,এ বিষয়ে দৃষ্টান্তের কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।স্বভাবে সুসংবদ্ধ সুধীন্দ্রনাথ এক্ষেত্রে তার কবিতার আঁটসাঁট আঙ্গিকের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছেন অপ্রচলিত তৎসম ও যুক্তবর্ণ দ্বারা গঠিত শব্দজাল--


তবু রবে অন্তশীল স্বপ্রতিষ্ঠ চৈতন্যের তলে


হিতবুদ্ধি হন্তারক ক্ষণিকের এ আত্মবিস্মৃতি;


তোমারই বিমূর্ত প্রশ্ন জীবনের নিশীথ বিরলে


প্রমাণিবে মূল্যহীন আজন্মের সঞ্চিত সুকৃতি


(মহাসত্য,অর্কেস্ট্রা)


স্বভাবে বহির্মুখী ও উচ্চকন্ঠী কবি নজরুল তার কবিতায় বিষয়ের প্রয়োজনেই ব্যবহার করেছেন প্রচুর বদ্ধাক্ষর বিশিষ্ট শব্দ।সেই সাথে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার তো তার কবিতায় আছেই।নজরুলের বদ্ধাক্ষর-প্রিয়তার একটা নজির দেখা যাক--


আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে---


মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে


মোর টগবগিয়ে খুন হাসে


আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে


(আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে)


পঙক্তির শুরুতে 'আজ' এবং 'মোর' শব্দের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।একইভাবে পরবর্তী পঙক্তিগুলোও শুরু হয়েছে বান,মুখ,মন ইত্যাদি বদ্ধাক্ষর বিশিষ্ট শব্দ দিয়ে।'বিদ্রোহী' কবিতায় আবার এই বদ্ধাক্ষরকে তিনি স্থাপন করেছেন পঙক্তি শেষে।ফলে সেখানেও কবিতাকে উচ্চকণ্ঠ করতে তা যুগিয়েছে বিশেষ রসদ।


বাংলা ভাষায় সাধু ও চলিত ক্রিয়াপদ ব্যবহারে কবিতার বিষয় অনুযায়ী কবিরা কিছু সুবিধা-অসুবিধার সম্মুখীন হয়ে থাকেন।স্বভাবতই চলিতের চেয়ে সাধু ক্রিয়াপদের গঠন একটু জোরালো  এবং বাক্যের উপর তার বিস্তার বেশি,চারপাশকে সে অনেকটা নিজের দিকে টেনে নিতে পারে।একটা উদাহরণ দেখা যাক--


আসিতেছে শুভ দিন


দিনে দিনে বহু বাড়িতেছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ


(কুলি মজুর/কাজী নজরুল)


মাত্রা ও অন্ত্যানুপ্রাস ঠিক রেখে যদি এর ক্রিয়াপদ চলিত করা হয়,তাহলে এর ভাব-গাম্ভীর্য কোথায় নেমে যায় দেখুন--


এসে গেছে শুভ দিন


দিনে দিনে বহু বেড়ে গেছে দেনা শুধতে হবে যে ঋণ


এখানে আসিয়াছে,শুধিতে হইবে,বাড়িতেছে শব্দগুলোর চড়া সুর একদম পাওয়া গেল না।শুধু চড়া আওয়াজ কেন,ক্ষেত্রবিশেষে শিথিলতা তৈররিতেও সাধু ক্রিয়াপদের আছে দারুণ ক্ষমতা।পঞ্চপাণ্ডবখ্যাত কবিরা যখন আধুনিকতার ডাক দিলেন তখন তাদেরই একজন বিস্ময়করভাবে কবিতায় চলিত রীতির ফাঁকে ফাঁকে অবলীলায় ব্যবহার করে যাচ্ছেন আসিয়াছি,দেখিব,আসিব, যাইতেছে,ছড়াতেছে,উড়িতেছে,ডাকিতেছে ইত্যাদি ক্রিয়াপদ।


'এই পৃথিবীতে আমি অবসর নিয়ে শুধু আসিয়াছি'


'দেখিব হলুদ ঘাস ঝরে যায়'


'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়'


জীবনানন্দের কবিতা থেকে এভাবে আরও অজস্র উদাহরণ দেয়া যাবে।প্রকৃত কবিরা আসলে কিছুই বর্জন করেন না একেবারে,প্রয়োজনে  প্রচলিত-অপ্রচলিত,আঞ্চলিক-প্রাতিষ্ঠানিক যেকোন শব্দকেই তারা ব্যবহার করেন কবিতার বিষয় ও ভাবের প্রয়োজনে।


ত্রিশের কবিরা সুরধর্মের বিরোধী হলেও,মূলত ছন্দ-বিরোধী নন।তারা মূলত কবিতায় ভাব,চিত্রকল্প,শব্দ এবং শব্দ-সমবায়ে নতুনত্ব এনেছেন,কিন্তু ছন্দের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাননি সেভাবে।ছন্দের একটা সুবিধা আছে।লঘু বিষয়কেও ছন্দের তালে চালিয়ে তাকে অনেকদূর নিয়ে যাওয়া যায়,পঙক্তির পর পঙক্তি সাজিয়ে যাওয়া যায়,পাঠে বিরক্তি লাগে না।ছন্দহীন কবিতার ভাব হতে হয় সেই তুলনায় অনেক উচ্চ এবং এখানে সুর ও তালের প্রাধান্য প্রচ্ছন্ন বলে বোধকে ফাঁকি দিয়ে বক্তব্য শেষ হওয়ার পর তাকে আর অহেতুক এগিয়ে নেয়া যায় না।সাম্প্রতিক কবিতার আকার-আয়তন ছোট হয়ে যাওয়ার পেছনে এটাও বড় একটা কারণ।


দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলন,মুক্তিযুদ্ধ,স্বৈরশাসন ইত্যাদির প্রেক্ষিতে কবিতা শ্লোগানধর্মী হয়ে উঠলেও নব্বই এর দশক থেকে কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে মূলত ব্যক্তিক বোধ।ফলে জাগরণ ও আশাভঙ্গের বিশাদময় সার্বজনীন উচ্চারণের চেয়ে এখন বড় হয়ে ওঠেছে কবিদের নিজস্বতা,একান্ত যাপন।এভাবে কবিতার কালগত স্রোত একটি  সমষ্টিগত ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মিশেছে অনেকগুলো সরু অথচ নান্দনিক স্রোতে এবং সেখানে নিজস্ব দ্বীপ রচনা করে কবিরা খেলছেন শব্দ ও চিত্রকল্পের নানা বৌদ্ধিক খেলা।পরিবর্তন এসেছে কবিতার ভাষা ও তার প্রবাহেও।মধ্যযুগের সুর নির্ভরতা,আধুনিকতার শুরুতে কথা ও সুরের যুগপৎ সঙ্গম,মাঝে শ্লোগান ও গণমুখীতার জোয়ার--এসব থেকে বেরিয়ে কবিতার ভাষা এখন অনেকটা গুপ্তচরী,ইঙ্গিতপ্রধান এবং স্বভাবতই মৃদু।পুরো অবয়ব প্রকাশ না করে আলো আর অন্ধকারের মিথস্ক্রিয়ায় সে দেখায় তার খণ্ড খণ্ড নান্দনিক রূপ।প্রকাশের নানা বিচিত্র উপায় থাকলেও গোটানোর চরিত্র যেহেতু এক,মৃদুস্বরের মাঝে বৈচিত্র‍্য থাকলেও তাদের মাঝে পার্থক্য বোঝা যেহেতু কঠিন,তাই অনুভূতিতে ব্যক্তিক হয়েও এযুগের কবিতার অভিঘাত খুব একট স্বতন্ত্র নয়।বিষয় নির্ভরতা কমে যাওয়া,সমাজের ঘাত-প্রতিঘাত কবিতায় উল্লেখযোগ্য হারে ফুটে না ওঠা--ইত্যাদির পেছনে বড় কারণ হল বর্তমান স্থবির সময় ও জাতীয় জীবনে সহজবোধ্য কোন গভীর সঙ্কট না থাকা অথবা সঙ্কট থাকলেও তার সাথে
কবিদের গভীর কোন যোগাযোগ অনুভব না করা।


কবিতা চিরকালই চিত্রকলা ও সঙ্গীত দ্বারা অনুপ্রাণিত।বিভিন্ন সময় চিত্রকলায় বিমূর্ততার আবির্ভাব কবিতাকেও বিমূর্ত হতে অনুপ্রাণিত করেছে।তবে কবিদের একথা মাথায় রাখা উচিত যে,কবিতা ভাষার শিল্প,শব্দই তার প্রধান অবলম্বন।আর শব্দ ও ভাষার মূল কাজই হল মানুষের বোধের সাথে সমন্বয় রক্ষা করা।শব্দের এত বৈচিত্র‍্য কোথায় যে তা রঙের নানা কোলাজ ও সারেগামার সাত সুরের নানা মুদ্রা ও রাগের সাথে প্রকাশে পেরে ওঠে?তাই চিত্রকলা ও সঙ্গীতের বিমূর্ততাকে দর্শক-শ্রোতা স্বাগত জানালেও কবিতার নিরর্থক বিমূর্ততা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।কতগুলো বিচ্ছিন্ন রঙ তুলির ক্যানভাসে একই সমতলে রেখে যেভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্য করা সম্ভব,কবিতার ভাষাকে এলোমেলো করে,শব্দের সাথে বোধের ধারাবাহিক যোগাযোগ ছিন্ন করে,তাকে একই সমতলে রেখে পাঠকের অনুভূতিতে পূর্ণাঙ্গ বিক্ষেপ সৃষ্টি সম্ভব নয়।তাছাড়া চিত্রশিল্পের আছে দর্শনের নানা অ্যাঙ্গেল,একেক কোণ থেকে তার একের রূপ ধরা পড়ে,ভাষা ও শব্দের ত্রিকোণমিতি সেই তুলনায় খুবই অনুজ্জ্বল।কবিতার ভাষাকে শিল্পীত হতে হয়,তবে শিল্পীত হতে গিয়ে জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তাতে সাহিত্যরস বলতে আর কিছুই থাকে না,থাকে শব্দের কৃত্রিম কিছু জ্যামিতিক স্ট্রাকচার।তখন কবিতার ভাষার মুখে পড়ে অলঙ্কারের প্রকাণ্ড তালা।


একই সাথে কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ তার ভাষাভঙ্গি বা প্যারাল্যাংগুয়েজ (paralanguage)।কবিতার অন্তর্গত বিষয় ও ভাবই ঠিক করে দেয় তার ভাষাভঙ্গি।একই শব্দ বা শব্দ সমবায় বিভিন্ন কবিতায় বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়,মনে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।এক্ষেত্রে পাঠক আগে থেকেই অবগত হয়ে শব্দের উচ্চারণে বা অনুভবে এই পার্থক্য করে না,কবিতার মেজাজের সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্বাভাবিকভাবেই তা হয়ে যায়।প্যারাল্যাংগুয়েজ উচ্চারণের সাথে বেশি সম্পৃক্ত হলেও কবিতায়ও এর কিছু প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।কবির ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে পূর্ব-অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেও পাঠক কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের বিপরীতে চিত্রকল্প অনুভব করে থাকেন।তাই কবিতার নিজস্ব ধারা বা মেজাজ তৈরিতে সব প্রতিশ্রুতিশীল কবিরই বিশেষ একটা ঝোঁক থাকে।


ভাষা ও চিত্রকল্পে চমক সৃষ্টির মাধ্যমে কবিতার কাঙ্ক্ষিত বাঁক বদলই এখন কববিদের বড় লক্ষ্য।তবে এখন পর্যন্ত সেই কাঙ্ক্ষিত বাঁকবদল উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা যাচ্ছে না।উত্তরাধুনিক কবিরা শব্দ সমবায়ের চিরায়ত শৃঙ্খলা ভেঙে দিয়েছেন,ভেঙে দিয়েছেন কার্যকারণের প্রাকৃতিক শৃঙ্খলাও।ফলে কবিতায় স্থান পাচ্ছে পরাবাস্তবতার নামে নানা উদ্ভট ও বিচ্ছিন্ন চিত্রকল্প।এভাবে কবিতা ক্রমেই পাঠকের সীমানা থেকে বেরিয়ে একান্তই 'কবিতার জন্যই কবিতা' হয়ে ওঠছে,চেনা শব্দের অচেনা অভিব্যক্তি হয়ে ওঠছে।ফলে পাঠক তার শিল্পবোধের নিজস্ব ভাষা ও জীবনাভিজ্ঞতাকে বেশিরভাগ সময়েই খু্ঁজে পাচ্ছে না এসব কবিতায়।তবে বহুমাত্রিকতা ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি প্রাধান্য পাওয়ায় কিছু কিছু  ঋদ্ধ পাঠক আগ্রহী হয়ে ওঠছেন এই ধারার কবিতার প্রতি।পাশাপাশি চিরায়ত ধারার সমাজ-বাস্তবতা নির্ভর একরৈখিক কবিতাও লিখছেন কেউ কেউ।কবিতায় পরিবর্তনের নানা ধাপ এখনও চলমান এবং চূড়ান্তভাবে এখনও তা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি।তাই এযুগের কবিতা ও তার উপযোগিতা নিয়ে শেষকথা বলার সময় এখনও আসেনি।বর্তমানে সামাজিক পরিবর্তন খুব দ্রুত হচ্ছে,অতীতের মূল্যবোধ ও বিশ্বাসে আমূল পরিবর্তন আসছে।ভবিষ্যতের সমাজ-বাস্তবতা ও পরিপার্শ্বের নানা উপাদানের সাথে ব্যক্তির সম্পর্কই নির্ধারণ করবে আগামী দিনের কবিতার ভাষা ও তার প্রকাশভঙ্গী।কবিতায় ব্যক্তির ভাষা প্রধান হবে নাকি সামাজিক ভাষা গুরুত্ব পাবে,কবিতার ভাষা তার শরীর থেকে কোন কোন অলংকার খুলে ফেলে আবার কোন কোন অলংকার ধারণ করবে এবং সামগ্রিকভাবে তার মূল্যায়ন কী হবে,তা নির্ধারণ করবে শিল্প-সাহিত্যের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও নির্মম সমালোচক সময়।


(কামরুল ইসলাম ফারুকি)


/প্রকাশ--রূপসী বাংলা,লিটলম্যাগ,যশোর থেকে প্রকাশিত/