প্রবাদ আছে 'মানুষ যা খায় মানুষ তাই"।কবিদের সাথে এর তুলনা চলে।কবিরা সমাজের বাইরের কেউ নন।তারা তাদের চারপাশের জীবন থেকেই চিন্তার উপকরণ লাভ করেন।এসব উপকরণ নিয়ে কবিরা যা চিন্তা করেন তাই তারা কবিতার ভাষায় মনের রঙ মিশিয়ে প্রকাশ করেন।কোন কবিই সামাজিক ও সামাজিক মানুষের দায়ভারকে এড়িয়ে যেতে পারেন না।কারন সমাজ তথা বিশ্বমানবেরই তিনি এক অংশ।যা তিনি লিখছেন তা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন বলেই লিখছেন।তাই কবিতা ও সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মাঝে আমরা রচয়িতার মনেরই পরিচয় পাই।সেই সাথে বুঝতে পারি কার চিন্তা কত মহৎ।কার মন কত উদার।উদার মন ছাড়া কেউ কবি হতে পারেনা,এটি একটি ভুল কথা।কবিতা লিখতে গেলে সবার আগে লাগে কল্পনা।তবে আবেগ ছাড়া তা প্রাণবন্ত হয় না।আবেগ মনের উদারতার সাথে সম্পর্কিত।যার মন যত বড় তার আবেগের নদীতে জলও ততো বেশি।তিনি ততো বেশি লিখতে পারেন মানবিক কবিতা।একান্ত ব্যক্তিগত ব্যথার সীমা ছাড়িয়ে তিনি অনুভব করেন সকলের ব্যথা।তাই তার কবিতা হয়ে উঠে গণমানুষের কবিতা।তিনি বলেন মানব মুক্তির কথা,আত্মবিকাশের কথা।নিজের মাঝে যিনি সকল মানুষকে অনুভব করতে পারেন তিনিইতো মহৎ কবি।সে জন্য কবিকে করতে হয় মহত্ত্বের তুমুল সাধনা।করতে হয় আত্মত্যাগ,ভোগকে দিতে হয় বিসর্জন।


আমাদের সমাজে মোটামুটি সবাই আজ ভোক্তা।ত্যাগী নেই বললেই চলে।সমাজের সুবিধা ভোগ করে,জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা পেয়ে সমাজের সাথে আমাদের(কবিদের) গড়ে উঠেছে এক ধরনের আপোষময় মনোভাব।তাইতো কেউ না খেয়ে থাকলেও,শীতে কষ্ট পেলেও তা খুব কমই আমাদের কাব্যের উপকরণ হয়।বিদ্রোহকে আজ আমরা ভয় পাই,বিসর্জনকে এড়িয়ে চলি।কবি হতে হলে আগে ব্যর্থ হতে হয়।জৈবনিক সফলতা কবিত্বকে ম্লান করে।তাই সফল কবির আজ এত অভাব।সমাজে যে ব্যর্থ মানুষ নেই তা নয়।কিন্তু তাদের মনেও নেই মহত্ত্বের উপকরণ।তাদের লক্ষ্যও আজ কেবল আর্থিক ও বাহ্যিক সফলতা।তা সে যে উপায়েই হোক।আত্মিক সফলতা কারও লক্ষ্য নয়।কবিত্ব যে আত্মিক সাধনারই নাম তা আমরা ভুলে গেছি।ফুটবল নিয়ে নাড়াচাড়া করে যত সহজে খেলোয়ার হওয়া যায়,শুধু শব্দ নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই ততো সহজে কি বড় কবি হওয়া যায়?তাতে হয়তো কবিতার আঙ্গিক সুন্দর হয় কিন্তু তাতে প্রাণ থাকে না।তার শব্দগত শিল্পগুণ থাকলেও অন্তর্গত শিল্পগুণ থাকেনা।তা আর দ্বিতীয় বার আমাদের পড়তে ইচ্ছে করেনা।তার প্রতি কোন কৌতূহল আর আমাদের থাকেনা।নিখুঁত পুতুলের চেয়ে আজও অনিখুঁত মানব সন্তান আমাদের বেশি প্রিয়।পুতুল কতক্ষণ হাতে নিয়ে থাকা যায়?তা যত সুন্দরই হোক।কিন্তু মানব শিশুর প্রতি আমাদের টান কিছুতেই কমে না।বার বার তার দিকে আমাদের ব্যাকুল চোখ যায়।


একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়(সমাজের আশা আকাঙ্খাকে একেবারে আমলে না এনে) নিয়ে যিনি লিখছেন তিনিও কবি।তার ব্যক্তি সত্ত্বায় যে স্পন্দন তার কিছু না কিছু সবারই সত্ত্বায় থাকে।তারপরও তিনি মহৎ কবি নন।তিনি নদী নন বলেই সাগরের সাথে সম্পর্কহীন।তবে তিনিও সুন্দর নন তা নয়।খাল বিল সাগরে না মিশলেও তাতেও থাকে সৌন্দর্যের  উপকরণ।কিন্তু নদীর কল্লোলের সাথে তার তুলনা নেই।কেননা নদীতে আছে সাগরে মেশার বিপুল আকর্ষণ,বিপুল প্রাণ।


শুধু আঙ্গিক নয় আমরা চাই বিচিত্র ভাব ও কল্লোলের কবিতা,প্রাণময় কবিতা,আত্মবিকাশের সহায়ক কবিতা।আমরা চাই মানবিক কবিতা,প্রকৃতির কবিতা।মানবতার গান,প্রকৃতির অলঙ্কার যাদের কবিতার প্রাণকে করবে পূর্ণ,আমাদের মনকে করবে শুদ্ধ,চোখে ঝরাবে জল।কবিতা পড়ে পবিত্র হতে চাই,কাঁদতে চাই।কবিতার সুন্দর অবয়বের সাথে চাই কবিতার সুন্দর মন।কায়ার সাথে চাই মায়ার বাঁধন।