বানভাসি
বিকাশচন্দ্র সরকার


পৃথিবীর মানচিত্রে হাতরেখে,
আমার শৈশবের শিক্ষক একদিন বলেছিলেন
"এটা আমাদের দেশ,
এর নাম ভারতবর্ষ।"
আ-জীবনের ক্লেশ
আমি এখনো মুছে ফেলি,
যার মমতার আঁচলে এক-নিমেষে,
সেই মা'য়ের চোখের জলের ফোঁটায়
আমার কিশোর বেলা শুনেছিল
একাত্তরের ঘাতক কাহিনী।
কি ভাবে নিজের দেশ
এক নিমেষে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল উদ্বাস্তু মিছিলে।


আমার যৌবন জুড়ে ছিল
বিজয়ী বীরের জয় গাথা গৌরবাম্বিত ইতিহাস।
বল্গাহীন অশ্বের গতিতে ছুটে চলেছে নেতাজী,
সত্যের সন্ন্যাসী হয়ে
বাণীময় বক্তৃতারত গান্ধীজী,
বলে চলেছেন অহিংসার তরুণ মহিমা,
কাব্যিক বর্ণের ছটায় এক আকাশ তেজস্বী কন্ঠে কবি বলেছিলেন
"আমি সেইদিন হবো শান্ত।"


না, শান্ত হতে পারিনি আমি কখনো
একটা শান দেওয়া হিংস্র চোরাস্রোত
প্রতি নিয়ত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।
চলে রাষ্ট্রীয় প্রগতির নামে
নতুন নতুন শোষন তন্ত্র।
আসলে, মানুষের রক্ত বড় বেশি লোভী
ক্ষমতার দম্ভ বড় বেশি স্বার্থপর।


আমার লাল পাহাড়ের বুকে
দু-কেজি চাল
আর কোলকাতার নতুন বস্তিতে
যখন দু-বোতল দেশি মদে
গণতান্ত্রিক অধিকার বিকিয়ে যায়।
একবেলা দু-মুঠো লাল ভাত
আর এক রাতের মাদকতায়
সাংবিধানিক অধিকার হারিয়ে যায়।
তখন আমি কি করে বলি
মার্ক্স কিংবা লেলিনের সামনে মুঠোবন্দি হাত তুলে
"ইনকিলাব জিন্দাবাদ।"


পঁচাত্তর তম স্বাধীনতা দিবসের পতাকা
যখন সেজে উঠছে রঙিন তুফানে,
ঠিক তখন "খেলা হবে" নামক স্লোগানে নেমে আসে রক্ত-চক্ষু,
তখন জাতীয় পতাকার পাদদেশে দাঁড়িয়ে
আমি কি করে বলি "বন্দেমাতরম"।
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র
যখন মুখরিত হয়
"জয় শ্রী রাম" কিংবা "আল্লাহ আকবর" ধ্বনিতে
তখন কি করে আমি বিজয়ী উল্লাসে আমি বলি
"সারে জাঁহা সে আচ্ছা"।


আসলে দেশপ্রেমিকের সংখ্যা কমতে কমতে
স্তাবকের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে বিস্তর।
বিবেকী দর্শন আর সমাজতন্ত্রের বানী
এতো এতো জীবন্ত লাশ দেখে
মুখ ঢেকেছে বুক পকেটের অলিন্দে।
আর মানুষ হয়েছে বানভাসি।


আদিবাসী মানুষের স্বপ্ন
ভূখা মিছিলের স্বপ্ন
মেধাবী ছাত্রের স্বপ্ন
চাঁদের পাহাড় আর মঙ্গলযানের স্বপ্ন
রিক্সার প্যাডেলের স্বপ্ন
নৌকার পালের স্বপ্ন
বিজ্ঞানের জয়যাত্রার স্বপ্ন
নির্বাক ছায়াছবির মতো
দিকহীন প্রবাসী হয়ে
ভেসে চলেছে বানভাসি কবিতায়।


তবু একটা বিশ্বাস নিয়ে
জীবন বেঁচে উঠতে চায়,
একদল আশাবাদী পরিস্ফুট আলো
একদল বিকশিত সকালের দিকে তাকিয়ে
দৃঢ়তার ধ্বনিতে স্বদেশকে বলে
এসো ভালোবাসি,
পাথুরে মূর্তিতে প্রতিষ্ঠা করি
এক একটা জীবন।
এক একটা ডিঙা ভাসিয়ে
তারা তুলে আনুক
এক একটা বানভাসি সমাজ।
আর ফুলের পাপড়ির মতো ঠোঁট মেলে
আলিঙ্গন করুক স্বাধীনতা,
আলোকিত সত্ত্বায়,
শোষনহীন স্বাধীনতা।