সকালে ঘুম ভাঙ্গলো অনেকটা দেরী করে,
উঠে দেখলাম পিপলি ঘরে নেই, নেই ইলেক্ট্রিসিটিও।
রাতের পরনের কাপড়গুলি বিছানার একপাশে অগোছালো করে রাখা।
আমি ধরেই নিয়েছিলাম 'আজ' ও 'আগামীর' বিশেষ কোন তফাৎ হবেনা,
কিন্তু কে জানতো, আমার যা কিছু হিসেবের পাতায় সুবিন্যস্ত -
সে সবই বেকার; 'বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে' ক্রমেই বিলীন হয়ে যাবে?


গত রাতের ঝড়-বৃষ্টি এখানে ওখানে দুহাত ভরে
ধ্বংসের নিষ্ঠুর চিহ্ন রেখে গেছে।
বারান্দার ছাদের কিনারায় আমাদের সারি সারি ফুলের টবে,
দূরের বাড়ির উঁচু গাছ গুলির মগডালে-
এবং আমাদের পরিপাটি বেডরুমের সর্বত্র!
উলটে পড়া টব আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানান কিছু ডিঙ্গিয়ে-
রাস্তার দিকের কার্নিশে আসতেই, ভেজা মাটির গন্ধ নাকে এলো।
গন্ধ আর স্মৃতির মধ্যে অদ্ভুত একটা যোগাসূত্র আছে,
যেন একে অপরের সম্পূর্ণতা, অবিচ্ছেদ্য।
মাটির সোঁদা গন্ধ এক মুহূর্তে অনেক স্মৃতি ফিরিয়ে দিলো।
আমাদের সেইসব মুহূর্ত ফিরিয়ে আনলো, যখন আমরা অনেক ছোট ছিলাম।
কুঁড়েঘরের জানালা দিয়ে হাতে হাত রেখে বৃষ্টি দেখতাম,
কল্পনার ডানায় ভেসে আবোলতাবোল শব্দ বুনতাম!
জমা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কাদায় মাখামাখি হয়ে হেসে কুটিকুটি হতাম।


আজ ভদ্র সোসাইটিতে আমাদের ডুপ্লেক্স বাড়ির খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে-
নিজেকে যেন কৃত্রিম কোন ধাতব বস্তু বিশেষ মনে হচ্ছে।
যাওয়ার আগে অভিমান করে লিখে গেছো, "অনেক হয়েছে। এবার থাক।"
আমারও ইদানীং এই কংক্রিটের বাক্সের মধ্যে আর মন টিকছেনা,
এখানে স্বপ্ন নেই, শৈশব নেই, অবারিত সবুজের হাতছানি নেই।
এখানে শুধু উপরে ওঠার লড়াই- ওঠো, আরও উপরে, তার চেয়ে উপরে!


আজ দুবছর হলো পিপলি চলে গেছে।
শহুরে অচেনা জীবনে খনিকের জন্য ঝড় বাদলা এলেই-
গ্রামে ফিরে যেতে চাইতো বারাবার, খুব কাঁদতো সে।
কেঁদেকেটে বারান্দার এক কোনায় চুপটি করে বসে থাকতো।
তারপর উঠে গিয়ে দু'কাপ চা নিয়ে ফিরে আসতো।
আরও কিছু পরে সব ভুলে গিয়ে আবার ঘরকন্নায় মন দিতো!
এভাবেই এক এক করে সতেরোটা বছর কেটে গেলো।
তারপর একদিন, এক ঝড়ের রাতে পিপলি চলে গেলো,
সবাই মিলে আয়োজন করে ওকে রেখে এলাম প্রিয় প্রকৃতির কোলে।
সেখানে কংক্রিটের বেষ্টন নেই, মিথ্যে আশা দেয়ার প্রয়োজন নেই।
আছে অবারিত সবুজের সমারোহ, আছে আদিগন্ত অনন্ত উপভোগের দিন।


©সুব্রত ব্রহ্ম
এপ্রিল ৭, ২০১৭ইং:
ময়মনসিংহ।