কবিতা সাহিত্যের এক অনন্য রূপ যা হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে রূপ দেয় ছন্দ, শব্দ ও চিত্রকল্পের মাধ্যমে। এটি কেবল সাহিত্যিক প্রকাশ নয়; বরং এক ধরনের আত্ম-অন্বেষণ, সময়, সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যকার সম্পর্কেরও এক সংবেদনশীল ব্যাখ্যা।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারা:
ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারা বলতে বোঝায় সেই কাব্যধারা যেখানে কবি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা, চিন্তা, অনুভূতি, স্বপ্ন, হতাশা, আনন্দ ও কষ্টকে কেন্দ্র করে কবিতা রচনা করেন। আধুনিক কবিতায় এই ধারা খুবই গুরুত্ব পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে সমসাময়িক কবিদের লেখায় ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়।
উদাহরণস্বরূপ:
জীবনানন্দের কবিতায় বারবার ফিরে আসে তার নিঃসঙ্গতা, বিষাদ ও স্বপ্নময়তা।
শঙ্খ ঘোষ কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার সাথে সামষ্টিক বাস্তবতা মিলেমিশে যায়।
এই ধারা কাব্যকে করে তোলে আরও মানবিক ও আত্মিক।

কবিতার রূপ ও সত্তা:
কবিতার রূপ বলতে আমরা বোঝি এর বাহ্যিক গঠন—ছন্দ, অনুপ্রাস, স্তবক, শৈলী ইত্যাদি। প্রাচীন কালে কবিতার রূপ ছিল খুবই গঠনতান্ত্রিক—নির্দিষ্ট ছন্দ ও মাত্রার সীমায় বাঁধা। কিন্তু আধুনিক ও উত্তর-আধুনিক কালে কবিতার রূপ হয়ে উঠেছে অনেক বেশি মুক্ত ও বিচিত্র।

রূপের ধরন:
ছন্দবদ্ধ কবিতা (ঋদ্ধ ছন্দ, মাত্রাবৃত্ত, সিলেবিক ইত্যাদি)
মুক্তছন্দ বা অছন্দ কবিতা

গদ্য কবিতা (যেটি ছন্দমুক্ত কিন্তু কবিত্বপূর্ণ ভাষায় লেখা)
কবিতার সত্তা মূলত নির্ধারিত হয় তার অন্তর্নিহিত চিন্তা, আবেগ ও বোধ দ্বারা। এটি তার আত্মা, যা পাঠকের মনে স্পর্শ ফেলে।

কবিতার বৈশিষ্ট্যসমূহ
ক. অনুভূতির গভীরত:- কবিতা প্রতিদিনকার ভাষা নয়, এটি অনুভূতির পরিশুদ্ধ রূপ। এখানে কথা নয়, “অভিব্যক্তি” মুখ্য।

খ. চিত্রকল্পের ব্যবহার:- ভাষার মাধ্যমে দৃশ্যপট রচনা কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। যেমন:
“সাদা ধবধবে একটি শীতের সকাল” — এই বাক্যে এক চিত্র ফুটে ওঠে।

গ. প্রতীক ও রূপক:- অনেক সময় সরাসরি বলা না হয়ে কোনো প্রতীক বা রূপকের মাধ্যমে ভাব প্রকাশ করা হয়। যেমন, "রাত" মানে শুধু সময় নয়, তা হতে পারে "নিরাশা", "ভয়" বা "নিঃসঙ্গতা"র প্রতীক।

ঘ. ছন্দ ও অনুপ্রাস:- শব্দের সুর, ছন্দ ও ধ্বনি কবিতাকে করে তোলে গীতিময় ও শ্রুতিমধুর। যদিও আধুনিক কবিতায় ছন্দের বাধন শিথিল হয়েছে, কিন্তু ছন্দের অভ্যন্তরীণ সংগতি এখনো গুরুত্বপূর্ণ।

ঙ. সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর বক্তব্য:- কবিতা সাধারণত অল্প শব্দে অনেক কিছু বলার শিল্প। এর প্রতিটি শব্দ বহন করে গভীর অর্থ।

কবিতা এমন এক শিল্পমাধ্যম যা বাহ্যিক কাঠামোর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় অন্তর্নিহিত অনুভব ও গভীরতায়। ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধারা কবিতাকে করেছে আরও আন্তরিক, তার রূপ হয়ে উঠেছে বহুবর্ণিল, আর বৈশিষ্ট্যগুলো মিলেই কবিতাকে করেছে চিন্তার ও অনুভবের এক অসাধারণ রূপ।