কবিতা শুধু কল্পনার খেলা নয়—এটি একটি সময়ের চেতনাকে ধারণ করে। প্রতিটি যুগের কবিতাই তার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিতের প্রতিফলন। বাংলা কবিতার ইতিহাসে “সেকাল” বলতে বোঝানো হয় উনিশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে লেখা কবিতা—যেখানে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল মধুসূদন, জীবনানন্দ প্রমুখ কবিরা আধিপত্য বিস্তার করেছেন। অপরদিকে, “একাল” বা বর্তমানকালের কবিতায় আমরা পাই বাস্তববাদ, বিচিত্র কাঠামো এবং আত্মবিশ্লেষণের দৃষ্টিভঙ্গি। এই দুই সময়ের কবিতার গুণগত মানের তুলনায় আমরা দেখতে পাই—সাহিত্যের বহুমাত্রিক পরিবর্তন, ভাষা-ভাব-দর্শনে ভিন্নতা, এবং শৈল্পিক নান্দনিকতায় বৈচিত্র্য।
সেকাল আর একালের কবিতার গুণগত মান বিশ্লেষণে নিম্নোক্ত বিষয় ভিত্তিক পার্থক্যগুলো পরিলক্ষিত হয়।

১. শৈলী ও কাঠামোগত পার্থক্য:

সেকালের কবিতা:
সেকালের কবিতা অধিকাংশই নিয়মতান্ত্রিক রীতিতে লেখা—যেখানে ছন্দ, অন্ত্যমিল, অলংকার ও গদ্য-পদ্যের কাঠামো রক্ষার কঠোরতা ছিল। কবিতাকে শিল্পের চূড়ান্ত প্রকাশ মনে করা হতো। যেমন:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “প্রার্থনা” কবিতায় দেখা যায় সুচারু ছন্দ, গভীর দার্শনিকতা ও অলংকারপূর্ণ রচনা—
"হে নূতন, দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণে।"
এখানে ছন্দ ও ভাবের নিখুঁত সামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা যায়।

এ কালের কবিতা:
এ কালের কবিতা ছন্দমুক্ত ও গদ্য কবিতার দিকে বেশি ঝুঁকেছে। ভাষার গঠন শিথিল হলেও ভাব গভীরতর হয়েছে। কবিতা এখন ভাবনার ঘনত্বে পরিণত একটি মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা।যেমন:
হাসান হাফিজ লিখেছেন—
"আমি আর আমার ছায়া একসঙ্গে হাঁটি না এখন,
একজন আলো খোঁজে, অন্যজন অন্ধকার।"
এখানে ছন্দ নেই, কিন্তু রয়েছে আত্মবিশ্লেষণ ও গভীর সংকেতধর্মী প্রতীক।

২. বিষয়বস্তু ও দার্শনিকতা:

সেকালে:
সেকালের কবিতায় জাতীয়তাবোধ, ঈশ্বরভাবনা, সৌন্দর্যচেতনা এবং মানবিক মূল্যবোধের উপর জোর দেওয়া হতো। কবিতা সমাজের নৈতিক উন্নয়নের বাহন হিসেবেও বিবেচিত ছিল। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন—
"বল বীর—
বল উন্নত মম শির!"
এই কবিতায় বিদ্রোহী মনোভাব, জাতীয় গর্ব, এবং মানবমুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে।

এ কালে:
বর্তমান কবিতায় দেখা যায় ব্যক্তিসত্তার সংকট, অস্তিত্বের দার্শনিক প্রশ্ন এবং বাস্তবতাবাদ। কবিতা এখন আর শুধু “সুন্দর” হবার প্রয়াস নয়, বরং “সত্য” প্রকাশের একমাত্রিক রূপ। যেমন:
আহমদ সুবহান লিখেছেন—
"আমার চারপাশে প্রতিদিন মৃত মানুষ হাঁটে,
তারা বেঁচে আছে অফিসের টাইমশিটে।"
এখানে সমাজের যান্ত্রিকতা, আত্মার মৃত্যু এবং মানুষের নিঃসঙ্গতার কথাই এসেছে।

৩. পাঠকের ভূমিকা ও কবিতার সংবেদনশীলতা:

সেকাল:
সেকালে কবিতা ছিল মূলত উচ্চবিত্ত ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাঠকদের জন্য। সাহিত্যের একটি গঠনমূলক রূপে তা ধরা হতো। পাঠক-চিন্তাও ছিল গভীর। একজন রবীন্দ্র-পাঠক কবিতাকে আত্মার খোরাক ভাবতেন।

একাল:
বর্তমান পাঠকের ধৈর্য কম, তাই কবিতা হয়ে উঠেছে সংক্ষিপ্ত, মোবাইল-উপযোগী ও ইন্সট্যান্ট ইমোশনের বাহক। তবে এতে যেমন কিছুটা গভীরতা হারিয়েছে, তেমনি একধরনের আন্তরিকতা এসেছে। কবিতা এখন অনেক বেশি ব্যক্তিগত, আত্মকেন্দ্রিক।

৪. গুণগত মানের নির্ণায়কের রূপান্তর:

সেকালের কবিতার গুণগত মান মাপা হতো ছন্দ, কাব্যিক ভাষা, অলংকার ও দার্শনিক গভীরতায়। একালের কবিতার মান নির্ধারিত হয় ভাবের মৌলিকতা, প্রতীকী বয়ান এবং পাঠকের মনের গভীরে স্পর্শ করতে পারার ক্ষমতায়।

গুণমান মানে কি? পাঠকের হৃদয়ে আলোড়ন তোলা, চিন্তা সৃষ্টি করা, অথবা সমাজ ও বাস্তবতা সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া। এই নিরিখে একালের অনেক কবিতাও গুণমানের দিক থেকে সেকালের ধারক।
তবে, “গুণগত মান” একমাত্র পরিমাপক নয়—এটি সময়, সংস্কৃতি ও রুচির সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।

সাহিত্যজগতে সময়ের পরিবর্তন অনিবার্য, আর এই পরিবর্তনের ফলে কবিতার ভাষা, শৈলী ও দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তিত হয়েছে। সেকালের কবিতা যেখানে ছিল মাধুর্য ও ছন্দের আধার, একালের কবিতা সেখানে সত্য, আত্মদর্শন ও প্রতিরোধের ভাষা। সুতরাং, সেকালের কবিতার গুণগত মানকে শ্রদ্ধা করে আমাদের একালের কবিতাকেও তার উপযোগিতা ও সত্য প্রকাশের দিক থেকে মর্যাদা দিতে হবে। কারণ, কবিতা যুগের আয়না—আর প্রতিটি যুগই আলাদা, তার কাব্যিক প্রকাশও তাই স্বতন্ত্র ও স্বকীয়।
ধন্যবাদ।