বঙ্গকথা  ঈদ পূর্ণমিলনী কবিতা পাঠ ও স্টার অ্যাওয়ার্ড ২০২২, অংশগ্রহণ করতে আমি মোঃ বুলবুল হোসেন ও কবি অবিরুদ্ধ মাহমুদ ট্রেনে যাত্রা শুরু করি খুলনার উদ্দেশ্য। আমাদের সাথে খুলনায় যোগ দেন রংপুরের কবি লতিফুর রহমান প্রামানিক, আমরা অনুষ্ঠানের একদিন আগে খুলনায় পৌঁছে যাই এবং খুলনার কিছু দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ করি। প্রথমে আমরা রূপসা সেতুর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি।


খুলনার রূপসা নদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি জীবনানন্দ দাস লিখেছিলেন “রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদা ছেড়া পালে ডিঙা বায়; রাঙ্গা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে”। জীবনানন্দের সেই রূপসা নদীর উপর গড়ে তোলা হয়েছে খানজাহান আলী সেতু , যা রূপসা সেতু হিসেবেই বেশী জনপ্রিয়। রূপসা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সকল জেলা ও মংলা সমুদ্র বন্দরের সাথে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবার কারণে একে খুলনা শহরের প্রবেশ দ্বারও বলা হয়। জাপানি সহায়তায় নির্মিত রূপসা সেতু সকল উৎসব এবং সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে খুলনাবাসীর জন্য চমৎকার এক দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
রূপসা সেতুর দৈর্ঘ্য ১.৬০ কিলোমিটার। ব্রিজে পথচারী ও অযান্ত্রিক যানবাহনের যাতায়াতের জন্য রয়েছে বিশেষ লেনের ব্যবস্থা। এছাড়া মূল সেতুতে উঠার জন্য সেতুর দুই প্রান্তে দুটি করে মোট চারটি সিঁড়ি রয়েছে। সেতুর পশ্চিম প্রান্তে নদীর পাড়ে সবসময়ই দর্শনার্থীদের ভিড় লেগে থাকে। আর রাতের বেলায় সেতুর উপর থেকে খুলনা শহর দেখতে সবচেয়ে বেশী সুন্দর লাগে।


এরপর আমরা রূপসা সেতু  পাড় হয়ে।বাগেরহাট খান জাহান আলীর মাজার, ষাট গম্বুজ মসজিদ, খান জাহান আলীর দিঘি, দেখার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। প্রথমে আমরা খান জাহান আলীর মাজার, ষাট গম্বুজ মসজিদের যাই এবং যা দেখি।
বাগেরহাট জেলা যে কয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে বাংলাদেশে সুপরিচিতি লাভ করেছে হযরত খান জাহান আলী (র:) তাদের মধ্যে অন্যতম। ভারতে জন্মগ্রহন করলেও তিনি বাংলাদেশের যশোর, বাগেরহাট অঞ্চলে আসেন ধর্ম প্রচার করতে। বাগেরহাটে নির্মাণ করেন স্বরণকালের বিখ্যাত মসজিদ ষাট গম্বুজ মসজিদ। এখানেই রয়েছে তাঁর মাজার শরীফ।


খান জাহান দীঘির উত্তর পাড়ে এক উচ্চ ভূমিতে তাঁর সমাধি সৌধ নির্মিত। সমাধি সৌধটি বর্গাকৃতি,এর আয়তন ৪২ফুট X৪২ ফুট এবং প্রাচীরের উচ্চতা ২৫ ফুট,এর ছাদে একটি গম্বুজ আছে। সমাধি সৌধের ভিতর একটি প্রস্তর  নির্মিত বেদিতে হযরত খানজাহান (রঃ)এর মাজার অবস্থিত । দরগাহ বা সমাধি সৌধের স্থাপত্য  শিল্প অনেকটা ষাটগুম্বজের ন্যায়। শিলালিপিতে মৃত্যু তারিখ,দাফন তারিখ ছাড়াও আল্লার নাম,কোরআন শরিফের কয়েকটি সূরা এবং তাঁর উপর আল্লার শান্তি বর্ষিত হোক ইত্যাদি লিপিবদ্ধ আছে। প্রতিদিন দেশ-বিদেশের  বিভিন্ন স্থান থেকে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে হাজার হাজার ভক্ত তাঁর রুহানী দোয়া লাভের আশায় মাজার জিয়ারত করতে আসেন। এছাড়া প্রতি বছর ২৫ অগ্রহায়ণ এ মহান সাধকের মাজার প্রাঙ্গনে বার্ষিক ওরশ মোবারক এবং চৈত্র মাসের প্রথম পূর্ণিমায় বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে এক বিরাট মেলা অনুষ্ঠিত হয়।


হযরত খানজাহান (রঃ) কর্তৃক নির্মিত অপূর্ব কারম্নকার্য খচিত পাঁচ শতাব্দীরও অধিক কালের পুরাতন বিশালায়তন এ মসজিদটি তাঁর দরগাহ হতে প্রায় দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। স্থাপত্য কৌশলে ও লাল পোড়া মাটির উপর লতাপাতার অলংকরণে মধ্য যুগীয় স্থাপত্য শিল্পে এ মসজিদ এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। যদিও ইহা ষাটগম্বুজ মসজিদ নামে পরিচিত, কিন্তু প্রকৃত পক্ষে  উপর চারটি গম্বু^জসহ এতে মোট ৭৪টি গম্বুজ  আছে এবং মধ্যের সারির বাংলা চালের অনুরূপ ৭টি চৌচালা গম্বুজসহ এতে মোট ৮১টি গম্বুজ আছে। বিশেষভাবে লক্ষনীয় যে, এর প্রার্থনা কক্ষের চৌচালা ছাদ ও গম্বুজ ইট ও পাথরের ষাটটি খাম্বার দ্বারা সমর্থিত খিলানের উপর নির্মিত।


জনশ্রুতি আছে যে, হযরত খানজাহান (রঃ)  
ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণের জন্য সমুদয় পাথর সুদুর চট্রগ্রাম, মতামত্মরে ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল থেকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা বলে জলপথে ভাসিয়ে এনেছিলেন। ইমারতটির গঠন বৈচিত্রে তুঘলক স্থাপত্যের বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এ বিশাল মসজিদের চতুর্দিকে প্রাচীর ৮ফুট চওড়া, এর চার কোনে চারটি মিনার আছে। দক্ষিণ দিকের মিনারের শীর্ষে কুঠিরের নাম রোশনাই কুঠির এবং এ মিনারে উপরে উঠার সিড়ি আছে। মসজিদটি ছোট ইট দিয়ে তৈরী, এর দৈর্ঘ্য ১৬০ফুট, প্রস্থ ১০৮ ফুট, উচ্চতা ২২ফুট। মসজিদের সম্মুখ দিকের মধ্যস্থলে একটি বড় খিলান এবং তার দুই পাশে পাঁচটি করে ছোট খিলান আছে। মসজিদের পশ্চিম দিকে প্রধান মেহরাবের পাশে একটি দরজাসহ মোট ২৬টি দরজা আছে। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগ পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণের জন্য এ ঐতিহাসিক মসজিদ এবং খানজাহান (রঃ) এর মাজার শরীফের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে । ইউনেস্কো এ মসজিদটি বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অমত্মর্ভূক্ত করেছে।


সত্যি আমাদের ভ্রমণ সার্থক হয়েছে। শহরের কথা কি বলবো পরিপাটি দেখে মন ভরে গেল।