১৯৮৩ সাল, আমি তখন মিশিনারি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। ক্লাসে আমি আর আমার মামাতো ভাই রুবেল ছাড়া বাকি সবাই পুরনো। আমরা এসেছি চাঁটগা শহরের একটি পুরনো বাংলা স্কুল থেকে যেখানে আমি ক্লাস সেভেনে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম। বাবার মুখের সেই মিষ্টি হাসি এখনও আমার মনে পড়ছে। একেত কনিষ্ঠ পুত্র তার ওপর আমি ছিলাম ভীষণ লাজুক ও নরম স্বভাবের তাই বাবা আমার ওপর আস্থা রাখতেনই বেশী। কিন্তু ছিমছাম মিশিনারি স্কুলের জীবন আমার জন্য খুব একটা সুখকর হলনা। আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লাম। এক অসুখেই খেলাধুলা, উচ্ছলতা সবকিছুর মৃত্যু হল অনাকাঙ্খিত ঝরের দোলায়।
শান্ত ছেলেটি এখন হয়ে উঠলো ভীতসন্ত্রস্ত, যাকে সহজেই আঘাত করা যায়। ক্লাসের পড়ার প্রতি একটু আধটু উদাসীন হয়ে উঠছি, এমন সময় আমার বড় ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন তার এক নেতা গোছের কম্যুনিস্ট বন্ধুর সাথে, ব্যস কেল্লা ফতে- সেই যে কবিতা লেখা শুরু হল আর থামেনা। দেয়ালিকায় লেখা আমার বামপন্থী কবিতাগুলো পড়ে ব্রাদার বুঝে গেলেন এগুলো সব লাল বইয়ের দর্শন চর্চার ফলাফল। তিনি আবিস্কার করলেন শুধু আমি নই, আমার সাথে আরও কয়েকজন মার্কসবাদে আসক্ত, রীতিমতো আতঙ্কের ব্যাপার! ১৯৮৪ সাল, সেই সময় আমেরিকা আর তার মিত্রদের একমাত্র শত্রু হচ্ছে সমাজতন্ত্রিক দুনিয়া। সেই সময়ের লেখা কবিতা আর ছড়াগুলো এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, আমার ক্লাসের সহপাঠীরা প্রায়ই সেগুলো আবৃতি করতো একান্ত বন্ধুদের আড্ডায়।
১৯৮৬ সালে আমরা যখন মেট্রিক পরিক্ষার পালা শেষ করলাম তখন বন্ধুরা ঠিক করলাম আমার একটা কাব্যসঙ্কলন জরুরি ভিক্তিতে আগামী শরতের শুরুতেই বাজারে ছাড়া হবে। এদিকে আমার কয়েক বন্ধু ছিল ভীষণ ডানপন্থী। তারা আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাইলে আমিও হাতবারালাম বন্ধুত্তের। এইভাবে হঠাৎ একদিন দেখি আমার পাণ্ডুলিপি হাওয়া। সেই যে কবিতা লেখা বন্ধ হল সেটা চলল আরও অনেক বছর। ২০০০ সালে যখন আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “আকাশের স্টাফ নোটেশান” প্রকাশিত হল, তখনও আমার মনে পড়ছিল আমার হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির প্রথম কবিতার কয়েকটা পংতিঃ আমার মুখের সামনে খাবারের লোভ, মাথার ওপর পুঁজিবাদের টন টন কৈফিয়ত, হাতে ভাঙ্গা মাত্তুল, পায়ের তলায় বন্য ঝোপ.........।।