একটা ভিডিও দেখছিলাম। কি দেখলাম? দেখে শুধুই কেঁপে উঠছিল অন্তর। চলে গেলাম অতীতের সেই ঠাকুরদা ঠাকুরমার গল্প কাহিনীতে। ভিডিওতে দেখলাম কাপড়ে মোড়া, মুখোশ পরা কতগুলো মানুষ একটা বাড়ির দরজায়। কাউকে চেনা যাচ্ছে না। মনে হলো সেই পুরাতন গল্পের কথা, স্বর্গের কথা, মর্তের কথা, যমদূতের কথা, অবচেতন মনের ভয়ের চেতনা ফিরে এলো আজ বর্তমানে। হয়তো বলবে কেন বলা এত কথা? ওই যে কাপড়ে মোড়া মানুষগুলোকে দেখতে লেগেছিল যমদূতের মত। ওরা এসেছে ওই বাড়ির দরজায় চিত্রগুপ্তের কাছ থেকে নোটিশ নিয়ে। এ বাড়ির একটা মেয়ে নাকি আক্রান্ত করোনায়। তাকে নিয়ে যেতে হবে হাসপাতলে। যমদূতের মত মানুষগুলো বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায়, কখন বেরিয়ে আসবে কত স্বপ্ন মাখা নব যৌবনা সেই মেয়েটা। একজন যমদূত তাক করে তার হাতে মোবাইল ক্যামেরা। দরজা খুলে গেল। হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে মেয়েটা করুণ চোখে ধীরে ধীরে পা বাড়ালো হাসপাতালের পাঠানো অ্যাম্বুলেন্সের দিকে? না অন্য কোন অজানার উদ্দেশ্যে? মা বাবা করুন মুখে শুষ্ক চোখে দাঁড়িয়ে রইল মেয়ের চলে যাওয়া পথের দিকে। অ্যাম্বুলেন্সের দরজা খোলা ছিল। মেয়েটা একবারও পিছনের দিকে তাকালো না, আপনজনদের শেষ দেখা তো বুঝি আর দেখতে চাইছিল না। সে বুঝি পরিবারের কাছে হয়ে গেছে অযাচিত, পর। তার প্রয়োজন বুঝি ফুরিয়ে গেছে বাবা, মা, আত্মীয় স্বজনের কাছে। যমদূতেরা চার পাঁচ জন নিষ্পলকে হয়তো তাকিয়ে ছিল আত্মীয়-স্বজন এবং নিষ্ক্রমণ মুখো মেয়েটার দিকে। ও যে না কেঁদেও কাঁদিয়ে গেল পশ্চাতে যাদের ফেলে গেল। হঠাৎ পোশাকে মোরা মুখোশ পরা মানুষ গুলো সক্রিয় হয়ে উঠলো, নির্দেশ দিল গ্লাভস পরা হাত এম্বুলেন্সের খোলা দরজার দিকে। আমার কাছে মনে হল এ যেন এম্বুলেন্স নয় সেই যমরাজের রথ, যেই রথে চড়ে মেয়েটা পাড়ি দেবে সেই অজানার পথে। ফেলে গেল তার পরিচিত ঘরে কত স্মৃতির মালা, কত স্বপ্ন মাখা উতলা হৃদয়ের ভাবনা নিঃশেষে। মেয়েটার গোপন মনের গোপন কথা কেউ তো শুনল না, কেউ তো জানলো না। হয়তোবা সাজাতে চেয়েছিল জীবনটাকে ফুলো দলে সুন্দর করে। কি হলো? কেন হলো? কোন বিষে? ধীরে ধীরে মেয়েটি উঠে পড়ল খোলা দরজা দিয়ে রথের ভিতরে। যমরাজের একজন দূত সে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল কঠিনভাবে। তারপর অবাক বিস্ময় দেখলাম ঐ দূত রূপি মানুষগুলো তাকিয়ে আছে নিষ্পলকে বাড়ির দরজার দিকে আর ওখানে দাঁড়িয়ে বাড়ির অন্যান্য লোকেরা রথে চড়ে বসা ঐ মেয়েটার একান্ত আপন হঠাৎ হয়ে যাওয়া পরেরা। বুঝি ক্ষণিকের তরে ওদের চোখ ও বুঝি অশ্রু সিক্ত হয়ে উঠেছিল অন্য কোন অজানা আশঙ্কায়। কেউ জানে না ওই মেয়েটা আর ফিরবে কিনা তার ফেলে যাওয়া ওই স্মৃতি ভরা ঘরে? যদি করোনা থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসে তাহলে আবার উপভোগ করবে এই পৃথিবীর সৌন্দর্য আর ভালোবাসা। আর যদি অন্যথা হয় - তাহলে আর ফেরা হবে না বাড়িতে। ওই হাসপাতালের মর্গ থেকে যমদূতের হাত ধরে চলে যাবে কোন এক শ্মশানে যেখানে দাফন করা হবে তাকে। ফিরিয়ে দেওয়া হবে না কোন কালে তাঁর প্রাণহীন দেহ আত্মীয়র কাছে। ভয়ে ভয়ে কাঁপছে হৃদয় জগৎজুড়ে সব মানুষের, করোনার ত্রাসে। তাহা তো নয় মিছে। কোন চিহ্ন থাকবে না আর ওই মেয়েটার। মা বাবা,আত্মীয়, স্বজন, কেউ পাবে না আর তারে খুঁজে এই ধরার পরে। আমরা যারা রইলাম পড়ে - থাকবো এক অবিশ্বাসের ঘোরে। কখন কার সময় হবে একে একে চলে যাবে ধীর পায়ে আপন দের ছেড়ে সমাপ্তির রেখা টেনে। যে ঝরে যায়, সে তো ঝরে যায় মাটিতে মিশে যায় সবার অগোচরে প্রকৃতির নিয়মকে ধরে। শুধু হাহাকার পড়ে রয় এই ধরণীর ঘরে। সবাই একবার ভাব না, মানুষ - মানুষ হয়ে মানুষের
তরে কিছু করো না। যতটুকু পারো, সামর্থ্য অনুযায়ী ততটুকু করো না; রুখে দিতে হবেই হবে ওই করোনা।
২০ শেষ বৈশাখ, ১৪২৭,
ইং ০৩/০৫/২০২০,
রবিবার সকাল ১০:১১। ৯৯৬, ০৪/০৫/২০২০।