একটা ছোট্ট কফির চারা এনেছিলাম,সেই সুদুর
শিলিগুড়ি থেকে। গাছটা রোপণ করলাম বাগানে।
সার দিলাম, জল দিলাম, ক্রমে ক্রমে বড় হলো;
ফল দিল অনেক বছর, সাথে দিল নতুন চারা গাছ,বড় করলো নিজের ছায়ায়। তারপর-একদিন রীতাএসে বললো আমায়,“জানো!আমাদের বড় কফিগাছটার পাতাগুলো কেমন যেন-হলুদ হয়ে যাচ্ছে, হয়তো বা বেলা শেষ, গাছটা মরে যাবে”।
আমি কিছু দিন বাগানে যাইনি, জল দেইনি, দেইনি-গোবর সার, তাই বুঝি অভিমানে চলে যেতে চায়; অনাদরে বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়া বুঝি ভাল, মনে মনে ভাবলাম তাই। আমি বাগানে গিয়ে গাছটাকে ধরে নাড়া দিতেই গাছটা শিকড়সহ মাটি থেকে উঠে এলো। আমি অবাক হয়ে গেলাম! নখ দিয়ে গাছের বাকলটাকে খুঁড়ে দেখলাম সবুজ ও রসালো, মনে হলো জীবন্ত! পাশে প্রতিবেশী বন্ধুরা দাড়ায়েছিল, বললো- “গাছটা মরে গেছে”। আমি খানিকটা সময় নিঃশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, ভাবছিলাম ওর শৈশবের কথা; হঠাৎ এক বন্ধু বলে ফেললো-“গাছটায় আপনার বৃদ্ধ বয়সের জন্য একটা ভাল লাঠি হবে, যত্ন করে রেখে দেবেন"। কথাটা শুনে দুচোখে জল এসে গেল। গাছটা কখন যে হাত থেকে পড়ে গেল বুঝতে পারিনি। চোখের জল লুকানোর ছলে বন্ধুদের বললাম- “তাহলে দাঁ টা নিয়ে আসি”। দাঁ টা নিয়ে এলাম চোখের জল মুছলাম, তারপর ওদের সামনেই দাঁড়িয়ে কফি গাছটাকে একটা সত্যিকারের সুন্দর লাঠির আঁকার দিলাম এবং ভাবলাম- মানুষ মরলে তাঁর ছবি ঠাঁই পায় এ্যালবামে আর আমার এই কফিগাছ- যাকে সন্তান তুল্য বড় করেছিলাম তিলে তিলে, তাঁর ঠাই হবে আমার হাতে, ছবি হয়ে এ্যালবামে নয়, পিতার হাত ধরে ছোট্ট সন্তানেরা যেমন পথ চলে, এই লাঠিও তেমনি হয়তো আমার সহয় হবে বৃদ্ধ বয়সে আপন পরশে। সন্তানেরা বড় হয়ে দূরে চলে যায়, হয়তোবা থাকবেনা কাছে সেই মৃত্যুর সময়। এতদিন একাকী যেমনটি ছিলাম, দূরে বসে ভাববে মা-বাবা ঠিক তেমনটিই আছে। কখনো সখনো সন্তানের ছবিটা দেখবো এ্যালবাম খুলে আর বুকের মাঝে মোচোড় দিয়ে উঠবে ক্ষনিকতরে, লাঠিটা তখনই ঝুঁকে পড়বে বুকের মাঝে, বলবে আমি আছি পাশে তোমার কাছে। তখনই হয়তোবা হাতদিয়ে চেঁপে ধরবো বুকের মাঝে ব্যথার ছলে। যার জন্য রাত জেগেছি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, বছরের পর বছর সে রবে দূরে আর যারে রাখলাম অনাদরে বাগানের এককোনে সেই আজ আপন হয়ে রাখবে ধরে নিজের করে। ও হয়তো ছেড়ে যাবেনা জীবনের শেষ দিনটা অবধি; দাঁড়িয়ে রবে আঁকড়ে ধরে। আমি ও রীতা, আগে কিংবা পরে যাব চলে একজন আর একজনকে ছেড়ে। আর লাঠিটা- ও থাকবে আমাদের কাউকে না কাউকে জড়িয়ে। অস্তাচলে দিনমণি চুমে যাবে সমাধি, তুলসীতলার প্রদীপের মত, রক্তিম আভায়। ক্রমে ক্রমে তারপর মোরা হবো ইতিহাস। যেদিন আমাদের জীব দেহ জড় হবে, লাঠিটা সেদিনও হয়তোবা দাঁড়িয়ে থাকবে আমাদের সমাধির পাশে চুপি চুপি বলবে আমি আছি তোমাদের কাছে তোমাদের পরশে একান্তে মিশে।


৮ই চৈত্র, ১৪২৩,
ইং ২২/০৩/২০১৭,
বুধবার, রাত ৩টা।