অস্বস্তি লেগেই আছে বুকে।
শাওয়ারের ঝরণা থেকে দুপুরে গরম পানি বেরয়,
গুমসানিতে অস্থির, বর্ষার চরিত্রও যেনো পাল্টে গেছে,
বেড রুমের দুটি ফ্যানের একটি বিকল হওয়ার উপক্রম;
কত আর বিরতিহীন চলতে পারে?
ছাদের উপরে তৃষ্ণার্ত কাকের কোলাজ,
এদিকে পান্তার সাথে মরিচ পোড়া পাচ্ছি না,
দু’দিন ধরে মুদি দোকান কখন খুলছে বুঝতে পারছি না;
প্রতিদিনের অস্বস্তি বেড়েই চলেছে।


প্রায়ই রিকশায় দেখছি একান্ত ভরসার অক্সিজেন সিলিন্ডার
শক্ত করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, রিকশায় আরোহণকারীর মুখ;
বিবর্ণ, ফ্যাকাশে, আতঙ্কের ছাপ, চারিদিকে দৃষ্টি, স্থির নয়।
অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ কানে যুদ্ধের শব্দ শোনাচ্ছে,
এ যুদ্ধের সকল উপকরণ এখন ফার্মেসিতে মজুত হচ্ছে;
অস্বস্তি লেগেই আছে বুকে।


ছেলের করোনা,
এমন খবর শুনে মেঝ ভাই ফোনে হাউমাউ করে কেঁদেছে—
“আমি কেনো শুনিনি? আমাকে কেনো বলোনি?”
সবাই শুনেছে, সে শুনলে কী হতো জানি না,
সে কেনোইবা শোনেনি তাও জানি না।
লকডাউন শিথিলতার খবরে ফেসবুক সয়লাব
মানুষের সারি, শহরে ফেরার ছবি;
মিথ্যা কিংবা গুজব বোঝা যাচ্ছে না,
স্কেচ বুকে রেখাগুলো এলোমেলো সমীকরণে ক্লান্ত।
আমার প্রিয় নেশা ”সংবাদ” দেখতেও এখন ভয় পাচ্ছি,
নেশার অবিনাশী আলিঙ্গন কখনো কখনো অস্বস্তির;
মৃতের সংখ্যা দু’শ থেকে নামতেই চাইছে না,
ঝড়ের আভাষের মতো ছায়ামুখে ভেংচি কাটছে;
অস্বস্তি লেগেই আছে বুকে।


আমার প্রিয় মানুষ; যাকে চুমু দিয়ে বিশ্বাসের ঢোক গিলতাম,
ফেসবুকের মেসেঞ্জারে ভেসে আসা অশালীন ব্যবহারে
সেও অস্বস্তিতে আছে, বোঝাতে পারছি না
এর সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই,
সমগ্র জীবন প্রেমে এতোই বিভোর ছিলাম যে,
শুধুই ছুটে চলেছি, অবিশ্বাসী হওয়ার ফুরসত মেলেনি,
প্রেমহীন হলে কী হতো জানি না; মানব জীবনের কতো দোষ!


মেয়েটি প্রায়ই তার ঘর থেকে এসে
নিজের ঘাম যুক্ত চেহারাকে বিরক্তি দিয়ে বলে—
”আমি বাস্কেটবলে ভর্তি হব, নিয়ে চলো।”
পরক্ষণেই সব ভুলে মাকে ডাকে—
”মা, চুল বেঁধে দাও, গরমে অস্বস্তি লাগছে।”
ছেলেটির কোনো খেলা দেখাই মিস নেই টেলিভিশনে,
সেই ছোটবেলা থেকেই তার সকল আয়োজন খেলাকে ঘিরেই,
সিনেমা, নাটক, গল্প, কবিতা এসব তার কাছে ভাসা-ভাসা সাময়িকী,
আমাকে কতো যে খেলার টিকিট কাটতে হয়েছে তার জন্যে।
করোনার আক্রান্তে সে প্রায়ই ক্লান্ত থাকে, প্রায়ই তন্দ্রাঘুমে বিভোর হচ্ছে,
শেষ রাতে হালকা ঘুমিয়ে উঠে আমাকে বলেছে—
”ইতালি না ইংল্যান্ড জিতেছে?” তাতে আমি অবাক হয়নি।
কিছুক্ষণ পর ওর ঘর থেকে মোবাইল হাতে এসে বললো—
”সবচেয়ে সভ্য জাতি; দেখো, তাদের অতিথি,
ইতালির দর্শকদের কিভাবে পেটাচ্ছে।
ইংল্যান্ডের এমন ফাইনালের হোস্ট হওয়ার দরকার কী ছিলো?”
ওর মা পাশ থেকে বিরক্ত হয়ে বললো—
”এর চেয়ে সব কিনে নিতিস; রেফারি, মাঠ, গোল, জয়, ফিফা সব সব
তবুও এমন কেন করলি।”


ক্ষুধার্ত মানুষের পোস্ট ফেসবুকে লুকিয়ে লুকিয়ে ইশারা করছে;
নোনাজলে কান্নার রক্ত যেমন কেউ দেখে না,
আশপাশ কেউ কিছু বলে, কেউ মন্তব্য করে,
এবস্ট্রাক্ট শব্দে এখন অনেক ঘটনা খুঁজে পাওয়া যায়।
ভাবছি, যাদের অ্যান্ড্রয়েড নেই তারা তো কিছুই বলতে পারছে না,
চারিদিকে অস্বস্তি, হাঁসফাঁস, ফিসফিস লেগেই আছে।


কথিত মধ্যবিত্তরা নাকি উন্নয়নশীল দেশের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বাসিন্দা,
তারা সমাজের দর্পণ, তারা দেশের হাতিয়ার,
তারা সবসময় ভোটাধিকার চায়, তাদের মিছিল,
তাদের কলতান শহর জুড়ে গল্প কবিতা বানায়,
তাদের কম্পোজিশনে বজ্র আঁটুনি ছক সবাই আঁকতে পারে না,
ফস্‌কা গেরোর কৌশল যারা বুঝতে পারে
তাদের চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়ে দেশের সুনাম বয়ে আনে।
ইদানিং মধ্যবিত্তের সংখ্যা কমছে, কমেই চলেছে,
বিত্তশালী আর দরিদ্ররা; খবর জুড়ে—
বিত্তশালীর মৃত্যুতে মানুষ তিরস্কার করে,
দরিদ্রদের খবরগুলো চ্যানেলের টিআরপি ধরে রাখে।
মধ্যবিত্তরা তবে কী গর্তে উট পাখির মতো মুখ লুকিয়ে আছে!
দৃশ্যত-অদৃশ্যত সব ঘোলাটে।


মশা এক জায়গায় স্বস্তিতে বসতেই দিচ্ছে না, কয়েল ফুরিয়ে গেছে,
ভোর পাঁচটায় ফোন বেজে উঠতেই ভয় পেয়ে গেলাম
সবচেয়ে প্রিয় ফোনকে অস্বস্তি লাগছে,
ওপাশ থেকে ভারী গলার ফ্যাশফ্যাশ শব্দ—
”মামা, মা আর নেই!”


১২ জুলাই ২০২১, শঙ্কর, ঢাকা।