উত্তরে চলেছ : ক্রমশ শহর পেরিয়ে দুরে;
শহরতলি, ক্রমশ বনানী, দুরে ছুটেছে নদীবাহী ডাক,
খড়স্রোতা হুংকার, আরও গভির ব্ন, গভিরতর;
ক্রমশ গভিরের তরে।
বুকের বাতাস শীতল হয়েছে। সূর্য ফাঁকে ফাঁকে চলে যায় মেঘের অন্ধকারে।
সেগুন, মহুয়া ছায়া ফেলেছে, নদী নিয়েছে বাঁক।
সূর্য এখানেও আসে রোজ, চলে যায় ধারার মতন।
উত্তরে চলেছি ক্রমশ; পিছুটান, আগামীর ডাক ছায়া ছড়ায় রৌদ্র ঝরায়
ঢেউ তোলে সারাদিনমান।
দুইধারে ঘন বন, বিশৃঙ্খল, তবু পরম শৃঙ্খলা
-আমার পথিকদেহ নিল এইখানে বিশ্রাম।


অনেকটা চলে এসেছি উত্তরে;
দেখলাম- বিদীর্ণকরা বনপথ হেটে এসেছি। সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে।
বনানী, শহরতলি শহর মলিন হয়ে গেছে, নিরুদ্দেশে;
মানুষের দেখা নেই, লোকশূন্য প্রদোষকাল, জনশূন্য সমস্ত প্রান্তর।
মেঘ লাল করে সূর্য ডুবে যাচ্ছে শেষ গাছটির শেষে,
পথের ’পরে বসে আছি পশ্চিমের পানে চেয়ে; জনহীন সমস্ত প্রান্তর।


সকল শুধু সাধকেরা জন্ম নেয় পৃথিবীর ’পরে;
আমি জানি, ঘরে , সাধে পৃথিবীর পথ
-সকল পৃথিবীর পথে পথিকের বাস।
সূর্য ডুবছে আকাশে,
পৃথিবীও বহু পথ ঘুরে তৃপ্ত হচ্ছে এইবার।


দেখছি বনের ভিতর- দুয়েকটা পাতা ঝরল নিঃশব্দে,
গাছেরা ক্রমশ গভির হচ্ছে, গভিরতর।
বহুদুর চখ গেছে, তবু তারও পরে দেখার ইচ্ছে।
ভাবলাম- কতজন এসে গেছে এই পথে,
পদচিহ্ন ধুলায় মলিন হয়ে যায়;
কত সাধকের বাস বনগভিরে! সাধনার শেষ কোথায়!
বহুযুগ কেটে যায়।


মনে জাগল আরও দূর দেখার ইচ্ছে। আমার মন দেখতে চায়-
যতদূর দেখা যায়, যতদূর চোখ গেছে তারও পরে।
তখনও পশ্চিমের আকাশে লাল আলো।
যতদূর চোখ গেছে তারই পরে মিলবে সন্ধান,
তবে আমার চোখ আর যেতে পারেনা।
কোন না-দেখারে দেখার ইচ্ছে নিয়ে আমাকে উত্তপ্ত করে
সন্ধানের ব্যাকুলতা, তবু নিরুপায়!
গোপন এক চিৎকার আমার বুক বিদীর্ণ করে-
বনের অন্ধকার গভিরে আমার সন্ধান।


দেখলাম- বিদীর্ণকরা বনপথ পেরিয়ে এসেছি, সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে
উত্তরে আরও হাঁটাপথ, মাঝখানে আমি পথক্লান্ত,
বসে আছি পথের ’পরে, সন্ধ্যা ঘনাচ্ছে ক্রমশ,
লোকশূন্য অন্ধকার, নির্জন সমস্ত প্রান্তর।
আমার চোখ চলে যেতে চায় গভিরে।
হয়ত সেখানেই কোনদিন কোন পথক্লান্ত শুনেছিল; অন্ধকার হতে আওয়াজ এল-


“হে তথাগত”, সুস্পস্ত কণ্ঠস্বরে, “বহুদুর চোখ গেল তবু সন্ধান মিলল না!
কত না-দেখারে দেখার পরেও কিছু বাকি রয়ে যায়!
মানুষের লক্ষ্য ছিল শুধু রহস্যের খোঁজ।
দ্যাখো, কৃষ্ণচুড়ার ফুল দিগন্তের মত লাল,
দ্যাখো, আকাশ বাতাসের ব্যাকুলতা, পৃথিবীর তৃপ্তি কামনায় উদগ্রীব।
ঝিঝি-রব, জোনাকির চলাচল
বাতাসের শীতলতা নদীর কলতান,
ক্ষীণ মেঘাবৃত শরতাকাশ মগ্ন জ্যোৎস্নারাতে,
মহারনের রণভূমি মরুভূমির ঝড়-
-এই মহাস্বর্গ মহাকাশ সমস্ত পৃথিবীকে সাক্ষ্য করে।”
- ঘন অন্ধকার থেকে সুধায়ছিল সে, যারে দেখা গেল না।
হঠাৎ শরিরে বাতাস লাগল এসে, মৃদু সমিরন
বোধ করা গেল।
মনে ভাবলাম- পৃথিবীর ’পরে সেই না-জানা করে জানা হবে আর!
সেই রহস্যময়ী কোন আলোতে দেবে দেখা!
আরও হাঁটাপথ উত্তরে, দূরে,
সেই হদিশ মিলল না তবু।
লোকশূন্য অন্ধকার, নির্জন সমস্ত প্রান্তর, মাঝখানে আমি,
পথক্লান্ত।
রহস্যই রয়ে গেল তা, যার ধর্মই অভেদ্যতা,
যে রহস্য চিরকাল রয়।
বনের কাছে সুধালাম- “হে, তুমি, মায়াবতী ... ভাল থেকো।”
এই খানে আমি, উত্তরে হাঁটাপথ আছে,
লোকশূন্য অন্ধকার, নির্জন সমস্ত প্রান্তর, রাত্রী ঘনাল গাঢ়
-এইখানে ক্ষণিকের বিশ্রাম।


(২০১৩ সালের কথা। অক্টোবর মাস। সন্ধ্যায় ‘রাজাভাতখাওয়া বন’ হয়ে যেতে সময় এই অনুভূতিটা মনের মধ্যে নাড়া দিল, সেইটাই খাতায় লিখে রাখলাম। অনেকদিন পর সেই ম্লানপ্রায় অনুভূতিটাই প্রকাশ করতে হল।)