"আমার কাছে কেউ আসেনা কেন বলতো?"
মায়ের মুখে এই ব্যাকুল প্রশ্ন আর হতাশার দৃষ্টি
শুনে-দেখে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিলো আমাদের।
সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়ে বলি,
"সকলেই তো বড্ডো ব্যস্ত আজকাল।"
সত্যি! বড্ডো ব্যস্ত!
এই শহরটা, সময়টা... এই রকমই!


আমরাও ভীষণ ব্যস্ত। অফিস থেকে ফেরার পথে
সপ্তাহে দু'দিন ছুটে ছুটে আসি মায়ের এই একলার
সংসারে... বৃদ্ধাশ্রমে। তাঁর সংসারের প্রয়োজনীয়
জিনিসপত্র নামিয়ে দিয়ে ফিরে যাবো। মাছ,
আনাজ, চাল, সাবান, চা পাতা, ... জিনিসগুলোর
দিকে একবারও তাকিয়ে দেখেন না মা। একপাশে
সরিয়ে রাখেন। জিনিস চাওয়া তো ছুতো। মা চান
আমাদের সময়। জমিয়ে গুছিয়ে গল্প করার মতো
অনেকটা সময়।


আমরা তো সফল সন্তান মায়ের। তাই, আমরাও
ব্যস্ত,... সফলতার পেছনে ছুটতে ছুটতে। সারাদিন
দৌড়োচ্ছি। মা সেটা বোঝেন।
কিন্তু, চারপাশের একশোটা ফ্ল্যাটের পাঁচশো মানুষের কেন সময় নেই একটিবার এসে খবর নেওয়ার, মা সেটা বুঝতে পারেন না।
আমি বা দাদারা দেখা করে ফিরে গেলে মা আবার
ঝুলবারান্দায় গিয়ে বসবেন। শুরু হয়ে যাবে তাঁর
পথ চাওয়া... অপলক চেয়ে থাকা, আগামী সপ্তাহের
আগে আমরা আসছি না জেনেও।


স্বপ্ন পূরণের ইঁদুর দৌড় চলছে অনবরত। প্রতিযোগিতা, ... কেবলই প্রতিযোগিতা।
আর এই প্রতিযোগিতা ক্রমশ একা করে দেয় আমাদের নাগরিক জীবনকে। এগিয়ে গেলেও একা, পিছিয়ে পড়লেও একা। নেই জীবনের উত্তাপ অনুভব। হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের সম্পর্ক,... মানুষের সান্নিধ্য। জনসমুদ্রের এই শহর, অথচ মানুষের কী অতল নির্জনতা!
জনবহুলতার মধ্যে বিচ্ছিন্নতার ব্যাধি, যা শহরের একেবারে নিজস্ব।


আজ কয়েকদিন ধরে মা অসুস্থ। শেষের আগের ক'দিন ভালো করে খাওয়া হতো না মায়ের। থরে থরে সবকিছুই সাজানো রয়েছে, তবুও। কাজের লোক না এলে দরজা খোলার জন্য ওঠার দরকার পড়তো না। কাজেই খাওয়ারও দরকার হতো না।
মাঝে মাঝে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অচেনা লোকজনদের
ডাকতেন মা। কেবল-অপারেটর, কাগজওয়ালা, ইলেকট্রিশিয়ান,... এইসব লোকজনদের।
"একটু ওপরে আসবে, মিষ্টি খাওয়াবো!"


এ শহর, সভ্যতা আমাদের দিয়েছে বেছে নেওয়ার
অবাধ স্বাধীনতা, গতি, বিনোদন, বৈদ্যুতিন সংযোগ।
কিন্তু, হারালাম সংসর্গের উত্তাপ, মানবস্পর্শ, অকারণ আসা-যাওয়ার বাহুল্য।


মায়ের শরীরটা বেশ খারাপ। আমার ডাক্তার বড়দা
খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখে দেয়। মা বলেন,
"এ কী রকম ডাক্তারি রে তোর, ছুঁয়ে তো দেখলিনা একবারও!"
"ছুঁয়ে দেখার দরকার পড়ে না", বড়দা গম্ভীর হয়।
আমিতো আর ডাক্তার নই, কাজেই মাকে ছোঁয়ার
দরকার হয় না আমারও।


চুলে জট পাকাচ্ছে, এনে দিয়েছি ভালো চিরুনি। গায়ে ময়লা জমেছে। ইম্পোর্টেড সাবান তেমনই পড়ে আছে। চুলটা আমি আঁচড়ে দিই, সাবান টা ঘসে দিই পিঠে,... মা চাইতো। পণ্য কিনে দেওয়া অনেক সহজ, সময় দেওয়ার চাইতে।


আগুনের বুকে মাকে তুলে দেওয়ার আগে চোখ পড়ে যায় মায়ের এলিয়ে থাকা ডান হাতটার দিকে।
কী শ্বেত শুভ্র হাত! আজন্ম চেনা। নীল, দীর্ঘ শিরা জেগে আছে। যেন এখনও জীবন স্পন্দমান!


মনে পড়ে যায়,... কতোকাল ওই হাত আমি আমার হাতে তুলে নিইনি! মনে হয় ওই হাত একটিবার ভালো করে আমার গালে ছোঁয়াই। ভেতর থেকে শৈত্য ছুটে এসে ধাক্কা দেয় ভলকে ভলকে। বুঝতে পারি শ্মশানে বসে আছি।
মুখাগ্নি হয়ে গেলো। সর্বগ্রাসী আগুন মায়ের দেহকে
ক্রমশ গ্রাস করে।
তাকিয়ে থাকি মায়ের চিতার আগুনের কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার দিকে। মনে হয় ছেলেদের একটু ছোঁয়া পাওয়ার অপূর্ণ অনন্ত আশাগুলো ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে উঠে যাচ্ছে আকাশে।


ভাবতে থাকি,...মা আর কোনদিন ওই ঝুলবারান্দায়
আমাদের আশায় তাকিয়ে থাকবেনা, আর কোনদিন বলবেনা, সেই কথাটা,...
"একটিবার ছুঁয়ে দেখলিনা তো!"
মায়ের 'ছুঁয়ে দেখা'র আর্তির অভিঘাতে আমার হৃদয় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। মর্মে মর্মে বেজে চলে ওই একটি কথাই, ....


"একটিবার ছুঁয়ে দেখলিনা তো!"।।


7th August, 2018
রবীন্দ্র আবাসন, টালিগঞ্জ, কোলকাতা।