তখন সবে কবিতা পড়ার ফাঁকে একটু আধটু দুঃসাহস করে দু-চার লাইন লেখা। বিশেষ করে দরকার হয় প্রেমপত্র লিখতে গেলে, যদি জুতসই দু চার লাইন কবিতা মাঝে জুড়ে দেওয়া যায় তা হলে সেই প্রেমপত্র হিট। তেমনি এক বিকেলে প্রেমপত্র লিখতে গিয়ে মুশকিলে পড়লাম। লেখার সাথে সাযুজ্য রেখে, না মাথায় আসছে ভালো কোন কবিতার লাইন না অন্য কোন কবিতা। যখন নিজের মাথা থেকে কিছু বার হচ্ছে না তখন অন্য কবির লেখা থেকে বেমালুম ঝেড়ে দেওয়া বোধ হয় বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। তাই খোঁজা শুরু, হাতড়াতে হাতড়াতে পাওয়া গেলে এক কবিতা; যার প্রথম লাইন পড়ার পর যে মুগ্ধতা জড়ো হোল তা আজো শেষ হয় নি। বলার কথা সেই শুরু করা প্রেমপত্র টা আর শেষ করা হয় নি। তার পর কবির লেখা যত পারা যায় খোজা আর পড়া। আমার সাথে কবির পরিচয় সেখান থেকেই আর সেই কবি, কবি রণজিৎ দাশ; আর কবিতার সেই প্রথম লাইনটি "যে নারী সুন্দরী নয়, আমি তার মোহিত প্রেমিক"।  


কবি রণজিৎ দাশ, সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান একজন কবি। জন্ম ১৯৪৯ সালে, আসামের শিলচর শহরে। দেশ ভাগের যন্ত্রণা নিয়ে কবির বাবা বাংলাদেশ (পূর্ববঙ্গ) থেকে আসামে চলে আসন। শৈশব-কৈশোর কেটেছে সেখানেই। কবির ছোট বেলা কেটেছে তীব্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। উদ্বাস্তু হবার ভয় ও তার মানসিক বেদনা সাথে সংসারে প্রতিদিনের খাওয়াপরার লড়াই। চারপাশে ছিল দারিদ্র্য এবং তার সাথে বেঁচে থাকার লড়াই। তেরো-চৌদ্দ বছর বয়স থেকেই কবি লিখতে শুরু করে। কবির চারপাশের যে উৎসব সেগুলোর প্রভাব ( বিশেষ করে বৈষ্ণব পরিবারের কীর্তন গান) তারপর রবীন্দ্রনাথের প্রভাব কবিতাকে আরও ভালবাসতে চালনা করে। কবির স্কুল পাঠ তখনো শেষ হয় নি (শিলচর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল, ক্লাস টেন); ‘অতন্দ্র’ কাব্যান্দোলনের অন্যতম কবি উদয়ন ঘোষ, তখন স্কুলের শিক্ষক হয়ে এলেন। কবি যোগ দিলেন অতন্দ্র কবিগোষ্ঠীর সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হয়ে । আর শুরু হয়ে গেলো কবি জীবন। প্রথম কবিতা যথাসম্ভব 'ছন্নছাড়া'। উচ্চশিক্ষা লাভ ও কবিতা চর্চার জন্য ১৯৭১ সাল থেকে কলকাতাবাসী।  সত্তরের দশকে তিনি তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আমাদের লাজুক কবিতা’ দিয়ে নিজেকে আলাদা করে চিহ্নিত করেন। তার পর চাকরিজীবন,  কিছুদিন আগে চাকরিজীবনের অবসান ঘটেছে। এখন সম্পূর্ণ রূপে কবি কবিতায় নিমজ্জিত।


বাংলা কবিতায় রণজিৎ দাশের ভূমিকা খুব ই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বেশিরভাগ কবিতায় খুব সাধারণ ভাবে ভাবনাদের প্রকাশ করেন যেখানে শব্দ ও বাক্য খুবই সহজ মনে হবে, কিন্তু বিষয় ও ভাবের দিক থেকে এগুলো অনেক উচ্চতায় বিরাজ করে। বিষয় নির্বাচন থেকে শুরু করে প্রকাশভঙ্গীতে যে অন্য রীতি প্রকাশ করেছেন তা পাঠক কুল কে মুগ্ধ করে যায় বার বার। কবির কবিতায় একাধারে তিনি সৎ এবং সাহসী আবার কাব্যময়। অন্তর্দৃষ্টি ও ভাবজগতের কথা ভাবলে বিমোহিত হয়ে থাকতে হয়। তাই অনেক অনেক বিরূপ ক্ষণে কবির কবিতা আমাদের সঙ্গ দিয়ে যায়।


২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার, 'রণজিৎ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা'র জন্যে  'রবীন্দ্র পুরষ্কার -২০১৩'।


বই ঃ রণজিৎ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ঈশ্বরের চোখ, সমুদ্র সংলাপ, ধানক্ষেতে বৃষ্টির কবিতা, শহরে নিস্তব্ধ মেঘ, আরও অনেক।  



কামিনীফুলের গন্ধে -- রণজিৎ দাশ


কামিনীফুলের গন্ধে সত্য আছে, ছলনাও আছে।


প্রবাসে, রাত্রির পথে একা একা, অঝোর বৃষ্টিতে
হেঁটেই চলেছি, কোনো রহস্যগল্পের
সন্দেহজনক এক চরিত্রের মতো। মাঝে মাঝে
পুলিশের টর্চ জ্বলে, ছুটন্ত লরি-র
জলকাদা ছিটকে-ওঠা আলো সরে যায়।
অজস্র বৃষ্টির ফোঁটা বিশাল মেঘের
উড়ন্ত কফিন থেকে লুকোনো মার্বেল হয়ে ঝরে।


বাড়ি ফিরব না আর, এই মর্মে, ঝোড়ো বাতাসের
পথসঙ্গী হয়ে ঘুরি, তোমার ঘুমের চরাচরে।
যে ঘুম কামিনীগাছ- বিদ্যুৎ-জাগ্রত, একা, অন্ধকারে ভগ্নমনোরথ-


রাত্রি যত বাড়ে, তত কামিনীফুলের
উগ্র গন্ধে লুপ্ত হয় পৃথিবীর সমস্ত শপথ।


পানশালা -- রণজিৎ দাশ


কলম এবং ছাইদানির সঙ্গমের ফলে জন্ম নেয় হাতঘড়ি। বিকেলে, বাড়ি ফিরে, আমি টেবিলের ওপর ফুটফুটে হাতঘড়িটিকে দেখি। টিক টিক করে ঘুরছে তার কাঁটা। ঘুরছে একটি বৃত্তের ভিতর, যার পরিধি ঘিরে রয়েছে বারোটি সময়জ্ঞাপক পানশালা। বস্তুত, পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতাই গড়ে উঠেছে একটি মানুষ সন্ধেবেলা পানশালায় যাবে বলে। সেখানে গিয়ে, তোমার আধভাঙা গান এবং নক্ষত্রদের জুয়াখেলার কথা ভাববে বলে।


অনেক রাতে, তার বাড়ি-ফেরার পথে যদি চাঁদ ও কুয়াশা থাকে, তাহলে সে তোমারই পুরুষ...


মদ -- রণজিৎ দাশ


নারীর ভিতরে ডুবে পুরুষটির মৃত্যু হয়েছিল। বালির ওপর ছড়িয়ে আছে তার চশমা, বই ও ব্রিফকেস। সে নেই, কিন্তু একটা পড়ে-থাকা শূন্য কাঁচের বোতলে তার আবছা প্রতিবিম্ব আটকে আছে। সেই প্রতিবিম্ব এখনো হাসছে, হাত নাড়ছে, কথা বলছে, মাঝে-মধ্যে রুমালে মুছে নিচ্ছে চুম্বনসিক্ত ঠোঁট।


আর, অসংখ্য ডুবুরি সেই বোতলের ভিতরে ঢুকে খুঁজে চলেছে তার মৃতদেহ...


মাকড়সা -- রণজিৎ দাশ


বাস্তবতার একমাত্র প্রমাণ স্মৃতি। একটি বৃদ্ধ মাকড়সার স্মৃতি। আমি দেখেছি সেই মাকড়সার জাল- যার মধ্যে আটকে আছে চাঁদ, জেলেনৌকো, কিশোরীদের গানের বই, অজস্র ডাকটিকিট, রঙিন প্লাস্টিকের গ্লোব, মৃত্যু-টেলিগ্রাম। আমি নিজে সেই জালের সরু তারের ওপর দিয়ে হেঁটেছি। হাততালির শব্দ, কাউনের হাসি এবং রোগা সিংহের গর্জন আমার দ্বারাই প্রমাণিত হয়েছে। এরপর আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে সার্কাসতাঁবুর বাইরে, এটাই নিয়ম। সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে দেখেছি, কীভাবে বিহার জুড়ে গ্রীষ্মের লু বয়, কীভাবে ধু ধু করে খুনকান্ত এম.এল.এ-দের নির্বাচনকেন্দ্রগুলি, কীভাবে পর্যটক বাঙালি দম্পত্তিরা আরো পরস্পর-বিচ্ছিন্ন হয়ে শিমুলতলা থেকে ফিরে আসে।


সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে দেখেছি, আমিই সেই বৃদ্ধ মাকড়সা...


ক্ষত -- রণজিৎ দাশ


মহান শিল্পীদের জীবনীতে প্রায়শই পড়ি তাঁদের অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতা কথা। পড়ি, এবং ভীষণ বিভ্রান্তবোধ করি। ভাবি যে, যে-মানুষ ব্যক্তিজীবনে এতটা হৃদয়হীন এবং নির্মম, তাঁর শিল্পের আদৌ কী আমি দেব? যতই মহৎ হোক সেই শিল্পকীর্তি, তবু আমি তার কানাকড়ি মূল্যও দেব কি? পণ্ডিতেরা বলেন, ভুল, এই বিচার ভুল। শিল্পীও একজন মানুষ, আর সব মানুষের মতো তার ভিতরেও রয়েছে একই সঙ্গে সাধু এবং শয়তান। এবং নিজের ভিতরে এই সাধু-শয়তানের দ্বন্দ্ব থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে তার শিল্প। সুতরাং, শিল্পীর ব্যক্তিজীবন দিয়ে তার শিল্পের বিচার এক মারাত্মক ভুল। পণ্ডিতেরা সর্বদাই এত ঠিক কথা বলেন! এত খাঁটি সত্য কথা! এবং সব সত্যই কি অদ্ভুত নির্মম! কোমলতার পক্ষে কি কোনও সত্য নেই? না, কোমলতার পক্ষে কোনও সত্য নেই, শুধু বেদনা রয়েছে। সেই বেদনার কাছে আমি আজীবন গুম হয়ে থাকি। দেখি যে, আমার মনে গোঁজ হয়ে আছে একটিই কঠিন কথা। কথাটা এই যে, শিল্পী হবার তাড়নায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বামী-স্ত্রীতে মিলে সংসার ভেঙে দিয়ে, এবং নিজেদের সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে তার গ্রামের মামাবাড়িতে ফেলে রেখে, প্যারিসে এসে রদ্যাঁর শিষ্য বনে যাওয়ার জন্যে রিলকে-র সমস্ত কবিতা আমার কাছে অস্পৃশ্য মনে হয়; অসুস্থ সঙ্গিনী ফ্রাঁসোয়া জিলো-র গালে জ্বলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়ার জন্যে পিকাসো-র সব ছবি আমি পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিতে পারি। জীবনের অপরাধ ঢাকতে শিল্পের সাফাই হয় না। সেই অপরাধ, সেই আঘাত আরেকটি নীরব প্রাণে যে ক্ষত সৃষ্টি করে, শিল্পীর আজীবনের সকল শিল্পকর্ম দিয়েও সেই ক্ষতটির ক্ষমা হয় না, শুশ্রূষা হয় না। সমস্ত শিল্পের চেয়ে সেই ক্ষতটি বড়।


সমস্ত শিল্পের বিরুদ্ধে, সেই ক্ষতটিই ঈশ্বরের বিষণ্ণ কবিতা...


ঈশ্বরের চোখ  -- রণজিৎ দাশ


আমাদের শরীরের প্রতিটি ফুটোয়
জেগে আছে ঈশ্বরের চোখ


ভিতরে চক্রান্ত, চাঁদ, নিহত বন্ধুর রক্ত, ক্রিমি, কীট, উলঙ্গ রাক্ষস
ভিতরে মুখোশ, জুয়া, নাচ, মদ, বেশ্যাদের হাসি


তিনি দেখছেন, ঠিক যেভাবে বালক তার
পিতৃঘাতকের সঙ্গে নিজের মায়ের
অবৈধ সঙ্গমদৃশ্য দেখে


চোরকাঁটা -- রণজিৎ দাশ


কে মোছে আঁধার রাত্রি? স্টেশনের কৃষ্ণচূড়া গাছ
সবুজ পাতায় আর লাল ফুলে মুছে দেয় আনাচ কানাচ
কালিপড়া লণ্ঠনের, যে লণ্ঠন পঞ্চাশ বছর
জ্বলেছে অবৈধ কামে; নিজের ধোঁয়ায় নিজে অন্ধ, অবান্তর
কে তাকে উজ্জ্বল রাখে, আমার শিয়রে সারারাত?
প্রতিটি সুন্দর দৃশ্য বালিকার কালি মোছা হাত


পার্ক স্ট্রীটের কবিতা - - রণজিৎ দাশ ( কয়েক লাইন)


বাকি সব জমজমাট। হালকা জ্যোৎস্নার নিচে
দুঃখকে সুখ বলে মন হচ্ছে চৌরঙ্গীপাড়ায়-
চাঁদের আজ পার্টি আছে সোনার বাংলায়"


সিনেমা -- রণজিৎ দাশ (কিছু লাইন, এবছর দেশ শারদীয়া)


মৃত্যুর কথা ভাবি সিনেমাহলের কাছে, অদ্ভুত আগ্রহে!


ভাবি যে, কৈশোরে যেমন আমি স্কুলের পরীক্ষা শেষ হওয়ামাত্র
ছুটে যেতাম সিনেমা দেখতে -- সাইকেলে চড়ে,
বার্ধক্যেও তেমনই আমি জীবনের পরীক্ষা শেষ হওয়ামাত্র
ছুটে যাব মৃত্যুর সিনেমা দেখতে -- শববাহী গাড়িটাতে চড়ে!
.
.
.
হটাত একটি দৃশ্যে, যমলোকের পানশালায়
আমার সকল মৃত বন্ধুদের দেখতে পেয়ে, উল্লাসিত হয়ে,
হাত নেড়ে গেয়ে উঠব পৃথিবীরই গান!


মরণ রে, তুহুঁ মম সিনেমা-সমান!


তথ্যসুত্রঃ কবির লেখা কবিতার বই, ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট, বাংলা পত্রিকা।