গদ্যছন্দ কী?
------------------


উত্তর:-
বহু ছন্দেগ্রন্থেও গদ্যছন্দ বা গদ্যকবিতাসম্পর্কে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেখে স্বয়ং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাই।যেমন ধরুন, প্রাজ্ঞ শাফিক আফতাব তার" সহজ ছন্দপাঠ ও আলঙ্কার " গ্রন্থে লিখেছেন -"বাংলা ছন্দকে বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়েছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ছন্দের মুক্তির মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা ছন্দে যেমন অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন করেন তেমনি ছন্দে ব্যক্তিসত্তার দ্রোহের বিষয়টি ও ফুটিয়ে তোলেন।


আবার তিনি অন্যত্র স্ববিরোধী কথাও বলেন --" গদ্য ছন্দের মানে এই নয় যে,গদ্যে ছন্দ থাকবে না। ছন্দ অবশ্যই থাকবে। তবে পদ্য ছন্দে যেমন ছন্দটা বাহির থেকে গ্রাহ্য হয় --- অর্থাৎ প্রস্ফুটিত হয়; গদ্য ছন্দে হয় না "


অমিত্রাক্ষর কাব্যরীতি যে, কোনো ছন্দপদবাচ্যই নয়, সেটা আমি প্রমাণ পেয়েছি উক্ত গ্রন্থ-টিতে । কারণ মাইকেল অক্ষরবৃত্তের অন্ত্যমিলযুক্ত ৮+৬ কাঠামোর পরায়কেই অন্ত্যমিলের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন মাত্র। কিন্তু তা অক্ষরবৃত্তের নিয়মের বাইরে গিয়েছেন কি? বরং এতে ছন্দের কোনো ব্যাপারই নেই। কিন্তু উক্ত গ্রন্থের একই পৃষ্ঠায় আবার তিনি লিখলেন, " তিনি ( মাইকেল)  পয়ারের বন্ধন ভেঙেছিলেন---। তিনি ( রবীন্দ্রনাথ)  আরেক ধাপ এগিয়ে সৃষ্টি করেন মুক্তকছন্দ। এই অমিত্রাক্ষরের প্রবহমান ছন্দের নাম গদ্য ছন্দ।চরণান্তিক মিলহীনতাই গদ্যছন্দের বৈশিষ্ট্য নয়।গদ্যছন্দের বৈচিত্র্য পর্ববিন্যাসে, ছেদ ব্যবহারে ; ভাব ও অর্থনুসারে পংক্তি সৃজনে। শব্দের গাঁথুনিতে অতিরিক্ত ধ্বনিব্যঞ্জনা বর্জনে। চরণান্তিক মিল ছাড়াও শব্দসজ্জায় এমন কৌশল আরোপ করা হয় যে, প্রতি শব্দই আংটার মতো লেগে থাকে এইসব কবিতা পাঠ পদ্যের মতন শোনায়।
তাহলে কী দাঁড়ালো?তার বক্তব্য অনুযায়ী 'অমিত্রাক্ষরের প্রবহমান ছন্দের নাম গদ্যছন্দ, যা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর। অমিত্রাক্ষর -রীতির কবিতা যে, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আওতাধীন,তা নিঃসন্দেহ। কিন্তু শুধু অন্ত্যমিলভেঙে ছন্দের প্রবহমানতা আনলেই কি অমিত্রাক্ষর - কবিতা গদ্যকবিতা হয়ে যায়?  গদ্যকবিতায় তবে কি পয়ারভিত্তিক অক্ষরবৃত্তের ৮+৬,৮+৮, ৮+১০ ইত্যাদির সুনির্দিষ্ট চাল থাকে?আবার  অনেকের মতে,মুক্তক-রীতির কবিতার মতন গদ্যছন্দের কবিতাও কি অক্ষরবৃত্তেরই সন্তান? মুক্তক-কবিতাও যে,গদ্যছন্দবাদে তিনছন্দেরই চালনির্ভর, আমরা তাও প্রমাণ করেছি। অতএব তার বক্তব্য সম্পূর্ণ স্ববিরোধী,অসাড়।


গদ্যছন্দ কি অক্ষরবৃত্তের শাখা?


উত্তর:- আমি বাংলাছন্দকে স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত ও গদ্যছন্দ, এই চারভাগে বিভক্ত অনেকেই আপত্তি করেছেন যে, ছন্দ তিনপ্রকার
এবং গদ্যছন্দ আলাদা ও মৌলিক কোনো ছন্দ নয়। বরং  এটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দেরই একটি শাখামাত্র। কিন্তু আমি তা যৌক্তিক কারণে অস্বীকার করি এবং তাদের প্রশ্ন করি, তাহলে একে গদ্যছন্দ না বলে অক্ষরবৃত্ত ছন্দই বা বলি না কেন?আর এতে অক্ষরবৃত্তের কোনো চাল ও কাঠামোই বা নেই কেনো?আসলে এই ছন্দটি স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত,ও অক্ষরবৃত্তের কোনো বৃত্তেই পড়ে না। অক্ষরবৃত্তে রচিত অমিত্রাক্ষর ও মুক্তকরীতির কবিতার ধারাবাহিকতায় গদ্যকবিতা ও গদ্যছন্দের সৃষ্টি হলেও এই ছন্দে অক্ষরবৃত্ত বা মুক্তককাঠামোর ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। এই গদ্যছন্দের প্রবক্তা স্বয়ং রবিবাবুও যেমন মুক্তক-কবিতা লিখেছেন তেমনই গদ্যছন্দেও কবিতা লিখছেন। তাছাড়া এখন যে কোনো ছন্দের চালে মুক্তকধারায় পদ্যরচনা করা সম্ভব হলেও গদ্যছন্দে কি গদ্যকবিতা ব্যতীত অন্যকোনো ছন্দের পদ্য, ছড়া বা কবিতারচনা করা সম্ভব? গদ্যছন্দে আগের তিনছন্দের কোনো চাইল খুঁজে পাওয়া যায় না বলে একে তিনছন্দের কোনো নিয়মে ফেলা সম্ভব নয়। এজন্যই এটি অক্ষরবৃত্তের শাখা নয় আদৌ।


গদ্যছন্দ একটি সম্পূর্ণ আলাদা ছন্দ
-----------------------------------------------
গদ্যছন্দে পর্ব ও অক্ষর বা মাত্রাসংখ্যা সর্বদাই অসমান। অর্থ্যা এতে ৮+৬ বা ৮+১০ চালের সনেট, পয়ার, মহাপয়ার ও অমিত্রাক্ষরের মতো পঙক্তির মাত্রা ও পর্বসংখ্যা সুনির্দিষ্ট নয়, ফলে পঙক্তিসমতা - অসমতার কোনোই বালাই নেই।
তাই বলে অমিল- মুক্তক মানেই গদ্যকবিতা নয়,যা অনেকেই মনে করেন। অন্ত্যমিলবিহীনতাও গদ্যছন্দের মূলবিষয় নয়। গদ্যকবিতা গদ্যকবিতাই, বা গদ্যছন্দে লেখা হয়।
এটি প্রচলিত তিনছন্দের বাইরে সম্পূর্ণ স্বাধীন এক ছন্দ। আগেই বলেছি, এই ছন্দে সুনির্দিষ্ট মাত্রা ও পর্ববিন্যাস, সুনির্দিষ্ট তিনটি লয়ের বাধ্যবাধকতা, পঙক্তিসমতা, অন্ত্যমিলসহ প্রচলিত তিনছন্দের কোনো নিয়মই খাটে না।
এমনকি এতে পদ্যে বহুলব্যবহৃত বিশেষ বিশেষ কাব্যিক শব্দের ব্যবহারও নিষিদ্ধ। আর এইজন্য এটি 'গদ্যছন্দ ' হিসাবে নতুন একটি ছন্দের দাবিদার। অনেকেই বলেন গদ্যকবিতায় নাকি ছন্দমুক্তি ঘটেছে! আসলে কথাটা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর, মূর্খতাব্যঞ্জক ও মিথ্যাচার। ছন্দমুক্তি  ঘটলে কি পদ্য বলে কিছু থাকে?তখন তা কবিতা না হয়ে স্রেফ গদ্যই হয়ে যায় কি না?


বাকি অংশ  পরের পোস্টে দেখুন।