আমি নারী


আমি সেই নারী-  
যা’র জন্ম লগ্নে বাজে’নি কোনো মঙ্গল শঙ্খ ধ্বনি,
পড়েনি কোনো উলুধ্বনি।
শুধুমাত্র কন্যা সন্তানের জন্মদাত্রী হওয়ার অপরাধে-
পরিবার পরিজন সমাজ সেই জন্মদাত্রী মা'কে-
ভূষিত করেছিল একজন শাপভ্রষ্টা নারী বলে।
আর সেই অভাগিনী মা-
সমস্ত গঞ্জনাকে বুকে চেপে ধরে-
পরম মমতায় লালন করেছিল তার সৃষ্টিকে।
আর দু'চোখে স্বপ্ন দেখেছিল সে-
অ’গৌরবের কাল-রাত্রির অবসানের -
গৌরবের নতুন ভোরের।


আমি সেই নারী-
যাকে জন্ম থেকেই -
জীবন-যুদ্ধের মোকাবিলায় করতে হয়েছে-
নানা বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক অসম লড়াই।
বৈষম্যের সুউচ্চ প্রাচীর -
তার দুর্নিবার গতিকে অবরুদ্ধ করবার -
চেষ্টা করেছে বারংবার ।
নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যাকে প্রতিনিয়ত করতে হয়েছে-
বৈষম্যের সাথে এক আপোষহীন সংগ্রাম।
আর এই যুদ্ধে বারংবার তাকে পড়তে হয়েছে-
ক্ষমতা-ভোগীদের রোষানলে।
এমনকি যারা তার শিক্ষক,
নতুন সমাজ গড়াই যাদের একমাত্র অঙ্গীকার ,
যারা নব-যুগের পথপ্রদর্শক ,
তারও পরিয়ে দিয়েছিল তাকে এক প্রতিবাদী তকমা।
তাদের হাতেই হতে  হয়েছিল তাকে বিভেদ আর বৈষম্যের বলি।
গোয়েবেলের থিওরি প্রয়োগ করে তারা-
প্রতি মুহূর্তে ওর মনোবল গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।
ওর মনে এই ধারণা বদ্ধ-মূল করে দিতে চেয়েছিল-
'তুমি যোগ্য নও'- 'সফলতা তোমার জন্য নয়'-
তুমি একজন ব্যর্থ-
একজন ব্যর্থ সামান্য নারী মাত্র।
এই তোমার একমাত্র পরিচয়।


আর এখানেই ওর প্রতিবাদী সত্ত্বা আরও দৃঢ় হয়ে উঠল।
ওদের সব ভবিষ্যদ্বাণী’কে ভুল প্রমাণিত করবার জন্য -
ওর ঘুমন্ত সত্ত্বা সেদিন-
অদম্য ইচ্ছা শক্তি হয়ে গর্জে উঠল।
আর একটির পর একটি সফলতার সিঁড়ি -
অতিক্রম করে আজ সে প্রতিষ্ঠিত জীবনে।
আর তাদের স্নেহধন্য ছিল যারা
আজ কোথায় হারিয়ে গেছে তারা।


আমি সেই নারী -
কখনও বা মাতৃরূপে-
আত্মজ’কে পরম স্নেহ করেছি লালন।
কখনও বা কন্যা রূপে হয়েছি-
বাবা- মায়ে'র স্নেহধন্যা।
কখনও বা স্ত্রী রূপে-
হয়েছি স্বামী সোহাগিনি।
আবার কখনও বা হয়েছি -
আমি নির্ভয়া- কামদুনি।
আর যুগে- যুগে এই নির্ভয়া কামদুনির নারী সত্ত্বা,
তোমাদের কংস-বাহিনীর লালসার লেলিহান শিখায়-
হয়েছে ধর্ষিতা !


আমি সেই নারী -
পরিবার-সমাজ-সকলের খুশিই, যার একমাত্র খুশি।
সকলের ভালো মন্দই, যার এক-মাত্র ভালো মন্দ।
শুধুমাত্র নিজের ভালো-মন্দ -
কখনো পায়'নি তার জীবনে প্রাধান্য।
যা’র লড়াই ছিল আ-জীবন আপোষহীন।
সত্য, ন্যায় আর নিষ্ঠার প্রতিষ্ঠার জন্য।


আমি সেই নারী -
যা’র বলিষ্ঠ চিন্তা, আত্ম-নির্ভরতা থাকা সত্ত্বেও -
আজ এক-বিংশ শতাব্দীতে তা’কে দাঁড়াতে হয়-
স্বামী নামক এক দণ্ড-ধারী বিচারকের কাঠগড়ায়।
সীতার মতন অগ্নি-পরীক্ষায়,
নিজেকে ভস্মীভূত ক’রে-
চারিত্রিক বিশুদ্ধতা প্রমাণের অপেক্ষায়।


আর স্বামী !
সে তো রামচন্দ্র !
তার তো থাকতে পারে না কোনো কলঙ্ক !
সে তো সোনার আংটি !
হোক্ না বাঁকা !
তবুও, তো সে সোনা !
তাই তার বিশুদ্ধতায় কোনো প্রশ্ন-চিহ্ন চলবে না !


তাই আজ, আমি সেই নারী -
যা'কে তার স্বামী ইচ্ছে মতো গায়ে হাত তুলতে পারে!
ইচ্ছে মতো কুৎসিত ভাষা ব্যবহার করতে পারে !
স্ত্রীর মান-সম্মান রক্ষার পরিবর্তে -
ইচ্ছে-মতোন তার স্ত্রী'র মান সম্ভ্রমকে-
হাজার জনতার দরবারে বেয়াব্রু করতে পারে !
আর এ'সবের জন্য কোনো বিচার পেতে হয়না তাকে !
বিচারের ন্যায়দণ্ড, যে তারই হাতে !


আজ এক-বিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে-
আমরা নারী-দিবস পালন করি !
অনেক-অনেক নারী-বাদী কথা বলি !
নারী-স্বাধীনতার কথা বলি !
নারী-মুক্তির কথা বলি !
নারী পুরুষের সম-অধিকারের কথা বলি !
কিন্তু, আজও কি আমরা পেরেছি ?
এক বৈষম্য-হীন সমাজ গড়তে !
আজও কি আমরা পেরেছি ?
সেই মধ্য-যুগীয় বর্বরতার অবসান ঘটিয়ে-
নারী'কে তার প্রগতির দিশা দেখাতে !
নারী'কে তার যোগ্য সম্মান ফিরিয়ে দিতে !