রচনা-শ্মশানে এক পুর্নিমার রাত !!


মাঘ মাসের পুর্নিমাকে বলা হয় মাঘী- পুর্নিমা। ০৯-০২-২০২০ তারিখ  ছিল মাঘী-পূর্নিমা। আগেই ভেবেছিলাম আবার একা জোছনা রাত উপভোগ করবো। অনেক জায়গায়ই জোছনা উপভোগ করেছি, এবার কোথায় যাই।  ভাবলাম এবার একটু ব্যাতিক্রমি জায়গায় যাব। মনে স্থির করলাম এবার যাব  শ্মশান ঘাটে।  জোছনা উপভোগ করার জন্য শ্মশান ঘাটে কেন যাবো, সে প্রশ্ন অনেকেরই থাকতে পারে। তাদের কাছে আমার উত্তর হলো- আমি একটু বাস্তবাদী মানুষ। কৈশোর থেকেই ইন্দ্রিয়- অতিন্দ্রীয়, শরীরি -অশরীরি, আত্মা- প্রেতাত্মা, ঘুমের দেশ- পরীর দেশ, এসব লৌকিক- অলৌকিক ও রোমাঞ্চকর বিষয়ে আমার কিউরিসিটি রয়েই গেছে। এসবে আমার যদিও বিশ্বাস খুবই কম, তবুও রোমাঞ্চকর বিষয়ে যুক্ত হয়ে সত্যি প্রকাশের জন্য আমি চেষ্টা করে থাকি এদের দেখা ও স্পর্শ পাওয়ার।


ঠিক করলম, এবার যাবো ইছামতি নদীর তীরে অবস্থিত গোবিন্দপুর শশান ঘাটটিতে পুর্নিমা জোছনা উপভোগ করার জন্য । দিনের বেলা শ্মশান ঘাটটা একটু দেখা দরকার। তাই দুপুরের দিকে শ্মশান কমিটির সেক্রেটারীর সাথে দেখা করে বিষয়টা তাকে জানিয়ে এলাম । শ্মশানটি দেখলাম পরিস্কার পরিচ্ছন্নই আছে। নিরালা নির্জন গোবিন্দপুর শ্মশান ঘাট। তবে ঘৃতাগ্নী আর চন্দন কাঠের পোড়া গন্ধ নাকে এলো। শুনলাম কয়েকদিন আগে এখানে এক ধনী ঘরের এক মহিলাকে চন্দন কাঠ ও ঘৃতাগ্নি দিয়ে দাহ করা হয়েছে। এই গন্ধ তারই। এই গন্ধেই মনে পরে গেলো ১৯৭১ সালে এক রাতের কথা। ভারত থেকে গেরিলা ট্রেনিং শেষ করে যশোরের ইটনা নামক স্থানের ঘন বাঁশবাগানের কাছে এরূপ একটি শ্মশানে আমারা মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ মনে করে এক রাত  ছিলাম। তখনো নাকে আসছিলো সদ্য পোড়া গন্ধ। সেই রাত অবশ্য পুর্নিমার রাত ছিলো না। তীথি জানিনা, তবে কৃষ্ণপক্ষের ঘোর রাত ছিলো।


একটু পরে ঘরে চলে এলাম। যাবার জন্য রাত নয়টায় প্রস্তুতি শুরু হলো। শীতকাল, তাই একটা জিন্স প্যান্ট পড়লাম, দুটা মোটা গেঞ্জির উপর  সোয়েটোর, জ্যাকেট, গলায় মাফলার, মাথায় মোটা টুপি, একটা বড় চাদর নিলাম। বসার জন্য একটা বেতের মোড়াও সাথে নিলাম। তারপর জলিল এর ব্যাটারি চালিত রিকশা নিয়ে রাত দশটায় এলাম শ্মশান ঘাটে। জলিল রিকশা চালায়,  আমার পূর্ব পরিচিত। জলিলকে বিদায় দিলাম। তবে তাকে বললাম, রাত তিনটার দিকে আমি মোবাইলে ফোন দেব, তখন যেন সে রিকশা নিয়ে আমাকে নিতে আসে।
জলিল বললো, মানুষ পোড়া বোটকা গন্ধ আসছে। স্যার, এই বোটকা গন্ধের মধ্যে একা থাকবেন কি করে?? আমি বললাম, কোথায় বোটকা গন্ধ? এ গন্ধতো চন্দন কাঠ আর ঘৃতাগ্নীর গন্ধ, ভালই লাগছে।
জলিল বললো, স্যার, ভয় পেতে পারেন, তাই আমিও আপনার সাথে থেকে যাই। আমি বললাম- আমার ভয় নাই, ভয় পাবোনা, তুই চলে যা, খামাকা থাকবি কি জন্য। আমার রাতে একা থাকার অভিজ্ঞতা  আছে।  
তারপরেও জলিল বললো, এটা শ্মশানঘাট, অনেকেই রাতে এখানে মরা মানুষ হাটতে দেখেছে।
আমি বললাম, দুর বোঁকা, এসব গাঁজাখুরী বানানো কথা।
জলিল বললো - সাবধানে থাকবেন, যখনই ফোন দেবেন, আমি চলে আসবো।
ঠিক আছে এবার চলে যা।
জলিল চলে গেলো। আমি জানি, জলিল ঠিক সময়ে অবশ্যই আসবে, কারণ ওকে সন্তুোষ্ট করেই আমি টাকা দেই।
আমি শ্মশান ঘাটের নদীর দিকে একটু বেশি ফাঁকা জায়গায় মোড়াটি পেতে বসলাম। পায়ে মোটা মোজা ও কেটস্ পড়েছি, সব কাপড় ও মাথায় উলের টুপি আছে, মশায় কামড়াতে পারবে না। এবার মোটা চাদর দিয়ে ভালো করে পেঁচিয়ে মোড়ার উপর বসলাম।


ভরা পূর্নিমার রাত, আকাশ পরিস্কার, কোনো মেঘ নেই। অপূর্ব মন মাতানো জ্যোৎস্নার রূপ রাতের পৃথিবীতে যে কিরূপ  সৌন্দর্যের ঐশ্বর্যময় সমারোহ ঘটতে পারে তা আরেকবার প্রমাণিত হলো। আমি আকাশে চন্দ্রোলোকিত রাতের শোভা দেখেতে লাগলাম মুগ্ধনয়নে। সৌন্দর্যের মাদকতা আমি অবলোকন করতে লাগলাম।

পৃথিবীতে এমন লোক হয়ত খুবই কম পাওয়া যাবে, যে ঘোর অন্ধকারে ভয় পায় না। একাকী ঘোর অন্ধকার সবারই মনকে দুর্বল করে দেয়, বয়ে আনে ভয়ংকর ইন্দ্রিয়-অতিন্দ্রীয়, শরীরি- অশরীরি, আত্মা -প্রেতাত্মা, ঘুমের দেশ -পরীর দেশ এসব অলৌকিক রহস্যের শিহরণ। যতক্ষণ ঘরে আলো থাকে ততক্ষণ মানুষ কোনো কিছুকেই ভয় পায় না। কিন্তু ঘর অন্ধকার হলে বা রাতে ঘুম না আসলে একাকী অজানা এক ভয় প্রায় সবাইকে গ্রাস করে।
আমার কিন্তু আজও তেমন হচ্ছে না।


আমি জ্যোৎস্নার মোহনীয় রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আজ রাতে মাঘী পূর্নিমার জ্যোৎস্নার রূপ- মাধুরী নিজ চোখে অবলোকন করা সে এক অপরূপ রাত, অপরূপ রূপময় জ্যোৎস্না ঝরা রাত। আমি চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় অভিভূত। ঝিরঝিরে স্নিগ্ধ ঠান্ডা বাতাস বইছে।  মনে হলো- স্বচ্ছ রূপালি ঝরনার মত চাঁদের আলো চারপাশ ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে।


আকাশে বিন্দুমাত্র মেঘ নেই। সারা আকাশ জুড়ে কেবল কিছু তারা মিটিমিটি জ্বলছে চাঁদের সাথী হয়ে। চাঁদের আলোর বন্যায় রাতকে মনে হচ্ছে, যেন এক মায়াবী দিন। চাঁদ যতই উপরে উঠছে ততই বাড়ছে তার উজ্জ্বলতা। বাড়ছে সেই মায়াবী রাতের সৌন্দর্য।


চারিদিক নিস্তব্ধ, নিঝুম। হঠাৎ শো করে একটা অসাধারণ দমকা বাতাস আমার পাশ দিয়ে চলে গেলো, সামনের গাছগুলি দেখলাম নুইয়ে পরে আবার সোজা হয়ে গেলো। পাতার মধ্য থেকে আজগুবি একটা শব্দ হলো কিছুক্ষণ। তারপর আবার সব নিস্তব্ধ। কেমন যেন একটু চমকে গেলাম।


আমি চুপচাপ বসেই রইলাম। সব পাখপাখালি তাদের নীড়ে ঘুমাচ্ছে। এখন কোথাও পাতা নড়ার শব্দও নেই। যেন সম্পূর্ণ প্রকৃতি ঘুমে আচ্ছন্ন, খালি জেগে আছে আকাশের বিশাল উজ্জ্বল চাঁদটা আর তার সাথী তাঁরা-নক্ষত্র । অনেক দুরের গাছপালাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে জ্যোৎস্নায়। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় সবকিছু কেমন যেন বেশী মায়াবী দেখাচ্ছিল। চারপাশে জ্যোৎস্নার সমুদ্র বয়ে যাচ্ছে।


ঘড়িতে তখন রাত বারোটা এক মিনিট। হঠাৎ করে অনেকগুলো রাতজাগা পাখি ডেকে উঠলো। আবার কিছুটা চমকে উঠলাম। তারপর সব নীরব, শান্ত। একটা সিগারেট ধরালাম। বলে রাখা ভালো যে, সিগারেটে আমার নেশা নেই, নিয়মিত খাইনা, কিন্তু আজ এক প্যাকেট এনেছি, এরূপ নীরব জোছনা রাতে আমার সিগারেট টানতে ভালোই লাগে, মাদগতা আছে। এখন আর সরাব চলেনা, ডাক্তারের নিষেধ। সিগারেটে টান দিতেই কেমন যেন মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। হঠাৎ কয়েকটা কাক মাথার  উপর দিয়ে ভৌতিক কা-কা রবে উড়ে গেলো। এবারও একটু চমকে উঠলাম, ভাবলাম- এতো রাতে কাক উড়ছে কেন? তখন বাবার কথা মনে পরে গেলে সান্তনা পেলাম। ছোটবেলায় বাবা একবার বলেছিলেন, জোছনা রাতে জোছনার তীব্র আলো দেখে অনেক সময় কিছু কাক মনে করে ভোর হয়ে গেছে, তাই তারা বাসা থেকে বেড়িয়ে পরে খাবার সন্ধানে। ভাবলাম, এই কাকগুলিও আজকের মাঘী পূর্নিমার এই স্বচ্ছ জোছনাকে সকাল হয়েছে ভেবে উড়ে বেড়াচ্ছে। দেখলাম বাদুড় ও রাতজাগা পাখিরা উড়ে বেড়াচ্ছে।


এবার আমার পিছনের দিকে মানুষের হাটার নিচু শব্দ অনুভব হলো, মনে হচ্ছে, কেউ আমার পিছন দিয়ে হেটে যাচ্ছে। আমি ঘাড় বেকিয়ে পিছন দিকে তাকালাম। না কোন মানুষ নেই। ভাবলাম এসব বিকার ও মনের ভ্রম। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা করে সামনের দিকে তাকাতেই দেখলাম- সামনের একটু দুরে কে যেন বসে আছে সাদা কাপড় জড়িয়ে।  মনে হলো সে একটি মেয়ে। সে আমার দিকে তাকিয়ে মিচকী মিচকী হাসছে। ভালো করে লক্ষ্য করলাম এবং  তাকে অনেক দিন আগে দেখা ও চেনা নীলাদ্রি বলে মনে হলো। আমার সারা শরীরের মধ্যে একটি ঝাঁকানি খেলো, শরীরের পশম খাড়া হয়ে গেলো। আমি একটু সোজা হয়ে বসে চোখে পলক দিলাম, চোখের পলকেই দেখলাম ওই মেয়েটি আর নেই। জায়গাটি পরিস্কার এবং খালি। আমি ভাবলাম সবই আমার মনের ভ্রম।
কিছুক্ষণ পর আবার একটি সিগারেট ধরালাম। দেখতে লাগলাম- কিছু দুরে কতগুলি ইঁদুর দৌড়াচ্ছে ও কিচিরমিচির করছে। পায়ের কাছ দিয়ে কয়েকটা সাপ আস্তে চলে গেলো।


আমি আকাশের দিকে তাকালাম। আকাশে উজ্জ্বল আলোময় ঝলমলে চাঁদ, চারপাশে তারই প্রভাবে অপূর্ব সৌন্দর্যময় পৃথিবী আমাকে আপ্লুত করে তুলল। মনে হলো, কবি-শিল্পীরা এই জন্যেই এমন জ্যোৎস্না রাতে কবিতা লিখেছেন, গান গেয়েছেন।
মনে হতে লাগলো, ওইতো ডানাওয়ালা পরীরা জ্যোৎস্না-সমুদ্রে ভেসে বেড়াচ্ছি।


আবারও পিছনে মৃদু পায়ে কারো হাটার  শব্দ কানে এলো। কিন্তু আমি এবার ঘাড় ঘোড়ালাম না, চুপচাপ বসেই থাকলাম। আর বসে বসেই দেখলাম আমার চোখের সামনে দিয়েই এবার সেই সাদা কাপড় পরিহিত নিলাদ্রি হেটে যাচ্ছে। আমি কথা বলার জন্য তাকে ডাকতে লাগলাম। বললাম, এইযে শোনো, একা একা এই রাতে কোথায় যাচ্ছ, তুমি কি নিলাদ্রি? কিন্তু আমার কথা স্পষ্ট বের হলোনা এবং সেও দাড়ালো না। হন্ হন্ করে চলেই গেল। আমি একটু চিন্তা করতে লাগলাম। হঠাৎ কে যেন আমাকে মাথায় এক ধাক্কা দিয়ে মোড়া থেকে নিচে ফেলে দিলো। আমি উঠে বসে চারিদিকে তাকালাম, কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না। ভাবলাম, ঠিক আছিতো ? হাত দিয়ে শরীরে চিমটি কাটলাম এবং ব্যথাও পেলাম। ভাবলাম, নাহ্ ঠিক আছি, কোন অসুবিধা নাই। সবই ভ্রম।  
ঘড়ির দিকে তাকালাম, রাত দুইটা বেঁজে গেছে অনেক আগেই। আমি আকাশে তাকিয়ে আছি।


কিছুক্ষন পর আবার মনে হলো, পিছন দিক দিয়ে কয়েকজন মানুষ কথা বলতে বলতে হেটে যাচ্ছে, তাদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম, কিন্তু কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। পিছনের ঝোপে খসখসে আওয়াজ শুনতে পেলাম। এবার দেখলাম ধুতি পরিহিত একজন মানুষ আমার দিকে হেটে আসছে।  লক্ষ করলাম, তার ঘারের উপরে মাথাটি নেই। কেঁপে উঠলাম এবং চোখে পলক ফেললাম, এবার কিছুই দেখতে পেলাম না। মনকে বুঁঝ্ দিলাম, সব ভ্রম, ভয় পাবার কিছু নেই। একটু ঘুম ঘুম লাগছে, চোখ বুঁজে আসতে চাচ্ছে। তবুও আমি জোর করে সামনের আকাশেই তাকিয়ে থাকলাম। ভরা পুর্নিমার আকাশে তাকিয়ে আছি। সোনালী চাঁদের আলো। দেখছি, কয়েকজন পরী ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। দেখছি, আরো অনেক পরী আসছে, সাদা পরী, নীল পরী, আরো কত রংবেরঙের পোশাক পরে কতশত পরীরা উড়ছে,  একেবারে আমার চোখের খুব কাছাকাছি উড়ছে। দেখলাম, এবার তারা আমার কাছে আসছে, আমার হাত ধরে আমাকে আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমি উড়ছি আকাশ থেকে মহাকাশে। সেখানেও পুর্নিমার আলো। একসময় কি কারণে যেন আমি মহাকাশ থেকে নিচের দিকে পরে যাচ্ছিলাম। সেই সময় একজন পরী এসে আমার হাত ধরলো। আমি কানে শুনলাম জলিলের কন্ঠ, চোখ মেলে দেখলাম,  তার হাত আমাকে ধরে আছে। ঘড়ির দিকে চোখ পড়লো, দেখলাম তখন ভোর চারটা চল্লিশ মিনিট হয়েছে।
জলিল জলিল বললো, রাত তিনটায় আমার ফোন না পেয়ে অপেক্ষা করতে করতে এখন জলিলের স্ত্রীর পরামর্শে রিকশা নিয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছ।
জলিল আমাকে বললো, স্যার আপনার কোনো সমস্যা হয়েছিল নাকি? ইস্ কি গন্ধ আসছে, এখানে আপনি রাতে একা থাকলেন কি করে। ফোন দেননি কেন?  আপনার কি হয়েছিল??
আমি বললাম- আরে না না,  কিছুই হয়নি,  শ্মশানে একটু ঘুমুতে ইচ্ছে হলো, তাই ঘুমিয়ে নিলাম। জলিল আমার মুখের দিকে বিস্ময়ে হাঁ-করে তাকিয়ে রইলো।