বিশ্বব্যাংক যেখানে নিম্নবিত্তের শেষ রেখার গ্রাফ টেনেছে
সেই রেখার শেষ সীমা আমার দাদা চাঁদপুরে কোনো মতে ছুঁইয়ে দিয়ে গেছেন।


আমার বাবা নিম্ন-মধ্যবিত্ত রেখার শুরুর লাইনে অনেক বছর দাঁড়িয়ে ছিলেন,
সেই সময় আমাদের ডেমরার নতুন বাড়িতে মাত্র একতলা বাড়ি হয়েছে-
বাবার সব জমানো টাকা, প্রভিডেন্ট ফান্ড,
ধার-দেনা আর মায়ের গয়না বিক্রির বাড়ি।


পুরো বাড়ির অনেক ঘরই ছিলো আস্তরহীন।
তখনই আমার বাবা মা নিম্ন-মধ্যবিত্ত রেখার শুরুর গ্রাফ থেকে জানপ্রাণ দিয়ে দৌড়াতে শুরু করলেন-
সারাদিন অফিস,তারপর টিউশনি, একসময় ছোট ব্যবসা।
এই করেই নিম্ন- মধ্যবিত্ত গ্রাফের শেষ সীমায় পৌঁছে মধ্যবিত্ত শুরুর গ্রাফ ছোঁয়ার  জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে বাবা-মা দু’জনের বুকের পাঁজর ভেঙে যাবার দশা।


সেই সময় বাস থেকে নেমে বাসায় হেঁটে আসতে বিশ মিনিট লাগত,
রিকশায় পাঁচ মিনিট।
খুব কমই উঠতাম রিকশায়,
কাউকে বুঝতে দিতাম না
টাকা বাঁচানোর জন্য আমরা সবাই হেঁটেই আসা যাওয়া করতাম।


নতুন বাড়িতে উঠে প্রথমেই আমার মা একটা কামিনী ফুলগাছ লাগলো,
কামিনী গাছটা বড় হতে হতে আমাদের বাড়ির  সব ঘরে‌ই আস্তর লাগলো।
প্রথম যেদিন কামিনী গাছটা সাদা ফুলে ভরে গেল,
সেদিন সারা বাড়ির বাতাসে নেশা ধরা এক গন্ধে আমার মাথা ধরে গেল!
আমি ঠিকই দেখেছিলাম সেদিন আমার মা খুশিতে লুকিয়ে গুণগুণ করে গান গেয়েছিল,
অথচ আমি না দেখার ভান করেছিলাম।


সারারাত কামিনী ফুল মাটিতে ঝরে পড়ত,
ভোরবেলা মনে হতো অলস সাদা মেঘ মাটিতে বিশ্রাম নিচ্ছে!
কামিনী ফুলের গন্ধে আমার এই মাথা ধরার গোপন কথা
আমি ভুলেও কখনো কাউকে জানতে দেইনি।


মধ্যবিত্ত শুরুর গ্রাফ ছুঁয়ে দিতে দিতেই আমার বাবা-মা চিরদিনের জন্য বিশ্রামে চলে গেলেন,
আর আমরা ছুঁয়ে দিলাম বিশ্বব্যাংকের আঁকা মধ্যবিত্তের গ্রাফ
এখন আমরা বাবার মতো দৌড়াচ্ছি উচ্চবিত্তের শুরুর গ্রাফ ছোঁয়ার জন্য।


আমি এখন মাঝে মাঝে ডেমরার বাসায় যাই নিজের গাড়িতে চড়ে,
ভাড়া দেওয়া সেই বাড়িতে এখন আর কোনো কামিনী ফুল গাছ নেই।
তবুও আমি ডেমরার বাড়ির সীমানায় ঢুকলেই
কামিনী ফুলের গন্ধ নাকে ভেসে আসে।
মাথা ধরার বদলে এখন মাথায় ঘুরে শুধু
বাবা -মা’র ভেঙে যাওয়া বুকের পাঁজর।


এখন রাতে স্বপ্নের মাঝে প্রায়ই ডেমড়ার সেই বাস স্টপেজ থেকে নেমে
আমি হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরি।
সেই আস্তরহীন ঘরে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি
অসংখ্য কামিনী ফুল মাটিতে ঝরে পড়ছে অলস মেঘের মতো।
—————————
র শি দ  হা রু ন
২৪/০১/২০২৩