ছেলেবেলা আমরা খুব গরিব ছিলাম বলা যাবেনা,
তবে তিনবেলা পেট ভরে সবাই খেতে পারতাম না,
রোজকার খাবারে সংসারের কারো পেটই ঠিকমতো  ভরতো কিনা জানিনা।
আমার পেট ভরে খাওয়া হয়নি কখনোই ছেলেবেলায়।


জামা কাপড়ের অভাব ছিল না,
বড় ভাই বোনদের  শরীরে কাপড় যখন ছোট হয়ে যেতো তাদের শরীরের তুলনায়
তখনই আমাদের ছোট ভাইবোনরা পেতাম বড়দেরটা।


মাকে দুই শাড়িতেই দেখেছি অনেককাল,
মায়ের চেহারা মনে পড়লে
একই রঙের সেই দুই শাড়িতেই তার শরীরে  আমাদের সব অভাব অভিযোগ পেঁচিয়ে থাকতেই দেখি।
বাবার সব কাপড়ই দেখতে একরকম লাগতো,
জরাজীর্ণ চেহারা আর কাপড় এক হয়ে যেত শরীরে।


থাকার জন্য ভাড়ার ঘরে কামরা ছিল দেড়টা,
বাবা মার সাথে চৌকিতে ছোট দুই ভাইবোন থাকতো
আমরা বাকী তিনজন রাত কাটাতাম মাটিতে মাদুর পেতে।
মেহমান এলে তিনজনের জায়গায় ছয় সাতজনও হয়ে যেতো,
পাকের ঘরেও থেকেছি অনেকদিন।


ছেলেবেলা পার করে যখন কৈশোরে পড়েছি
তখন কোনো একদিন ‘বিশ্বব্যাংক’ নামক এক জ্ঞানী দয়াময় স্বপ্নের মাঝে আমার কানে কানে বললো,
“মন খারাপ করবে না,
তোমরা গরিব না ,
তোমাদেরও বিত্ত আছে গর্ব করার মতো,
তোমরা নিজেদের নিম্নবিত্ত ভাবতে পারো।”
তোমাদের নামে মাত্র সামান্য কিছু দেনা আছে আমার কাছে,
এটা তেমন কিছুই না।


সেদিন স্বপ্ন ভেঙে যাবার পর খুশিতে আমার মন ভরে উঠেছিল,
অন্তত আমাদের কিছুটা হলেও বিত্ত আছে,
হোক তা নিম্ন।


তারপর যতই দিন যায়
শুধু নাই নাই শুনতে শুনতে
আমাদের মন  ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে থাকে।


আমার চোখের সামনে ছয় ফুট লম্বা কেরানী বাবা বছরের পর বছর
সংসারে এই ‘নাই’ নামক অদৃশ্য শত্রুর সাথে যুদ্ধ করতে করতে
কুঁজো হয়ে মাটির সাথে মিশে যাচ্ছিল।
বাবা যদি আর কয়েক বছর  বেঁচে থাকতেন তাহলে জীবিত ‌অবস্থাতেই নির্ঘাত মাটির ধুলো হয়ে যেতেন।
বাবা মারা যাবার পর আমাদের নিম্ন এই  বিত্ত ধরে রাখার জন্য
আমরা আরো অসহনীয় কষ্টে পড়ে গেলাম।


দিন যতই সামনে এগোয়
কষ্ট শুধু বাড়ে আর বাড়ে -
সেকি কষ্ট!
সবার কাছ থেকে  যতই কষ্ট লুকাই
ততই ডানা ঝাপটা দিয়ে কষ্ট সবাইকে জানিয়ে  দেয়,
আমাদের শেষ ‌অহং নিম্ন বিত্ত বলেও আর কিছুই অবশিষ্ট নাই ।


খাবারের কষ্ট ,
কাপড়ের কষ্ট,
সময়মতো ঘর ভাড়া দিতে না পারার ‌অপমানের কষ্ট,
শীতের কষ্ট,
রোদের কষ্ট,
বৃষ্টির জলের কষ্ট-
সব কষ্ট একসাথে বুকে পাথর চাপা দিয়ে বলতে বাধ্য করেছে
“ আমরা দরিদ্র!”।


যৌবনে আচমকা একদিন জাতিসংঘ, আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল নামক মহামান্যগণ গায়েবি আওয়াজে আমাকে কড়া ধমক দিয়ে জানিয়ে দিলো,
বিশ্বব্যাংক যা বলেছে তা যেন মেনে চলি।
নিজেকে আর কখনো দরিদ্র বলা যাবেনা,
একটা বিশেষণ লাগিয়ে বলতে হবে নিম্মবিত্ত।
তা না হলে সবাই একযোগে আমাকে নিঃস্ব বলে ঘোষণা করবে।


তাদের কোন কথা আর ধমকে আমার মন  মানলো না,
আমি অসহায় হয়ে
আমার মানচিত্রের কাছেই নালিশ দিলাম।
“এই যে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বছরের পর বছরে-
খালি পেট আর আধা পেটে দিন পার করে
শরীর কঙ্কালের কাছাকাছি চলে যাওয়া,
কাপড়ের কষ্টে লজ্জা শরম কমে যাওয়া,
যৌবন চলে যায় তবুও সংসার শুরু করতে না পেরে
প্রতিদিন যৌবনের বিষাদের ‌অভিশাপে আমি অভিশপ্ত হওয়া,
এই সব কিসের আলামত?


মানচিত্র আপনিই বলুন
আমি কি
নিম্মবিত্ত
দরিদ্র
না নিঃস্ব?


মানচিত্র আপনাকে আজ চিৎকার করে বলে যেতে চাই,
“আসলে আমি এসবের কিছুই নই।
আমি অর্থনৈতিক পরাধীনতার কারাগারে বন্দি।
আমার শরীরের প্রতিটি লোমকুপ
‘বিশ্বব্যাংক,জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের অদৃশ্য লোহার শিকলে আটকানো”।


‘প্রিয় মানচিত্র’
“আপনি কখন যে আমার আত্মা বিশ্বব্যাংক,জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের  কাছে বন্ধক দিয়েছেন
আমি টেরও পাইনি।
আমি আসলে পরাধীন আর আত্মাহীন একই মুদ্রার উভয় পিঠ”।


ক্ষুধার কষ্টে আমার বুকের হাড়গোড়
পিঠের সাথে লাগার আগেই
আজকাল আমার ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে বাতাসে ধারালো তলোয়ারের মতো শিষ বাজিয়ে ওঠে,
আর বুক থেকে ক্ষীণ শব্দে মুখ দিয়ে তীব্র চিৎকারে বলে ওঠে-
“এটা কি মানুষের জীবন,
এভাবে বেঁচে থাকার কোন মানে নেই!”


“প্রিয় মানচিত্র
আমার মতো আপনি দয়া করে
ভুলেও ‘বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘ, আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল নামক মহামান্যগণদের গায়বী আওয়াজ আর বিশ্বাস করবেন না,
উনারা মিথ্যে কথার তাবিজের মহাজন।


যদি আর কিছুদিন এভাবেই যায়
তবে
একদিন আপনারও বুকের হাড়গোড় পিঠের সাথে মিশিয়ে ছেড়া কাপড়ে তারা আপনাকে রাস্তায় নামিয়ে দিবে আমার মতো।


তখন আমার মতো আপনারও বিত্ত বলে কিছুই থাকবে না
একেবারে নিঃশ্ব হয়ে পড়ে থাকবেন পথে ঘাটে।


সেদিনই পৃথিবীর সমস্ত বিত্তবান মানচিত্র আপনাকে দেখে উপহাসের অট্টহাসি দিবে,
সেইসময়  আপনিই পৃথিবীর সব বিষণ্নতা আর অপমান গায়ে মেখে বলবেন,
“এভাবে বেঁচে থাকার কোন মানে নেই”
————————————
র শি দ  হা রু ন
২৫।০৯/২০২২