আমি আজ অনেক দিন পর আকাশের দিকে তাকালাম।
আকাশের রঙটা একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম।
মাঝে মাঝে মনে হতো আকাশের রঙ বোধহয়-
সাদা, নীল, সবুজ হয়তো বা বেগুনী।
নাকি প্রতিনিয়ত বদলে অন্য কোনো রঙ হয়ে গেছে।


মনোলীনা,
আমি উনিশ বৎসর আকাশের দিকে তাকাইনা,
-শুধু একটি কবিতার জন্য।


শুধু একটি কবিতার জন্য
-আমি ঘরে বাস করেও গৃহত্যাগী হয়েছি।
অসংখ্য মানুষের ভিড়েও আমি সন্ন্যাস নিয়েছি।


মনোলীনা,
আমি কারো কাছে কবি হওয়ার শপথ নেইনি।
কবি হওয়ার মতো কোনো যোগ্যতাও আমার ছিলোনা।


তুমি যখন ক্যাম্পাসে প্রতিটি অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করতে,
তখন তোমার প্রতিটি উচ্চারণ-
আমার বুকে দ্বিতীয় বার উচ্চারিত হতো।
তুমি যখন সুনীল, নির্মলেন্দু, হেলাল হাফিজদের কবিতা চোখ বন্ধ করে আবৃত্তি করতে-
তখন প্রচন্ড রকম হিংসা হতো কবিদের।
কি দরকার ছিলো এতো দরদ দিয়ে কষ্টের কথা লেখা।


তোমাকে দেখলেই আমার মনে হতো-
মানুষের বুকের মাঝে যে গোপন সিন্দুক থাকে-
তা থেকে একটা একটা করে প্রতিটি শব্দ তুমি খুব যত্ন করে সবাইকে দেখাতে।
তারপর আবার লুকিয়ে ফেলতে।
কোন শব্দতে যেনো ধুলোবালি না লাগে!
সে কি আদর।
তখন থেকেই আমি কবিতার প্রথম পংক্তিটুকু খুঁজছি।


আমার বন্ধু, বাপ্পা দত্তের কথা মনে আছে তোমার?
অসম্ভব সুন্দর প্রেমের কবিতা লিখতো।
ওকে কখোনো চুল আঁচড়াতে দেখিনি।
সারাদিন ছাইপাষ খেয়ে চোখ লাল করে রাখতো।
একদিন ওকে বললাম-
“বন্ধু আমিও কবি হতে চাই তোর মতো ’’
অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো,
তারপর হাতের সিগারেটের ছাইটা তুড়ি মেরে ফেলে দিতে দিতে বললো,
“ভিতরে প্রচন্ড কষ্ট না থাকলে কবি হতে পারবিনা।
লিখতে হয়তো পারবি কিছু,
-কিন্তু কবি হতে পারবি না”।


আমি সাথে সাথে বুকের ভিতরে হাতরাতে শুরু করলাম কষ্ট খুঁজতে,
খুঁজে পেলাম কিছু ছোট ছোট কষ্ট।
ছোট বেলায় ধুপ খোলার মাঠে বৈশাখী মেলায়-
জীবনের প্রথম পাওয়া পাঁচ টাকার আস্ত নোটটি হারিয়ে ফেলা।
কিশোর বেলা খুব সাইকেলের শখ ছিলো,
বাবা কিনে দেয়নি।
ঘুড়ি কিনার জন্য একবার মায়ের ব্যাগ থেকে দুই টাকা চুরি করেছিলাম।
আমার অন্য কোনো বড় কষ্ট ছিলো কিনা মনে পড়ে না।
তখন মনে হয়েছিলো আমি অনেক অভাগা।
আমার বুকটা একেবারে সাধারন মানুষের মতো।


আমার কেনো বুক দুমড়ে-মুচড়ে যাবার মতো কষ্ট নেই!!
আমি কেনো কবি হওয়ার মতো কষ্ট জমিয়ে রাখিনি এই বুকে?
আমার বোধহয় এই জীবনে আর কবি হওয়া- হবেনা ।


তাপর থেকে কষ্ট খোঁজার দিন শুরু।
সারা দিন মনে মনে বিড়বিড় করে বলি-
“আয় কষ্ট আয়
-আমার বুকের সব সুখ দুমড়ে-মুচড়ে আয়।
তুবুও বাপ্পা দত্তের কথা মতো বুকের ভিতর প্রচন্ড কষ্ট আসেনা।


এক কষ্ট খুঁজতে গিয়ে-
প্রথমে ছাড়লাম তোমার আবৃত্তি শোনা।
তারপর -
একে একে বিশ্ববিদ্যালয়, বন্ধু, সব পরিচিত মানুষ।
তবুও বুকের ভিতরে প্রচন্ড কষ্ট আসেনা।
তারপর কতো রাত রেল স্টেশনে,
ফুটপাতে, পাহাড় জংঙ্গলে ঘুরেছি।
এমনকি না খেয়েও থেকেছি অনেক দিন,
তবুও বুকের ভিতরে প্রচন্ড কষ্ট আসেনা।


বাবা মারা যাবার পরও মৃত বাবার পাশে
দাঁড়িয়েও কবিতার কথা ভাবছিলাম।
বাবাকে কিছুক্ষণ পর চিরদিনের জন্য কবরে নামিয়ে দেবো,
তবুও বুকের ভিতরে প্রচন্ড কষ্ট হয়নি।
তখনও কষ্ট হচ্ছিলো
-কবিতার পংক্তিটুকু লিখতে না পারার।


মনোলীনা,
আমি কারো কাছে কবি হওয়ার শপথ নেইনি।
শুধু শপথ করেছি -
যে দিন কবিতার প্রথম পংক্তিটুকু লিখবো,
সেদিন থেকে আকাশের দিকে তাকাবো।


আজ অনেকদিন পর,
চায়ের দোকানে বসে কষ্টের কথা ভাবছিলাম।
তখনই পুরোনো একটা পত্রিকার পাতা উল্টাতে গিয়ে তোমার ছবি দেখলাম।
নীচে লেখা ছিল -
“জনপ্রিয় আবৃত্তি শিল্পীর গলায় ক্যান্সার”।


তারপর থেকেই বুক দুমড়ে-মুচড়ে যাবার মতো কষ্ট টের পেলাম নিজের ভিতরে।


লিখলাম প্রথম কবিতা,  
একটি শব্দে -
“ভালোবাসি”।
-----------------------
কাব্যগ্রন্থ- ভালো থেকো মনোলীনা
রশিদ হারুন
০২.১১.২০১৬